নিজস্ব প্রতিনিধি, কুমিল্লা : কচু মানব দেহের বিভিন্ন রোগের উপকারের পাশাপাশি শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখতে সাহায্যে করে। কচুর রয়েছে অসংখ্য পুষ্টি গুণ। এতো গুণ থাকার পরও দেশের মানুষের কাছে কদর নেই কচুর। তাচ্ছিল্য করে দেশে বহুদিন ধরেই উচ্চারিত হয়ে আসছে কচু শব্দটি।
মাটিতে দখলদারিত্ব থাকলেও সব সময় অবহেলার মধ্যেই ছিলো উপকারী এই সবজিটি। তবে দেশের আনাচে-কানাচে, রাস্তার ধারে অযত্নে গড়ে ওঠা কচু এখন শুধু বাংলাদেশে নয়, বিদেশেও দাপট দেখাতে শুরু করেছে।
সরেজমিনে, কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, ধান ও অন্যান্য শাকসবজির চেয়ে অধিকতর লাভজনক এবং খরচ কম হওয়াতে বরুড়ার কৃষকরা ঝুঁকছেন কচু চাষের দিকে। এছাড়া প্রায় ৯ মাস ধরে কচু ফলন দেয়। লতির পাশাপাশি পানি কচুর গাছও বেশ ভালো দামে বিক্রি করা যায়।
একশ বছরের বেশি সময় ধরে কুমিল্লায় কচু চাষ হয়ে আসলেও গত ৩ বছর ধরে তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। গত বছর ২৪০ হেক্টর জমিতে কচু আবাদ হয়েছিল, এ বছর আবাদ হয়েছে ২৫০ হেক্টর জমিতে। ইতিমধ্যে কচুর উপজেলা হিসেবে খ্যাত হতে শুরু করেছে বরুড়া। কৃষকদের বাইরে কচু আর লতিকে ঘিরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ২হাজার মানুষের।
পুরুষের পাশাপাশি বরুড়ার নারীরাও কচু চাষের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। কচুর লতি পরিষ্কার করে আটি বাঁধতে পুরুষরা পাচ্ছেন নারীদের সহায়তা। বরুড়ার কচুর সাফল্য দেখে দেশের অন্যান্য জেলা থেকেও এ কচুর চারা সংগ্রহ করতে শুরু করেছেন কৃষকরা। গত মৌসুমে বরুড়া থেকে প্রায় দেড় লাখ কচুর চারা চাষের জন্য বিক্রি করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
এ বছর ৯০ হাজার চারা যাবে অন্য জেলায়। কচুর (লতিরাজ) চারা ৩টাকা দামে এবং পানি কচুর (স্থানীয় ভাষায় বরিশাইল্যা কচু) চারা ৪ টাকা দামে বিক্রি করেন বরুড়ার কৃষকরা। স্থানীয় কৃষি বিভাগও কচুর উৎপাদন ও রফতানি বাড়াতে নানান ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে বলে দাবি করেছে।
উপজেলার কৃষি অফিসের তথ্যমতে, চলমান রবি মৌসুমে কচুর চারা রোপণ করা হয়। অন্য সময়ও রোপণ করেন অনেকে। উপজেলার আগানগর, ভবানীপুর ও খোশবাস দক্ষিণ এই ৩ টি ইউনিয়নের প্রায় সবকটি গ্রামেই সবচেয়ে বেশি কচু চাষ হচ্ছে। উপজেলার বাকি ১২টি ইউনিয়নেও বিচ্ছিন্নভাবে কচুর চাষ হচ্ছে। ২০১৫ সালে উপজেলার মোট ১২০ হেক্টর জমিতে কচুর চাষ হয়েছিলো।
২০১৬ সালে ১৪০ হেক্টর, ২০১৭ সালে ১৬০ হেক্টর, ২০১৮ সালে ১৯০ হেক্টর, ২০১৯ সালে ২৪০ হেক্টর। গড়ে প্রতি কেজি কচুর লতির দাম পড়ে ২৫টাকা। ৭দিন পরপরই লতি উত্তোলন করতে পারেন কৃষকরা। বর্তমানে প্রতিদিন ৪০টন লতি বিক্রি করছেন কৃষকরা। ফাল্গুনের মাঝামাঝিতে প্রতিদিন ৬০টন লতি বিক্রি করতে পারবেন বরুড়ার কচু চাষিরা।
সরেজমিনে উপজেলার আটিওরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় সানাউল্লাহ, রিয়াদ হোসেনসহ বেশ কয়েকজন ব্যাপারী একটি নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করছেন। একটু পর পরই তাদের লোকজন ভ্যানে করে কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা কচু আর লতি এতে স্তুপ করছেন।
