এনামুল কবীর, সিলেট : জামাল আহমদ (৪২)। পেশায় তিনি হোটেল ব্যবসায়ী। নগরীর তালতলায় তার খাবারের রেস্টুরেন্ট। মধ্যম সারির রেস্টুরেন্টের আয়ে চলে ৮ সদস্যের সংসার। একসময় স্বাচ্ছন্দে চলতে পারতেন। ইদানিং আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যয় বাড়ায় সংসারে দেখা দিয়েছে টানাপোড়েন। যাপিত জীবন খুব কঠিন হয়ে পড়েছে জামিল আহমদের। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও ক্রেতা ধরে রাখতে বাড়াতে পারছেন না রেস্টুরেন্টের খাবারের দাম।
ইতোপূর্বে একজন কাষ্টমারকে একবেলা খাইয়ে কম হলেও ৮/১০ টাকা লাভ হতো। সেখানে এক দু’টাকাও পকেটে পুরা কঠিন হয়ে পড়েছে। গোটা পরিবার নিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছে। এরপর আছে কর্মচারিদের বেতন, এনজিওর কিস্তি ইত্যাদি। এমন পরিস্থিতির জন্য মাস দু’য়েক থেকে চাল আর ভোজ্য তেল ও এলপি গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ি করছেন তিনি।
কেবল জামিল আহমদের বেলায় নয়, নিত্যপণ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই তিন উপাদানের উর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের সংসারে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। জীবন সংসার চালাতে আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলাতে পারছেন না কোনোমতে। ফলে আয় রোজগারের পরও পকেটে টান পড়ছে সহসাই। এ অবস্থায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে নিম্নবিত্তদের স্বাচ্ছন্দ সংসার চালানো দুস্কর। তেল ও চালের সঙ্গে যোগ হয়েছে রান্নার উপকরণে প্রধান ভরসা এলপি গ্যাস।
গত প্রায় ৬ মাস থেকে লাগামহীনভাবে বাড়ছে এলপি গ্যাসের দাম। সেই সঙ্গে ডালের বাজারেও শুরু হয়েছে অস্থিরতা। বাড়তে শুরু করেছে গত দু’দিন ধরে। রোববার সিলেটের পাইকারী বাজার কালিঘাটের চালের আড়ৎ আর পাইকারি দোকানগুলো ঘুরে জানা গেছে এসব তথ্য।
এমনিতে গত কয়েকমাস ধরে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা- সমালোচনা। শহর-বন্দর সর্বত্র। পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের চোখেমুখে নিদারুন হতাশার চিহ্ন। তা কাটিয়ে উঠার কোন লক্ষণতো নেই-ই, উল্টো সেই হতাশা আরও গাঢ় হচ্ছেতো হচ্ছেই। চাল ছাড়া বাঙালির জীবন বলতে গেলে অচল। অথচ গত বৈশাখ থেকেই সিলেটের চালের বাজার অস্থির। দাম বাড়ছেতো বাড়ছেই। বর্তমানে তা আর সহ্যের মধ্যে নেই।
কালিঘাটের চালের আড়ৎগুলো ঘুরে জানা গেছে, একমাস আগে আমন (মোটা) আতপ চাল প্রতিবস্তা পাইকারি দরে বিক্রি হয়েছে ১৭শ’ টাকায়। ৩শ’ টাকার বেশি বেড়ে বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ২০৩০ টাকায়। মালা (২৯) ৫০ কেজি বস্তার দাম ছিল ২০০০ হাজার টাকা, একমাসের ব্যবধানে লাফ দিয়ে এ চালের বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ৬শ’ থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকা। বর্তমানে প্রতিবস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৬৫০ টাকায়। মালা (২৮) বিক্রি এক মাস আগেও প্রতিবস্তা বিক্রি হচ্ছিল ২১৫০ টাকায়। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২৭০০ টাকায়। আতপ মিনিকেটের দামও লাফ দিয়েছে। বস্তাপ্রতি বেড়েছে সাড়ে পাঁচশ’ থেকে ৬শ’ টাকা।
মাসখানেক আগে যেখানে প্রতিবস্তা বিক্রি হচ্ছিল ২২শ’ টাকায়, বর্তমানে তার দাম ২৮শ’ টাকা। মিনিকেট সিদ্ধ চালের দামও বেড়েছে প্রতি বস্তায় প্রায় ৩শ’ টাকা। এক মাস আগে প্রতিবস্তার দাম ছিল ২৩৫০ টাকা, বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ২৬৫০ টাকা। কাটারিভোগের বস্তার দামও বেড়েছে ৬’শ থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকা। একমাস আগে প্রতি বস্তা যেখানে বিক্রি হচ্ছিল ২৫০০ টাকায়, বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৩১শ’ টাকায়। দরিদ্র মানুষের চাল হিসাবে পরিচিত হীরার ( মোটা) দামও বেড়েছে বস্তাপ্রতি প্রায় ৩শ’ টাকা। একমাস আগে প্রতিবস্তার দাম ছিল ১৮৫০ টাকা, বর্তমানে ২১০০ টাকা।
