টি.আই সানি, গাজীপুর : বাংলাদেশের আবহাওয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো বরফের দেশের ফুল টিউলিপ ফোটাতে সক্ষম হয়েছেন ফুলচাষি মো. দেলোয়ার হোসেন। প্রথমবার গবেষণামূলক টিউলিপ চাষের পর এবছর পুরোটাই বাণিজ্যিকভাবে শুরু করেছেন।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে তার বাগানে টিউলিপ ফুটতে থাকে। এখন প্রতিদিন তার বাগানে টিউলিপ ফুটছে। প্রতিদিন দর্শণার্থীরা তার বাগানের টিউলিপ ফুল পরিদর্শন করতে আসছেন। কেউ ফুল কিনছেন আবার কেউ ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। গত প্রায় ১০দিন আগে থেকে একটি দুটি টিউলিপ ফুটতে শুরু করে তার বাগানে।
চাষি দেলেয়োর হোসেন বলেন, ২০২০ সালে সর্বপ্রথম তার বাগানে টিউলিপ ফোটে। প্রথম বছর বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপের চাষ করার কথা ভাবেননি। যখন তিনি ফুল ফোটাতে সক্ষম হয়েছেন তখন তিনি নিজেও অভিভূত হয়েছেন। সে বছর দর্শণার্থীদের জন্য তার টিউলিপ বাগান উম্মুক্ত করে দেন। একটি ফুলও কারও কাছে বিক্রি করেননি। তিনি বলেন, তার বাগানে টিউলিপ ফুটেছে দেখে অন্যদের চেয়ে তিনিই বেশি খুশি হয়েছেন।
ফুল চাষ শুরুর কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রায় ১৬ বছর আগে থেকে ফুল চাষ শুরু করেন। প্রথমে বাণিজ্যিকভাবে পরিকল্পনা করেননি। কিন্তু প্রথম বছরেই উৎপাদন ভাল হওয়ায় পরে গ্লাডিউলাস ফুল চাষের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে চাষবাস শুরু করেন।
নেদারল্যান্ডস থেকেই ফুলের চাষ প্রক্রিয়া, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি ব্যবহার, ফুল গাছ রোপন ও পরিচর্যা প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তিগত পণ্য সংগ্রহ করেন। গাজীপুরের ২০১৯ সালের শেষদিকে নেদারল্যান্ডস থেকে টিউলিপ ফুলের এক হাজার বাল্ব (কন্দ) এনে রোপন করেন। রোপনের ২২ দিনের মাথায় তার বাগানে টিউলিপ ফুল ফোটে। সেবছর তার বাগানে এমনকি দেশের মধ্যে বিরল প্রজাতির টিউলিপ ফুল প্রথম ফোটে।
দেলোয়ার হোসেনের সহযোগী ও তার সহধর্মিনী মিস শেলী চাষবাসে সমানভাবে জড়িত। শেলী বলেন, নেদারল্যান্ড থেকে ২০১৭ সালে রয়েল ভ্যান জেন্টেন (জড়ুধষ ঠবহ তবহঃধহ) নামক একটি কোম্পানী থেকে লিলিয়াম ফুলের ৬০ হাজার বাল্ব এনে চাষ শুরু করি এবং সফল হই। দুই বছর লিলিয়াম উৎপাদন করি। তৃতীয় বছরে লিলিয়ামের বাল্বগুলো সংরক্ষণ করি ও পরে সেগুলো বিক্রি করে ফেলি।
তিনি বলেন, গত বছরের শেষের দিকে একই দেশ থেকে ফুল গাছ ও বাগানের প্রযুক্তিগত কাঁচামাল সংগ্রহ করি। এসময় সেদেশ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে আমাদেরকে টিউলিপ ফুলের এক হাজার বাল্ব ওই কোম্পানী থেকে বিনামুল্যে সরবরাহ করা হয়।
রোপনের ২২ দিনের মাথায় টিউলিপ বাল্বগুলো থেকে দুটি পাতা বেরোনোর পরই ফুল ফোটে। জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ফুলের দেখা মেলে। একে একে প্রায় প্রতিদিন এক হাজার বাল্ব থেকে ফুল ফুটতে থাকে।
এবছর বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপের চাষ শুরু করেছেন। ২০ হাজার বাল্ব দেশের চুয়াডাঙ্গা ও ঠাকুরগাঁওসহ মোট তিনটি জায়গায় রোপন করেছেন। এবছরও টিউলিপ চাষকে গবেষণা পর্যায়ে রেখেছেন। বাণিজ্যিকভাবে ততটা বড় আকারে যাচ্ছেন না। আবহাওয়া এবং বিদেশ থেকে বাল্ব আনায় ট্যাক্সের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রতিটি বাল্ব নিয়ে আসতে সব মিলিয়ে সরকারকে ১৫ টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। যার কারণে বড় আকারে এগুলো আনতে পারছেন না।
চূয়াডাঙ্গার জীবননগরে এক চাষীর মাধ্যমে তার তত্ত্বাবধানেই টিউলিপ বাগান করেছেন। ঠাকুরগাঁওয়ে অপর একজন চাষীর মাধ্যমে ৫ হাজার বাল্ব দিয়েছেন। শ্রীপুরসহ তিনটি জায়গাতেই এখন টিউলিপ ফুল ফুটছে। ঠাকুরগাঁওয়ের আবহাওয়া টিউলিপের জন্য বেশ ভাল বলে জানান তিনি।
