শামীম রেজা,মানিকগঞ্জ : ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ভাষা আন্দোলনের অন্যতম বীর সেনানী শহিদ রফিকের স্মৃতিকে স্মরণ ও শহিদ রফিক পাঠাগার ধোয়ামোছা, পাঠাগার চত্ত্বর ও তার বাড়ীর আঙ্গিনা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করার ধুম পড়ে যায়।
আর সারা বছর কোন খোজ খবর রাখেনা কেউ। এ মাস এলেই বিভিন্ন মানুষ ও সংবাদকর্মীদের আনা গোনা বেড়ে যায় বলে অভিযোগ করেন শহিদ রফিকের পরিবার।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে প্রথম শহীদ হন মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার রফিক উদ্দিন আহমদ। বিশিষ্ট গবেষক ও সাহিত্যিক বশীর আল্ হেলাল তার ’‘ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘হয়তো আসলে রফিক উদ্দিন আহমদ প্রথম শহীদ হন।
গ্রন্থে বলা হয়েছে ভাষা আন্দোলনকালে ঢাকায় অবস্থানরত শহীদ রফিকের ভগ্নিপতি মোবারক আলী খানের যে বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, তাতেও প্রমাণিত হয় রফিকের মাথার খুলিই উড়ে গিয়েছিল এবং তিনিই শহীদ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শহীদ রফিকের বর্তমানে ৩৭ শতাংশ জমির ওপর ভাষাশহীদ রফিকের পৈতৃকভিটা এ বাড়ীতে তার নামে রয়েছে ৩ শতাংশ জমি। ভিটেমাটিতে নিজস্ব কোন ঘর বাড়ী না থাকাতে প্রশিকা উন্নয়ন কেন্দ্র এনজিও নামে প্রতিষ্ঠানটি টিন সেড বাসগৃহ ও লাইব্রেরী নির্মাণ করেন ২০০০ সালে।
অপর দিকে ২০০৮ সালে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় রফিকের স্মৃতি রক্ষার জন্য রফিকনগর গ্রামে গ্রন্থাগার ও জাদুঘর নির্মাণ করে। যা সারা বছর দ্বায়সারা ভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। বিষয়টি এমনভাবে দাড়িয়েছে যে, শুধু ভাষার মাস এলেই শহীদ রফিক, তার জাদুঘর , গ্রন্থাগার ও তার বাড়ীটিকে মানুষ মনে করে। বাকীটা বছর জুড়ে থাকে অবহেলা ও অযত্নে।
জাদুঘরের ও পাঠাগারের ব্যাপারে লাইব্রেরিয়ান ফরহাদ হোসেন খান বলেন, সবচেয়ে অবাক করার বিষয়টি হচ্ছে, ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ স্মৃতি পাঠাগার ও জাদুঘরের মূল ফটকের সামনেই স্থাপন করা হয়েছে রফিকের ম্যুরাল। কিন্তু সেই ম্যুরালের সঙ্গে শহীদ রফিকের চেহারার ছবির কোনও মিল নেই। অপরদিকে এ জাদুঘরে রফিকের স্মৃতির তেমন কিছুই সংরক্ষণ করা হয়নি।
তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ মহকুমার সিংগাইর থানার বলধরা ইউনিয়নের পারিল গ্রাম। আর এই গ্রামেই পারিলে ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর জন্মগ্রহন গ্রহণ করনে ১ম শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ। রফিকের গর্বিত পিতার নাম আব্দুল লতিফ ও মা রাফিজা খাতুন।
রফিকরা ছিলেন ৫ভাই ও ২ বোন, বর্তমানে ভাই ও বোনের মধ্যে ছোট ভাই খোরশেদ আলম জীবিত আছেন। রফিকের ৪ ভাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা।তার গ্রাম টি এখন রফিক নগর নামে পরিচিত। তার সম্মানার্থে ২০০৮ সালে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিজ গ্রামে একটি গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। আর ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ৬৪ বছর পর ২০১৬ সালে শহীদ রফিকের বাড়ির আঙিনায় বৃহৎ পরিসরে নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার।
