এনামুল কবীর, সিলেট : পরিবেশ ধ্বংসতো বটেই, ফি বছর শ্রমিকদের প্রাণও ঝরে প্রচুর। বিপরীতে বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, মোট চাহিদার মাত্র ৬ শতাংশ উত্তোলন হয় দেশের গ্যাজেটেড ৫০টি কোয়ারি থেকে। এই ৬ শতাংশের আবার মাত্র ২ শতাংশ তোলা হয় বৈধভাবে, বাকীটা অবৈধ পন্থায়।
এ কারণেই নদীভাঙন, ভূমিধ্বস, পরিবেশ দূষণসহ ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পর্যটন শিল্পের বিপর্যয় ঘটে। হাইকোর্টের নির্দেশে ১ বছর থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ। তবে আবারও প্রাণ ও পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাতে শুরু হয়েছে আন্দোলন। ইতিপূর্বে ১২ ঘন্টার পণ্যপরিবহন ধর্মঘটের ধকল সামলে উঠতে না উঠতেই আবারও ৩ দিনের পরিবহন ধর্মঘটের খপ্পরে পড়েছেন সিলেটবাসী।
সিলেটের ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, জাফলং ও লোভাছড়ায় যা পাথর উত্তোলন হয়, তা দেশের মোট চাহিদার অতিসামান্যই। ১ শতাংশেরও কম। অথচ এইটুকুর জন্য সাধারণ শ্রমিকদের প্রাণ যায়, ক্ষতি হয় পরিবেশ ও প্রতিবেশের।
সরকারকে পড়তে হয় পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে। প্রশাসনকে ব্যস্ত থাকতে হয়, কোয়ারির মালিক-ইজারদারের সর্বগ্রাসী অনিয়ম-বিশৃঙখলা সামলাতে। রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়, ভূমিধ্বসে প্রাণহানীর মতো ঘটনাতো ঘটেই, ১২টা বাজে সিলেটের পর্যটন শিল্পের।
এতসব ঝক্কি ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় পরিবহণ মালিক শ্রমিকরা আন্দোলনে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে তাদের আহ্বানে ১২ ঘন্টার পণ্যপরিবহণ ধর্মঘট মোকাবেলা করতে হয়েছে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের মানুষকে।এখন চলছে ৩ দিনের পরিবহণ ধর্মঘট।
বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) তা দ্বিতীয় দিনে গড়িয়েছে। এই ধর্মঘটে নাজেহাল সিলেটবাসী চরম ত্যাক্ত-বিরক্ত ও রাগ প্রকাশ করছেন ধর্মঘট আহ্বানকারী পরিবহণ মালিক শ্রমিক নেতৃবৃন্দের প্রতি। তারা মনে করছেন, গুটিকয়েক পরিবহণ ব্যবসায়ী ও শ্রমিক নেতা নিজেদের স্বার্থে দেশের স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের আন্দোলনের সঙ্গে সিলেট অঞ্চলের আপামর জনগণের কোন সম্পর্কই নেই। বরং তাদের অযৌক্তিক দাবিতে ডাকা ধর্মঘটের কারণে দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সিলেটবাসীকে।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট চ্যাপ্টারের সভাপতি ফারুক মাহমুদ বলেন, ধর্মঘট আহ্বানকারীরা ‘হঠাৎ শ্রমিক দরদি’ সেজেছেন। পাথর কোয়ারিতে যেসব শ্রমিক মারা গেছেন, তাদের পরিবারকে কি তারা কোন সহযোগিতা করেছেন? তারা ধর্মঘট ডেকে হাইকোর্টের আদেশকে লঙ্ঘন করেছেন। এ বিষয়ে আদালত অবমাননার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। সিলেটবাসীকে জিম্মি করে, সাধারণ শ্রমিকদের দোহাই দিয়ে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী বা শ্রমিক নেতার স্বার্থ আদায়ের এই ধর্মঘট এখনই বন্ধ করা দরকার।
তিনি বলেন, আমরা আজ অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছি। যদি তা না হতো, তাহলে যারা ধর্মঘট ডেকেছেন তারাতো সবাই সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাদের ব্যাপারে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই দূর্ভোগ লাঘবে এগিয়ে আসছেন না কেন? তারা আজকের মধ্যে এগিয়ে এলে বুঝতে পারতাম যে, আমাদের অভিভাবক আছেন। এ ধর্মঘটের সঙ্গে সাধারণ সিলেটবাসীর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই-সংযোজন করেন ফারুক মাহমুদ।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, এটি একটি ‘সিন্ডিকেট’ আন্দোলন। পাথরখেকোদের কালো টাকার কাছে শ্রমিক নেতারা বিক্রি হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। এটি কালো টাকার ক্ষমতা প্রদর্শনী। সিলেটের প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে। প্রকৃতি ধ্বংসের অর্থই হচ্ছে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশের ক্ষতি। তাই বর্তমান সময়ে অন্যায্য, অযৌক্তিক পরিবহণ ধর্মঘটের নামে অরাজকতা চলছে। এই ধর্মঘটের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। এটি পাথরখেকো চক্রের অবৈধ অর্থে চলা আন্দোলন, যা এই মুহূর্তে প্রশাসনকে প্রতিরোধ করা জরুরী।
তিনি আরও বলেন, কোয়ারি এলাকায় শ্রমিকের সংখ্যা খুব অল্প। তারা ধান কাটাসহ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত। পুরো আন্দোলনটিই কালো টাকার প্রদর্শনী।
সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছামির মাহমুদ বলেন, পাথর উত্তোলনের দাবিতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অযৌক্তিক আন্দোলনে আমরা হতাশ। ধর্মঘট দিয়ে সিলেট তথা সারাদেশের মানুষকে জিম্মি করে পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যকলাপকে বৈধ করার চেষ্টা একটা বড় অপরাধ। পাথর কোয়ারীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা অন্য পেশায় যেতে পারেন। এক্ষেত্রে সরকার তাদের সাময়িক সহায়তা দিতে পারে। তবে পরিবহণ ধর্মঘট ডেকে উচ্চ আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করা মোটেও কাম্য নয়।
এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেন, পাথর শ্রমিকদের দোহাই দিয়ে পরিবহন ধর্মঘট অযৌক্তিক। এই ধর্মঘট আদালতের রায়ের পরিপন্থী। এটি পরিস্কার আদালত অবমাননা।
প্রায় একই ধরণের মতামত জানালেন, সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাশেম হানিফ, তালতলা ভিআইপি রোড এলাকার রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী জামাল আহমেদ প্রমুখ।
সিলেটের অধিকাংশ সাধারণ মানুষের এমন মনোভাবের বিপরীতেই আজ বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো পরিবহণ ধর্মঘট চলছে। বিভাগের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে ধর্মঘট সফলে তৎপর পরিবহণ মালিক শ্রমিক নেতারা। আর সাধারণ যাত্রীরা বিভিন্ন স্থানে জড়ো হয়ে চেষ্টা করেছেন কাংখিত গন্তব্যে যেতে। যারা সফল হচ্ছেন, তাদের ২/৩ গুণ অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
সান নিউজ/এক/এনকে