ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম : অর্থসংকটে এখন নাজুক পরিস্থিতি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের। ফলে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিশ্রুত ৮৩০ কোটি টাকা পরিশোধে ধুকছে সংস্থাটি। এরমধ্যে ৬৩২ কোটি টাকার ম্যাচিং ফান্ড মাফ চেয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে সদ্য বিদায়ী চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন।
তিনি জানান, চসিকের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দের বিপরীতে ২০-৩০ শতাংশ (ম্যাচিং ফান্ড) ব্যয় গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করপোরেশনের নিজস্ব রাজস্ব আয়ের স্বল্পতার কারণে সেই টাকা আর দিতে পারেনি।
ফলে প্রশাসক হিসেবে বিদায় নেওয়ার আগে বকেয়া এই ম্যাচিং ফান্ড বাবদ ৬৩২ কোটি ১৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা মওকুফ চেয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বরাবর গত ২৫ জানুয়ারি চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি সেই চিঠি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পেয়েছে বলে জানান খোরশেদ আলম সুজন।
চসিক প্রশাসক চিঠিতে উল্লেখ করেন, চসিকের নিজস্ব রাজস্ব এবং বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে সরকার থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে উন্নত নাগরিক সেবা প্রদান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। মহাসড়ক, সড়ক, নর্দমা, রাস্তা, মেরামত/সংস্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা, মশক নিধন এবং সর্বত্র আলোকায়ন নিশ্চিত করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল কর্মযজ্ঞ। এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের জন্য প্রাপ্ত অর্থ খুবই অপ্রতুল। আর্থিক দৈন্যতার কারণে নাগরিক সেবার মান নাগরিকদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। অত্র করপোরেশনের নিজস্ব রাজস্ব আয়ের স্বল্পতার কারণে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দের বিপরীতে ২০-৩০ শতাংশ ম্যাচিং ফান্ড নিশ্চিত করা খুবই কঠিন।
চিঠিতে লেখা হয়, চসিকের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ম্যাচিং ফান্ড বাবদ বকেয়া ৬৩২ কোটি ১৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকাসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনুতোষিক বাবদ প্রায় ৮৩০ কোটি টাকার বিশাল অর্থ ঘাটতির বোঝা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এমতাবস্থায় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ম্যাচিং ফান্ড বাবদ বকেয়া ৬৩২ কোটি ১৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা মওকুফের ব্যবস্থা করা হলে নগরবাসীকে কাঙ্খিত সেবা প্রদান করা এবং সরকারের প্রতিশ্রুত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। এই অর্থ মওকুফের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আপনার একান্ত ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ ও আন্তরিক সুবিবেচনা প্রত্যাশা করছি।
চসিক সূত্র জানায়, চসিক অতীতে আবাসন, পরিবহন, গণশৌচাগার, মার্কেট নির্মাণসহ নানা আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে নগরে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ৩৭টি গণশৌচাগার নির্মাণ, গণপরিবহন সংকট নিরসনে ২০০৬ সালের ১ এপ্রিল ১০টি ভাড়া বাস (প্রতিটি বাসে ৪৮ সিট) নিয়ে নিরাপদ মহিলা ও শিশু যাত্রীসেবা চালু, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে স্বাধীনতা পার্ক নির্মাণ, ২০০৭ সালে সিটি কর্পোরেশন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড নামে ওষুধ কারখানা নির্মাণ, বর্জ্য থেকে লাকড়ি উৎপাদন, আটটি আবাসন প্রকল্প নির্মাণ, ছোট-বড় ৪৮টি মার্কেট (প্রতিবছর রাজস্ব আদায় হয় প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা) নির্মাণ করে আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল।
কিন্তু গত প্রায় ১২ বছর ধরে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। একারণে চসিকের আর্থিক সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এমনকি চসিকের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ গৃহকর আদায় করেও সংস্থাটি অর্থের অভাবে ধুঁকছে। অথচ চসিকের অনেক ভূ-সম্পত্তি আছে, যা সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করলে বাড়তি আয় হতো।
সূত্র আরো জানায়, গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসেও বেশ কিছু ভূসম্পত্তি ইজারা দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে লালদিঘি মসজিদ সংলগ্ন গণশৌচাগার, ঝুমুর সিনেমা হলের উত্তর পাশে জয় পাহাড় মৌজার বিএস দাগের ৫৪০ বর্গফুট খালি জায়গা ভাড়ায় সাময়িকভাবে ব্যবহারের অনুমতি, মাদারবাড়ি ওয়ার্ড অফিস সংলগ্ন ৬৫৩৪ বর্গফুট খালি জায়গা সাময়িকভাবে ব্যবহারের অনুমতি, ইউনুছ মিয়া মেটারনিটি সংলগ্ন ১০৬৪ বর্গফুট খালি জায়গা সাময়িকভাবে ব্যবহারের অনুমতি, মাদারবাড়ি এপার্টমেন্ট সংলগ্ন একতলা ২০০ বর্গফুট ভবনের অস্থায়ী বরাদ্দ, বিআরটিসি মার্কেট সংলগ্ন ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে সেমিপাকা ২৮৯ বর্গফুট অস্থায়ী বরাদ্দ, সাগরিকা রোডের চৌরাস্তার উত্তর পূর্ব পাশে খালি জায়গা বরাদ্দ, কেসিদে (পাবলিক টয়লেট) গণশৌচাগারের পাশে পরিত্যক্ত ৩৭৬ বর্গফুট খালি জায়গা, শাহ আমানত মার্কেটের সম্মুখে আইএফআইসি ব্যাংকের বারান্দার প্রথম তলার ছাদের উপর ৩৯০ বর্গফুট খালি জায়গা সালামি ও মাসিক ভাড়ায় ব্যবহারের অনুমতি, শাহ আমানত মার্কেটের সিঁড়ির উত্তর পাশে বারান্দায় ১৫৩ বর্গফুট খালি জায়গা সালামি ও মাসিক ভাড়ায় ব্যবহারের অনুমতি, কেসিদে (পাবলিক টয়লেট) গণশৌচাগারের পাশে পরিত্যক্ত ৩৭৬ বর্গফুট খালি জায়গা ও ৪০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ভবনের উত্তর-পশ্চিম পাশের ১৭৫৭ বর্গফুট খালি জায়গা ভাড়া দেয়াসহ ১২টি খালি ও পরিত্যক্ত জায়গা ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া গত এক যুগ ধরে এধরনের বহু জায়গা এবং সম্পত্তি অস্থায়ী ইজারা দিয়েছে। যেখান থেকে ইজারা গ্রহীতারা আর্থিকভাবে বেশ ভালই লাভবান হচ্ছে। কিন্তু চসিকের আয় বাড়ছে না।
এ বিষয়ে চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মফিদুল আলম বলেন, চসিকের পক্ষ থেকে অতীতে যেসব আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তার কোনটিতেই লাভ হয়নি। নিজস্ব লোকবল দিয়ে প্রকল্প পরিচালনা করতে গেলেই লোকসান হচ্ছে। তাই চসিক আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করছে না। তবে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ এর মাধ্যমে উদ্যোগ নিলে প্রকল্প লাভজনক হত। কারণ কোন বেসরকারি উদ্যোক্তা তার আর্থিক ক্ষতি হতে দেবে না। উদ্যোক্তা যখন লাভ করবে, লাভের অংশ সিটি কর্পোরেশনও পাবে।
সান নিউজ/কেটি