নিজস্ব প্রতিনিধি, বরগুনা : বরগুনার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর একমাত্র ভরসাস্থল বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্স মিলনায়তনের ইকোস্টিক সাউন্ড প্রুফ সিস্টেম ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে উন্নয়নের নামে টাইলস করে দিয়েছে বরগুনা পৌরসভা। এঘটনায় বরগুনার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
২০০১সালে বরগুনায় তৎকালীন খাদ্য উপ-মন্ত্রী অ্যাড. ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর উদ্যোগে বরগুনার হাসপাতাল সড়কে এক একর জমির উপর ৮২লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্স মিলনায়তন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক এবং বিভিন্ন সভা-সেমিনারের জন্য আধুনিক ইকোস্টিক সাউন্ড প্রুফ সিস্টেম সম্বলিত অডিটরিয়ামটি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর একমাত্র ভরসাস্থল হিসেবে গত ২০ বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।
বরগুনা পৌরসভার অধীনেই এই অডিটরিয়ামটি নিয়ন্ত্রণ হয়ে থাকে। গত নভেম্বরে অডিটরিয়ামের ভেতরের উন্নয়ন কাজের জন্য জেলা পরিষদ থেকে ৪৫লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু উন্নয়নের নামে ভেতরের ইকোস্টিক সাউন্ড প্রুফ সিস্টেম ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে ছাদ পর্যন্ত টাইলস করে দেওয়া হয়েছে। দরজা-জানালায়ও আনা হয়েছে পরিবর্তন। টাইলস লাগানোর কারণে শব্দের প্রতিধ্বনি হবে এবং কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, সভা-সেমিনার করা সম্ভব হবে না। অডিটরিয়ামটির এমন অবস্থা দেখে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নেতৃবৃন্দ অসন্তোষ প্রকাশ করে। এ ঘটনায় মেয়র শাহাদাত হোসেন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর চাপের মুখে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি কাজ বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন।
এব্যাপারে পৌর মেয়র শাহাদাত হোসেনের নিকট জানতে চাইলে তিনি বলেন, উন্নয়ন কাজটির ডিজাইন ও পরিকল্পনা সব কিছুই জেলা পরিষদ থেকে করা হচ্ছে। তিনি কাজ বন্ধ রেখে সাউন্ড প্রুফ সিস্টেম লাগানোর আশ্বাস দেন।
কিন্তু উন্নয়ন কাজের কাগজপত্রে দেখা গেছে, এ কাজটির ভেতরের ডিজাইন ও স্টিমেট তৈরি করেছেন বরগুনা পৌরসভার ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল ইসলাম।
বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্স এর উন্নয়ন কাজের জন্য সংসদ সদস্যদের স্পেশাল কোঠায় ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর ডিজাইন পরিকল্পনা সবকিছুই পৌরসভা থেকে করা হয়েছে। অন্যায় ভাবে পুরো দায় জেলা পরিষদের উপর চাপানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্স এর ঐতিহ্য এবং মান ঠিক রেখেই উন্নয়ন কাজ করতে হবে। সেখানে যদি কাজ বন্ধ করে নতুন করে করতে হয় তাও করতে হবে।
জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী মোঃ শহিদুল আলম বলেন, যে কোনো সিভিল কাজের ডিজাইন বা পরিকল্পনা অবশ্যই একজন দক্ষ প্রকৌশলীর মাধ্যমে করানো উচিৎ।
এব্যাপারে সংসদ সদস্য ও বরগুনা জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি অ্যাড: ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেন, তৎকালীন মন্ত্রী থাকাকালে তিনি এই বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্সটি বরগুনায় নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। এর উন্নয়নের জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা অবশ্যই মান এবং সাউন্ড সিস্টেম ঠিক রেখে করা উচিৎ ছিল। কোনো কিছু নষ্ট করে উন্নয়ন নয়। অবশ্যই অডিটরিয়ামটির সাউন্ড সিস্টেম ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হবে।
জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সেক্রেটারি অ্যাড: মুনিরুজ্জামান মুনির বলেন, নাট্যচর্চা বন্ধ করতেই ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে অডিটরিয়ামটির এমন হাল করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মীদের জন্য কমপ্লেক্স ভবনটি আঁতুড়ঘর হিসেবে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন আর সেখানে কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা নাটক মঞ্চস্থ করা সম্ভব হবে না। এই উন্নয়ন কাজের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে হত্যা করা হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সাংস্কৃতিক কর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, নিয়ম বহির্ভূতভাবে। অডিটরিয়ামটির দোতলার মহড়া কক্ষগুলোতে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সরকারি কর্মকর্তারা পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। যা নিয়েও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। এছাড়াও অধিকাংশ সময়ে মেয়রের সকল ধরণের শালিস ব্যবস্থা, রিলিফ কার্যক্রম ওই কমপ্লেক্সই হয়ে থাকে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড: শাহ মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ অলি বলেন, বিশেষজ্ঞরা অনেক দিক চিন্তা করেই কমপ্লেক্সের ডিজাইন পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মাণ করেছিল। সেখানে মূল ডিজাইন পরিবর্তন করা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক।
বরগুনা জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকু বলেন, মূল ডিজাইন পরিবর্তন করা এবং একটা সুন্দর সাউন্ড সিস্টেম ফেলে দেওয়া ন্যাক্কারজনক কাজ হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ মেয়রের বিচক্ষণতার অভাব এবং এর দায় তাকে বহন করতে হবে বলে তিনি জানান।
বরগুনার শিশু সংগঠক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব চিত্তরঞ্জন শীল বলেন, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্স বরগুনার সাংস্কৃতিক চর্চার প্রাণ কেন্দ্র। এর মধ্যে টাইলস করলে তো আর কোনো নাটক, সভা, অনুষ্ঠান করা যাবে না। এটা বড় ধরণের ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পৌর মেয়র শাহাদাত হোসেন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্সের সাউন্ড প্রুফ সিস্টেম স্থাপনের আশ্বাস দিলেও সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি। বরং কাজ বন্ধ করার ঘোষণা দিলেও তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করা হচ্ছে।
সান নিউজ/এমএ/এনকে/এস