বর্তমানে দর্শণার্থীদের কাছে ১’শ ৩০ থেকে ১’শ ৪০ টাকা দরে একটি টিউলিপ ফুল বিক্রি করছেন। ক্রেতারা সাধারণত, বাগানে এসেই ফুলগুলো নিয়ে যাচ্ছেন। আপাতত তারা টিউলিপের বাজারজাত করছেন না।
তিনি জানান, বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপের বাজারটা হবে মূলত: পর্যটনকেন্দ্রিক। বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে শোভা বর্ধনের জন্য টিউলিপের ব্যবহার হবে। ইতোমধ্যে অনেক পর্যটনকেন্দ্রে এবং ব্যক্তি বিশেষ টিউলিপের ছোট ছোট টব নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা এখান থেকে টবে টিউলিপের কলিসহ গাছ দিচ্ছি।
এবছর ফুল ফুটতে বিলম্ব হয়েছে। করোনার কারণে বিমানের শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে বাল্ব আনা ও তা প্রক্রিয়াকরণে বিলম্ব হওয়াতে ফুল ফোটাতেও বিলম্ব হয়েছে। আগামী বছর পানিপথে টিউলিপের বাল্ব আনার পরিকল্পনা রয়েছে। বিদেশ থেকে বাল্ব (কন্দ) আনার ওপর ভ্যাট ট্যাক্স কমানো হলে একটি ফুল ৪০ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব হবে। তখন আমাদের দেশের সাধারণ চাষীরাও টিউলিপের চাষে আগ্রহী হবে। বিদেশ থেকে গাছ আনার ক্ষেত্রে যে ভ্যাট ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয় টিউলিপের বাল্বের ক্ষেত্রেও একই ভ্যাট-ট্যাক্স ধরা হয়েছে। ক্যাটাগরি পরিবর্তন করে ভ্যাট-ট্যাক্স নির্ধারণ করা উচিত। টিউলিপের বাল্ব তৈরী করার জন্য আমাদের আবহাওয়া নেই এমনকি তহবিলও নেই। প্রতি বছরই টিউলিপের বাল্ব নেদারল্যান্ডস থেকে আমদানী করতে হবে। আমদানী ব্যয় কমানোর প্রক্রিয়া করতে হবে। তা না হলে দেশে টিউলিপের চাষ সফল হবে না।
ফুল চাষী দেলোয়ার হোসেন বলেন, টিউলিপ গাছের ফলন ও ফোটার জন্য কমপক্ষে ৯ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রার প্রয়োজন। সেখানে আমাদের এলাকায় সর্বনিন্ম ১৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে। এর মধ্যেই স্বপ্নের এ ফুলটি ফুটেছে। অনেকে ৮০ টাকা পিস কিনে নিতে চেয়েছিলেন, বিক্রি করিনি। দেশে ফলনে যেহেতু এবারই এবং আমার বাগানেই প্রথম সেহেতু, আমি বিক্রি করব না। অনেক দর্শণাথী এসে ফুলগুলো দেখছেন। এটি আমাদের অর্জন, দেখতে ভাল লাগে, মানুষ আসছে দেখার জন্য। এতেই আমাদের আনন্দ। ফুলটি না ফুটলে হয়তো এ আনন্দ আমি টাকা দিয়ে কিনতে পারতাম না।
ভবিষ্যতে টিউলিপের চাষ বড় আকারে বাণিজ্যিকভাবে করার পরিকল্পনা রয়েছে। চাষের বিষয়ে নেদারল্যান্ডস থেকে আরও জ্ঞান নিয়ে বৃহৎ পরিসরে টিউলিপের চাষ করার আশা রয়েছে।
শ্রীপুর উপজেলার কেওয়া দক্ষিণখন্ড এলাকার মো. দেলোয়ার হোসেন দুই একরের বেশি জমিতে ফুলের চাষ করে আসছেন। প্রায় ১৫ বছর যাবৎ ফুলের চাষ করছেন তিনি। এবার স্ট্রবেরি এবং ক্যাপসিকামের আবাদও করেছেন। তার কাছ থেকে ফুল চাষের আদ্যোপান্ত জেনে শুনে ঝিনাইদহ, কালীগঞ্জ, সাভার, কাপাসিয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফুল চাষে এগিয়ে এসেছেন। ফুল চাষে প্রযুক্তিগত কাঁচামাল সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারি সহযোগিতা পেলে ফুল চাষ আরও বিস্তৃতি লাভ করবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গাজীপুরের উপ-পরিচালক মাহবুব আলম বলেন, বাংলাদেশে টিউলিপ চাষ সফলভাবে করা সম্ভব। চাষী দেলোয়ার হোসেন তা করে দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের মাটিতে তিনিই প্রথম টিউলিপ ফুল ফোটালেন। সাধারণত বরফ প্রধান দেশসমূহে টিউলিপ ফুলের চাষ হয়। ইউরোপের দেশ সমূহে প্রচন্ড ঠান্ডা থাকায় সেসব দেশে টিউলিপের অহরহ চাষ হয়ে থাকে। দ্বিতীয়বারের মতো টিউলিপ ফুলের সফল চাষ করে চাষী দেলোয়ার হোসেন অবাক করে দিয়েছেন। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ রপ্তানীযোগ্য পণ্য হিসেবে টিউলিপ ফুলের চাষ করতে পারবে।
সান নিউজ/টিআইএস/এনকে