নিজস্ব প্রতিনিধি, ভোলা : মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাল্যবিয়ের হার বাড়ছে। তাই নারীরদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নই পারে বাল্য বিয়ের হার কমাতে।
সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) ভোলার মনপুরায় উপজেলায় “বাল্য বিয়ের কারণ, প্রভাব ও প্রতিরোধের উপায়” নিয়ে এক এডভোকেসি সভার বক্তারা একথা বলেন।
মনপুরা জেলা পরিষদ হল রুমে অনুষ্ঠিত সভায় বাল্যবিয়ে নিয়ে বে-সরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত গবেষণার তথ্যসমূহ উপস্থাপন অনুষ্ঠানে এর কারণ তুলে ধরেন গবেষক ইকবাল উদ্দিন। গবেষণায় মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা কেবাল বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কোস্ট ট্রাস্টের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. মিজানুর রহমানের সঞ্চালনায় সভার সভাপতি ছিলেন- মনপুরা উপজেলা মহিলা ও শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা রুপ কুমার পাল। প্রধান অতিথি ছিলেন- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম মিঞা। বিশেষ অতিথি ছিলেন- মনপুরা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শাখাওয়াত হোসেন এবং মনপুরা প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. আলমগীর হোসেন। শুভেচ্ছো বক্তব্য প্রদান করেন ইউনিসেফ এর শিশু সুরক্ষা কর্মকর্তা জামিল হোসেন।
গবেষণায় ভোলা জেলার প্রতিটি উপজেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। উত্তরদাতাদের মধ্যে নারী ছিলেন ৫৭.১% এবং পুরুষ ৪২.৯%। কেন ভোলায় বাল্যবিয়ের হার বেশি এবং জীবনে এর প্রভাব জানতে কোস্ট ট্রাস্ট (২৫ অক্টোবর-৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ইং) এই গবেষণা করে থাকেন। গবেষণায় দেখা যায়, বাল্যবিয়ের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসাকে দায়ী বলে মনে করেন ৬৩.৬% উত্তরদাতা।
এর সাথে নিরাপত্তাজনিত কারণও জড়িত বলে জানান ৪১.৬%। এছাড়া ছেলে-মেয়েরা যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে তাই পারিবারিক সম্মানের কথা বিবেচনা করে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া হয় বলে মত দেন ৪১%। ভালো পাত্র পেলে বিয়ে দেয়া হয় বলে মনে করেন ৪৭.৮%। অসচেতনতার কথা বলেছেন ৪৪.৯% এবং দারিদ্রতা এর কারণ বলে উল্লেখ করেছেন ৫০.৯% উত্তরদাতা।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৭.৮% উত্তরদাতরই ধারণা নেই ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু আর ১৫-১৭ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হওয়াকে অনেকই শিশু বিয়ে বলে মানতে নারাজ। তাছাড়া শিশুবিয়ে দিলেও পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজন প্রকাশে সেটি স্বীকার করতে চান না। বাল্য বিয়ে বৃদ্ধির ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব আছে বলেছেন ২১.৭%, নাই বলেছেন ৩৯.৫% এবং জানি না বলেছেন ৩৮.৭% উত্তরদাতা।
দরিদ্র পরিবারগুলোতে বাল্যবিয়ের হার বেশি বলে মত দিয়েছেন ৭৬.৪% উত্তরদাতা। মধ্য বিত্ত পরিবারে বেশি বলেছেন ২৯.১% এবং ধনী পরিবারে বেশি বলেছেন ২.৩% উত্তরদাতা। আর শিক্ষার ধাপ বিবেচনায় দেখা গেছে ৫মশ্রেণি শেষ করার পর মেয়ে শিশুদের বিয়ে হয়ে যায় বলেছেন ১৯.১% উত্তরদাতা। ৮ম শ্রেণি শেষ করার পর হয় বলেছেন ৬৭.৩%। মাধ্যমিক শেষ করার পর হয় বলেছেন ১০% এবং উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর হয় বলেছেন ১.৩%। বিয়ের ক্ষেত্রে অধিকাংশমানুষই যৌতুক দেয়/নেয় বলে মত দিয়েছেন ৬০% উত্তরদাতা। এলাকায় বাল্য বিয়ে হলে তা প্রতিরোধ করেন বলে জানিয়েছেন ২৭.৯% উত্তরদাতা, করেন না বলেছেন ৪১%,কখনও কখনও করেন বলেছেন ২৪.৩% এবং অন্যরা করে যেমন পুলিশ, বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ কমিটির লোকজন ইতাদি বলেছেন ৬.৮%।
এছাড়া স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যান শিশু বিয়ে প্রতিরোধে ভালো ভূমিকা রাখেন বলেছেন ২৫.৯%, মাঝে মাঝে ভূমিকা রাখেন বলেছেন ৪০.৮%,কোন ভূমিকা রাখেন না বলেছেন ১৩.৪% এবং তারা ভোটের হিসেব করেন বলেছেন ৮.৯% উত্তরদাতা।
এছাড়া শিশুবিয়ে বন্ধে সরকারি হটলাইন নাম্বারের কথাও জানেন না বলেছেন ৫৪.৫% উত্তরদাতা। বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে সরকারের প্রচেষ্টার প্রতি গুরুত্বারোপ করে আরো কয়েকটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
সেগুলো হলো : ইউনিয়ন পরিষদকে বাল্যবিয়ে বন্ধে আরো সক্রিয় করা, গ্রামে গ্রামে কমিটি গঠন করা। মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। করোনাকালীন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিদ্যালয়গুলো সীমিত আকারে খুলে দেয়া। মেয়েদের শিক্ষার প্রসারে মাধ্যমিক স্থরে ৮০% মেয়েকে উপবৃত্তির আওতায় আনা। উপবৃত্তির অর্থ খুব সামান্য, এটি বৃদ্ধি করা। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ সৃষ্টি করা। ভুয়া জন্ম নিবন্ধন রোধ করা। এলাকায় বাল্যবিয়ে বন্ধে কাজী, ইমাম, পুরোহিতদের সাথে প্রশাসনের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলারা কথা জানান হয়।
মনপুরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম মিঞা বলেন, মেয়েদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নারীদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নই পারে বাল ̈বিয়ে কমাতে। সেজন্য সকলকে কাজ করতে হবে। বাল্য বিয়ে বন্ধে সহায়তা পেতে হটলাইন নাম্বারগুলোকে সকলকে জানাতে হবে। বাল্য বিয়ে রোধ করতে গ্রামে গ্রামে কমিটি গঠন করতে হবে।
মনপুরা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিকগুলো বেশি বেশি করে মানুষের মাঝে প্রচার করতে হবে। নৈতিকতার অবক্ষয় আমাদের রোধ করতে হবে। মেয়েদেরকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। বিয়ে বন্ধে অনেক সময় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করে বাধার সৃষ্টি করা হয়। সেটি বন্ধ করতে হবে।
সভায় আরো বক্তব্য রাখেন- কাসেম মিয়া, মফিজা বেগম, রফিক উদ্দীন, মো. সোহেল, মাসুকুর রহমান, মো. কবির হোসেন, আব্দুর রহিম, রাজিয়া সুলতানা, একরাম আব্দুল কাদের, মেহেদি হাসান রবিন, মো. আজাদ হোসেন প্রমুখ।
সান নিউজ/আই/কেটি