নিজস্ব প্রতিনিধি, খুলনা : খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর জেলার মানুষের দুর্ভোগের নাম সুপেয় পানি। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানিতে যেমন ভাসতে হয়, তেমনি সারা বছর সুপেয় পানি প্রাপ্তিতে রীতিমতো দুর্ভোগ পোহাতে হয় উপকূলবাসীকে। দক্ষিণের ১৭ টি জেলার কোনোটাতেই পর্যাপ্ত সুপেয় পানি নেই। সব খানেই লবণ পানির আগ্রাসন। কোথাও কোথাও আবার নলকূপের পানিতে রয়েছে আর্সেনিক।
সিডর-আইলা বিধ্বস্ত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট সহ ১৭টি জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের ৫০ লাখ মানুষের আজ চলছে, সুপেয় পানির তীব্র সংকট। লবণাক্তটা বাড়া, পুকুর-খাল ও নদী, উন্মুক্ত জলাশয়সহ পানির প্রধান উৎস প্রভাবশালীদের দখল ও ভরাটের কারণে– দিনদিন বাড়ছে খাবার পানির সংকট। সরকারিভাবে পানি সংকট সমাধানের উদ্যোগের কথা বলা হলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
বেসরকারি সংস্থার হিসাব মতে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ কমবেশি সুপেয় পানির সংকটে রয়েছে। আর্সেনিক, লবণ পানির আগ্রাসন আর পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এই অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট চলছে।
বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা,বরগুনা,পটুয়াখালীসহ উপকূলের ১৭ জেলায় সুপেয় পানি সংকট দীর্ঘদিনের। ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ বছরের অধিকাংশ সময়ই ভুগছেন, সুপেয় পানির তীব্র সংকটে। সিডর ও আইলা বিধ্বস্ত উপকূলীয় এলাকায় পানির উৎস্যগুলো নষ্ট হওয়ার পর, এখনো পুরোপুরি পুনর্গঠন হয়নি। এছাড়া সরকারি জলাশয় বাণিজ্যিকভাবে লিজ ও ভরাট করার প্রতিযোগিতা চলছে। এক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না নিষেধাজ্ঞা। এসব কারণে বাড়ছে খাবার পানি সংকট।
উপকূলীয় অঞ্চলের সুপেয় পানি সমস্যার জন্য সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি ও শহরমুখী পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সামাজিক আন্দোলনের নেতারা।তবে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য সুপেয় ও নিরাপদ পানির সংকট নিরসনে, সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা।
উপকূলের মানুষ এত দিন সুপেয় পানির জন্য নির্ভর করত পুকুর, বৃষ্টি এবং পিএইচএফ প্রযুক্তির ওপর। গত ছয় মাস আগে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সেই উৎসগুলোর অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পিএইচএফ প্রযুক্তির অধিকাংশই অকেজো হয়ে গেছে। এখন নির্ভর করতে হচ্ছে দূরদূরান্ত থেকে কিনে আনা পানির ওপর। সুপেয় পানির অভাবে এসব এলাকায় বাড়ছে নানা রোগ।
এলাকাবাসী বলছেন, লবণ পানির প্রভাবে চর্মরোগ, কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত রোগ বাড়ছে। ক্ষেতে ফসল ফলে না। গো-খাদ্যের চরম সংকট চলছে। চিংড়ি চাষেও দেখা দিয়েছে মন্দা। একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত এলাকার পানির উৎসগুলো। আর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সুপেয় পানি সরবরাহের কথা শুধু আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কাজে আসছে না মোবাইল পানি শোধনাগারগুলোও। এ সমস্যার সমাধান কবে হবে তা জানে না উপকূলবাসী।
এদিকে জনবল সংকট এবং দক্ষ টেকনিশিয়ানের অভাবে দুর্যোগকালীন সময় ছাড়া জাপান সরকারের সহায়তায় দেওয়া মোবাইল পানি শোধনাগারগুলো জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর কোনো কাজে লাগাতে পারছে না। তবে এই প্রকল্প চলমান থাকায় অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খায়রুল হাসান অবশ্য আশার কথা জানাচ্ছেন।
তিনি বলেন, এই প্রকল্প সামনের বছরের জুন মাস পর্যন্ত চলমান আছে। ফলে ওই প্রকল্পের ফান্ড থেকেই সবকিছু মেরামত করা হবে। তখন এই সমস্যা কিছুটা হলেও কমে যাবে।
আর সুপেয় পানির নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান খুলনা গ্রামীণ পানি সরবরাহ বিভাগের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আকমল হোসেন। তিনি বলেন, আমরা নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছি। যেখানে, সৌরচালিত ও পিএসএফের মাধ্যমে পানি পরিশোধিত করা হয় এবং জনগণের মাঝে বিতরণ করা হয়।
এদিকে পানি সমস্যা সমাধানে সমন্বিত পদক্ষেপের কথা জানালেন বিশেষজ্ঞরা। অ্যাওসেড (খুলনা) এর প্রধান নির্বাহী শামীম আরেফিন বলেন, সরকারি-বেসরকারি অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই সমস্যা সমাধান করা যায়নি। এর স্থায়ী সমাধান করতে প্রাকৃতিক উৎসগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘এ জন্য সব নদী ও খাল দখলমুক্ত করে তার জোয়ার-ভাটা নিশ্চিত করতে হবে।’
সান নিউজ/পিডিকে/এস