সানাউল্লাহ, রিয়াদ হোসেন জানান, চাষিরা এখন আর বাজারে যেতে হয় না। আমরাই তাদের কাছ থেকে সংগ্রহের পর প্রতিদিন বিকেলে ট্রাক যোগে এসব কচু আর লতি ঢাকা-চট্টগ্রাম পাঠাই। একজন ব্যাপারী ১ থেকে ২ টন পর্যন্ত কচু এবং লতি প্রতিদিন সংগ্রহ করতে পারেন।
পুরো উপজেলায় আমাদের মতো ব্যাপারী রয়েছেন ৫০জন। ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে বাছাইকৃত লতি ও কচু কিনে বিদেশে পাঠাচ্ছেন এজেন্সির মাধ্যমে। বর্তমানে শীতের সময় দাম কিছুটা কম। আমরা এখন গড়ে ১৫ টাকা কেজি দামে লতি কিনছি।
উপজেলার আগানগর, বারইপুর, জগদেশর, মুগুজি, আটিওারা শরাফতী, বড় হাতুয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাহিদা থাকায় মানুষ দিন দিন কচু চাষে ঝুঁকছেন। প্রতি বছরই কচু চাষিদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। উৎপাদন বাড়াতে কৃষি বিভাগের আরও বেশি সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন তারা।
ওই সহযোগিতার মধ্যে রয়েছে, বিষমুক্ত উপায়ে সবজি ও কৃষি পণ্য উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া। মাঠে এসে নিয়মতি ফসলের খোঁজ-খবর নেওয়া। প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদন বাড়াতে পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি।
উপজেলার আগানগর গ্রামের লতিচাষী মো.সেলিম মিয়া বলেন, আমি ১৭ শতাংশ জমিতে লতিকচু চাষ করেছি। এতে খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। বিক্রি করবো প্রায় ৪০ হাজার টাকার মতো। প্রতি সপ্তাহে একবার লতি তুলে বিক্রি করি ব্যাপারীদের কাছে। গত ৪০ বছর ধরে আমরা লতি চাষ করছি। আগে না করলেও বর্তমানে আমাদের এলাকার বেশিরভাগ কৃষকই কচু চাষ করছেন।
একই এলাকার শহীদুল্লাহ বলেন, আমি ১৫ শতক জমিতে পানি কচু চাষ করেছি। খরচ হয়েছে ২৫ হাজার বিক্রি করবো ৬০ থেকে ৭০ হাজার। এ কচুর ডগাসহ মূল কচু ও লতি বিক্রি হয়।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.নজরুল ইসলাম বলেন, ধান চাষের চেয়ে এখানে কচু চাষ বেশি লাভজনক। লতির ফলন শুরু হলে ৭ দিন পর পর কৃষকরা লতি বিক্রি করতে পারেন। ৯ মাস পর্যন্ত লতি বিক্রি করা যায়। এসব কারণে কচু চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। এখানকার মাটি কচুর লতিসহ সকল সবজি চাষের জন্য উপযোগী। তিনটি ইউনিয়নে ব্যাপকহারে কচুর চাষ হচ্ছে। বরুড়ার কৃষকদের কাছ থেকে অন্য জেলাগুলোও কচুর চারা নিচ্ছে।
মো.নজরুল ইসলাম আরও বলেন, সরকারের ‘কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প বরুড়া উপজেলা রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় বিষমুক্ত উপায়ে কচুসহ সবজি উৎপাদনে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, প্রদর্শনী করা হচ্ছে। এখন কৃষির আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করা হচ্ছে।
উপজেলা নির্বার্হ কর্মকর্তা (ইউএনও) মে.আনিসুল ইসলাম বলেন, বরুড়ার কচু ও লতির পরিচিতি এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা আমাদের জন্য গৌরবের। পাশাপাশি কৃষি বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে এর উৎপাদন আরও বাড়ানোর জন্য। আমরাও এই বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখবো।
সান নিউজ/এসএ