শহীদ রফিক তার পারিল গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শরু করেন। তার বাবা তাকে কলিকাতার মিত্র ইন্সটিটিউটে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে তার মন টেকেনি। কয়েক বছর পর ফিরে আসেন দেশে। ভর্তি করিয়ে দেয় সিংগাইরের বায়রা হাই স্কুলে।এ স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি।
এরপর কলেজ জীবনে ভর্তি হন দেবেন্দ্র কলেজের বাণিজ্য বিভাগে এবং ১ম ও ২য় বর্ষ পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তারপর লেখাপড়া বন্ধ। তবে লেখাপড়া ছেড়ে থাকা তার সম্ভব হয়নি। আবারও ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। জগন্নাথ কলেজে ছাত্র থাকাকালে এবং বিয়ে ঠিক হবার পরই ভাষা আন্দোলনে শাহাদাৎ বরণ করেন তিনি।
১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি রফিক তার মামাতো ভাই মোশাররফ হোসেনের সাথে লক্ষী বাজারের দিকে যাওয়ার পথে মেডিকেল কলেজের গেটের কাছে এলে পুলিশ তাদের উত্তর দিকে যেতে বাধা দেয় । তখন তারা মেডিকেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনের মধ্যদিয়ে লক্ষী বাজারের দিকে রওনা দেন এবং মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের উত্তর পশ্চিম দিকের গেটের নিকট পৌঁছান ।
সেখানেও একদল বন্দুকধারী পুলিশকে দেখতে পান তারা। তখন মোশাররফ হোসেন হোস্টেলের ১৩ ও ১৯ নং শেডের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলতে থাকেন। রফিক তখন দাড়িয়ে ছিলেন ২২ নম্বর শেডের কাছে। কিছুক্ষন পরই একদল পুলিশ হোস্টেলে প্রবেশ করেই গুলিবর্ষণ শুরু করে। তখন তার মাথায় গুলি লাগলে হোস্টেলের বারান্দাতেই নিহত হন রফিক।
ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্বৃতি জাদুঘর এর লাইব্রীয়ান ফরহাদ হোসেন খান বলেন, এখানে প্রতিদিন গড়ে ৫০- ৬০ জন লোক আসে । তাছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা ও বাইরে থেকেও দর্শক আসে। এ লাইব্রীতে ১৬ হাজার বই, ছাত্র ছাত্রীর জন্য ৫ টি ট্যাব, ইন্টারনেট সংযোগ সহ কম্পিউটার আছে।
শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ স্মৃতি জাদুঘরে রফিকের তেমন কোনও নিদর্শন নেই, নেই রফিকসহ ভাষা শহীদদের জীবনাদর্শ সম্পর্কিত বই। শুধু ফেব্রুয়ারি মাস এলে পাঠাগারটি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হয়। সেখানে রফিকের স্মৃতিবিজড়িত তেমন কিছু না থাকায় আগত হতবাক হয়ে ফিরে যাচ্ছেন দর্শনার্থীরাও।
ভাষা শহীদ রফিক কে কেন্দ্র করেই স্মৃতি জাদুঘরে পাশেই প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ দিন মেলা বসে। মেলায় রফিকের জীবনী নিয়ে নাটক মঞ্চায়িত হয়। জাদুঘরের সামনে ভাষা শহীদদের ভাস্কর্য স্থাপন ও মুক্তিযোদ্ধের কিছু স্মৃতি করতে পারলে নতুন প্রজন্মের সন্তানরা একসঙ্গে ৫২ ভাষা শহীদ ও মহান মুক্তিযোদ্ধের সম্পর্কে জানতে পারত বলে জানান পাঠিগার কর্তৃপক্ষ।
অপরদিকে, মানিকগঞ্জ শহরের প্রবেশ পথ খালপার সংলগ্ন এই প্রথমবারের মত শহীদ রফিকের ম্যূরালের সামনে বড় পরিসরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।তাছাড়া মানিকগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ও ভাষা শহীদ রফিকের নিজ বাড়ীতেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
সান নিউজ/শামিমরেজা/এসএ