নিজস্ব প্রতিনিধি, সাতক্ষীরা : সোমবার ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা মান্ধাতার আমলের থ্রি নট থ্রি আর এসএলআরের ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করে। ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা।
সন্তান হারানোর বেদনা ভুলে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাথে রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিপাগল আপামর জনতা। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেদিনের সাহসী সন্তানরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। পাক হানাদার ও তাদের দোসররা মা-বোনের ইজ্জত হরণ করেছিল। ধ্বংস করতে চেয়েছিল বাঙ্গালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে।
শত্রুর বুলেটের এত সব আঘাত সহ্য করেও সাতক্ষীরার সন্তানরা ১৬টি সম্মুখ যুদ্ধের মোকাবেলা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ৮ম ও ৯ম সেক্টরের আওতাধীন সাতক্ষীরা জেলা। প্রথম ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল সাতক্ষীরার ভোমরায়। ৭১ এর ২৫ মার্চের পর তৎকালিন পাজ্ঞাবি এসডিও খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতার, পাকিস্থানি পতাকায় অগ্নি সংযোগ, অস্ত্রাগার লুট, পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দিয়ে দামাল সন্তানেরা যে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিল তার সফল সমাপ্তি ঘটে ৭ ডিসেম্বর।
এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রিমূখী আক্রমণে আতংকিত হয়ে পাক সেনারা দ্রুত সাতক্ষীরা ছেড়ে খুলনা অভিমুখে পালিয়ে যায়। সাতক্ষীরাকে শত্রমুক্ত করে বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে চুমু খায় এবং স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তলন করে। ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ সাতক্ষীরা শহরে পাকিস্তান বিরোধী মিছিলে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে শহীদ আব্দুর রাজ্জাককে।
৮ম ও ৯ম সেক্টরের অধীনে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিং শেষে ২৭ মে সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে আবদুল গফুর এমএনএ ও ইপিআর সুবেদার আইউবের নেতৃত্বে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় পাক সেনাদের দু’শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। ১৭ ঘন্টাব্যাপী এ যুদ্ধে শহীদ হয় তিন জন মুক্তিযোদ্ধা। আহত হয় আরো দুজন মুক্তিযোদ্ধা।
এরপর থেমে থেমে চলতে থাকে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্ত হামলা। এসব যুদ্ধের মধ্যে ভোমরার যুদ্ধ, টাউন-শ্রীপুর যুদ্ধ, বৈকারী যুদ্ধ, খানজিয়া যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এ সব যুদ্ধে শহীদ হয় ৩৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। লাইটের আলোয় অসুবিধা হওয়ায় ৩০ নভেম্বর টাইম বোমা দিয়ে শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভীত সন্ত্রস্ত করে ফেলে পাক সেনাদের। রাতের আঁধারে বেড়ে যায় গুপ্ত হামলা।
পিছু হটতে শুরু করে পাক সেনারা। ৬ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় টিকতে না পেরে বাঁকাল, কদমতলা ও বিনেরপোতা ব্রীজ উড়িয়ে দিয়ে পাক বাহিনী সাতক্ষীরা থেকে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর জয়ের উন্মাদনায় জ্বলে ওঠে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও সাতক্ষীরার বধ্যভূমি গণকবরগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
অযন্তে আর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে বধ্যভূমি ও গণকবরের স্মৃতিচিহ্ন। এগুলো যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তাই বধ্যভূমি ও গণকবরের স্মৃতি ধরে রাখার জণ্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন সাতক্ষীরার মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শত্রুদের গুলিতে সাতক্ষীরার অনেক বীর সন্তান শহীদ হন।
তারা হলেন শহীদ আব্দুর রাজ্জাক, এড. ক্যাপ্টেন কাজী, আনসার, কাজল, খোকন, নাজমুল, নারায়ণ, হাফিজউদ্দিন, মনোরঞ্জন, নুর মোহাম্মদ, আবু বকর, ইমদাদুল হক, জাকারিয়া, শাহাদাত হোসেন, আব্দুর রহমান, আমিনউদ্দিন গাজী, আবুল কালাম আজাদ, সুশীল কুমার, লোকমান হোসেন, আব্দুল ওহাব, দাউদ আলী, সামছুদ্দোহা খান, মুনসুর আলী, রুহুল আমীন, জবেদ আলী, শেখ হারুন অর রশিদ প্রমূখ।
সাতক্ষীরা সদ্য সাবেক জেলা ইউনিট কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মোশারফ হোসেন মশু জানান, সাতক্ষীরা মুক্তি দিবস ৭ ডিসেম্বর। এ দিনে ১৯৭১ সালে সাতক্ষীরাকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক বছর ৭ ডিসেম্বর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যথাযথ মর্যদার সাথে দিবসটি উদযাপন করে আসছি।
সান নিউজ/এসএ