কালিঘাটের অন্যতম প্রধান চালের আড়ৎ মতিউর রহমান অ্যান্ড ব্রাদার্সের কর্ণধার এহিয়া আহমদ এসব তথ্য জানিয়ে মূল্য বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন থেকে চাল আমদানি একেবারেই সীমিত। দেশীয় উৎপাদনও কম। তাই এই সংকট। ৩ বছর আগে সরকার যখন অবাধ আমদানির সুযোগ দিয়েছিলেন, তখন চাল আমদানি করে বাজার স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়েছিল। এখনো যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমদানির অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে চালের দাম আবার নাগালে ফিরতে পারে। পাইকারি বাজারে এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে গ্রামের খুঁচরা বাজারেও বস্তা প্রতি ৪ থেকে শুরু করে ৭শ’ বা সাড়ে ৭শ’ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও জানালেন এহিয়া।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকায় ভোজ্য তেলের অবস্থানও শীর্ষে। গত ২ মাস ধরে সয়াবিনের বাজারেও ঝড় শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রেও কারণ সেই একই, আমদানি বন্ধ বা সীমিত। আড়াই মাসের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে লিটার প্রতি সয়াবিনের মূল্য বেড়েছে ৩০ টাকা, আর খুচরা বাজারে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা! ১ মাস আগে ৫ লিটার সয়াবিনের দাম ছিল যেখানে ৫শ’ টাকা, বর্তমানে তার দাম ৫শ’ ৯০ থেকে ৬শ’ টাকা। ফ্রেশ, রূপচাঁদা, তৃপ্তি, তীর, রয়েল সেফসহ প্রায় সব কোম্পানির ভোজ্য তেলের দামই বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে।
কালিঘাটের মুদি দোকান ইমরাজ স্টোরের স্বত্ত্বাধীকারী মুক্তার হোসেন এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, দেড়/ দুই মাস আগের ৪৫০ টাকার তেল এখন সাড়ে ৬ বা ৭শ’ টাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে না। কোম্পানিগুলোর দায়িত্বশীলরা জানিয়ে দিয়েছেন, মাল নেই। দেয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, এ অবস্থায় আগামী দিনগুলোর অবস্থা কেমন হতে পারে অনুমান করাও কঠিন। জানালেন, এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে ডালের দাম। বস্তাপ্রতি ৫০ টাকা হারে বেড়ে গেছে ইতিমধ্যেই। সামনে রমজান। পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হলে আমদানি প্রয়োজন। সরকারকে সে ব্যাপারে উদ্যোগী হতেই হবে।
প্রধান দুই খাদ্যপণ্যের বাজার দর যখন এমন লাগামহীনভাবে বাড়ছে, তখন আরও খারাপ খবর হচ্ছে, এলপি গ্যাসের দাম। বাড়ছে সেটাও। অবশ্য এক বা দু’মাস ধরে নয়। বাড়ছে গত ৫/৬ মাস ধরে এবং অবশ্যই অস্বাভাবিকভাবে। ৬ মাস আগে যেখানে প্রতিটি সিলিন্ডার বিক্রি হয়েছে ৬৭৫ টাকায়, বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১১শ’ থেকে ১১শ’ ৫০ টাকায়।
আরও খারাপ খবর হচ্ছে, সরকারের মনিটরিং না থাকার কারণে, একেক কোম্পানি একেক দামে বিক্রি করছে। সিলেট গ্যাস ফিল্ডে গ্যাস উৎপাদন বন্ধ থাকার কারণে এলপি গ্যাসের এত দাম বলে জানালেন সিলেট পেট্রোলিয়াম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জুবায়ের চৌধুরী।
তিনি বলেন, অবিলম্বে উৎপাদন শুরু হলে দাম আবার স্বাভাবিক হতে পারে। তিনি সিলেট গ্যাস ফিল্ডে দ্রুত উৎপাদন শুরুর জোর দাবি জানান।
সান নিউজ/এক/এনকে