নিজস্ব প্রতিনিধি, জামালপুর : নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত জামালপুরের হরিজনরা নিজ দেশে থেকেও যেন পরবাসী। সমাজে বাস করেও হরিজন কলোনির ১৫০টি পরিবারের ৪৫৮ লোক আছেন সমাজের বাইরে। বংশপরম্পরায় পরিছন্নতাকর্মীর কাজ করছেন তারা। এরপরও ‘ভদ্র-পরিচ্ছন্ন’ নাগরিকদের কাছে তারা যেন অস্পৃশ্য ও অদৃশ্য। এমনকি রাষ্ট্রীয় অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এই হরিজনরা।
হরিজন সম্প্রদায়ের অনেকেই অভিযোগ করেছেন, খাবারের হোটেল থেকে শুরু করে সেলুনেও প্রবেশ করতে দেয়া হয় না তাদের। এমনকি বাড়ির মালিকরা তাদেরকে বসবাসের জন্য বাড়ি ভাড়াও দেয় না। পাশে বসা তো দূরের কথা, কাছেই ভিড়তে দেয় না। এক কাপ চা খাবো, তাও কাপে দেয়া হয় না। গ্লাস নিয়ে গেলে বাইরে দাঁড় করিয়ে কোন রকমে দূর থেকে তাতে ঢেলে দেয়। টাকা দিয়ে খাবার কিনে খাই। এরপরও হোটেলের ভেতরে বসতে দেয় না, বাইরে বসায়। এমন অনেক ধরণের সামাজিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত আক্ষেপের সুরে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন তারা।
অথচ এই হরিজনরাই সুন্দর পরিচ্ছন্ন নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও নাগরিকদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে দুর্গন্ধ ও জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের জীবনকে বিপন্ন করে কাজ করে যাচ্ছে। যে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা পরিচ্ছন্ন করে তুলেছে আমাদের চারপাশ অথচ তাদেরই জীবন রয়ে যাচ্ছে অপরিচ্ছন্নতা ও অনিশ্চিয়তার অন্ধকারে।
বাসফোর হরিজন কল্যাণ পরিষদের সভাপতি শ্রী দীননাথ বাসফোর বলেন, অন্য সব মানুষের মতো আমাদের জীবনেও আছে সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা। আছে চাওয়া-পাওয়া। এই দেশের নাগরিক হয়েও সকল প্রকার নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে আমরা চরম বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার। মিলছে না কোন সরকারি সুযোগ-সুবিধা। লাঞ্ছনা-বঞ্চনা অবহেলার খড়গ সর্বক্ষেত্রে।
তিনি আরও বলেন, সরকারি বিধি অনুযায়ী পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ৮০% কোটা জাত সুইপারদের জন্য নির্ধারিত থাকলেও তা না মেনে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে অন্যজাতের মানুষদের। টাকার বিনিময়ে ভিন্ন জাতের লোক আমাদের পেশায় ঢুকে পড়ছেন। ঘুষের বিনিময়ে চাকরি হচ্ছে তাদের। ফলে হরিজন সম্প্রদায়ে দিনকে দিন বেকারের সংখ্য বেড়েই চলছে।
হরিজনদের জন্য সুইপার বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর যেসব চাকরি বরাদ্দ আছে, এ সমাজের মানুষের সেসব পদে চাকরি করতে লজ্জা হয় না, কিন্তু পাশে বসে চা খেতে রুচিতে বাধে কেন? জাতপাতের বিভাজন রেখায় আমরা প্রতিদিন চরম অবিচার ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। সমাজের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির অবিচার থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই, চাই মুক্তি।
মানবাধিকার কর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনরা লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে সমাজের হীন দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের দ্বারা। সংবিধানে সকল নাগরিকের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকারের কথা বলা হলেও এর ব্যতিক্রম ঘটছে হরিজন সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে। তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দ্বায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের। এই বৈষম্য দূর করে তাদের মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বৈষম্য বিলোপ আইন পাশের দাবি জানান তিনি।
হরিজনেরা এ সমাজের দরিদ্র, অনগ্রসর ও সুবিধা বঞ্চিত সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিষ্পেষিত সম্প্রদায়। তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশার পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক মর্যাদার অভাব যারপরনাই বেদনাদায়ক। এর পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণটি ক্রিয়াশীল, তা হলো তাদের প্রতি সমাজের বৃহত্তর অংশের হীন দৃষ্টিভঙ্গি।
ফলে যুগযুগ ধরে সমাজে নানাবিধ বৈষম্যের শিকার হরিজন জনগোষ্ঠী। ভোরের আলো ফোটার আগে যারা নগরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সৌন্দর্যমন্ডিত করে, সেই হরিজনদের জীবনের আঁধার আজও কাটেনি।
সান নিউজ/এসজে/এনকে/এস