এনামুল কবীর, সিলেট : এখনো খাঁখাঁ সিলেটের এমসি কলেজের মনোলোভা সবুজ ক্যাম্পাস। শানবাঁধানো পুকুরঘাটে পড়ন্ত বিকেলের সেই উচ্ছাস নেই, নেই বাদাম, চানাচুর, আইসক্রিম বা চা ওয়ালাদের হাঁকডাক। চারদিকে যেনো এক নিরব হাহাকার। গত প্রায় দু'মাস থেকেই একসময়ের কোলাহলমুখর এমসি ক্যাম্পাসের এই দশা। স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূ গণধর্ষণকান্ডের পর বিকেলে কেউ আর এমুখো হচ্ছেন না। কখনো সখনো দু’য়েকজন এলেও ফিরে যাচ্ছেন প্রধান ফটক থেকে।
এমনিতে প্রতিদিন ৩শ, সাড়ে ৩শ’ মানুষের পদভারে বিকেলগুলো মুখর থাকতো এমসি কলেজের সবুজ টিলাটালা।
শুক্রবারের বিকেলটায় সেটি হতো দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। তবে গণধর্ষণকান্ডের পর থেকে এখনো রীতিমতো খাঁ খাঁ করছে এই ক্যাম্পাস। সম্প্রতি এক শুক্রবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউকে দেখা যায়নি সবুজ গালিচায়, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, পাড় বা আশপাশের টিলায়। কেবল কয়েকজন নির্মাণ শ্রমিককে কর্মব্যস্ত দেখা গেছে। অবশ্য ঐ জঘন্য ঘটনার পর বিনাপ্রয়োজনে কলেজ ক্যাম্পাসে না যেতে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে। মূল ফটকে কলেজেরই একজন কর্মীকে দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত দেখা গেছে। জানালেন, গণমাধ্যম ও স্টাফ ব্যতিত আপাতত আর কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।
টিলাটালা পরিবেষ্টিত সিলেটের এমসি কলেজ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অসাধারণ লীলাভূমি। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ আরও অনেক বিখ্যাত মানুষের পদধূলিতে ধন্য এই ক্যাম্পাসের প্রশংসা করেছেন সবাই। আগের সেই জৌলুস না থাকলেও সারি সারি পাম, শিশু, দেবদারু, সেগুনসহ নাম না জানা আরও নানা বৃক্ষ ও তাদের শাখা-প্রশাখা, নানা ধরণের ফুল, বিশাল পুকুরের শান বাঁধানো ঘাট আর স্বচ্ছ জলে ফোটা শাপলায় ক্যাম্পাসটা রীতিমতো মোহনীয়।
এমনিতে সিলেট মহানগরীর নাগরিকদের জন্য ছুটির বিকেলগুলো কাটানোর মতো খুব বেশি জায়গা নেই। এ অবস্থায় প্রায় সারাবছর এমসি কলেজ ক্যাম্পাসের এই মোহনীয় রূপের টানে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নাগরিক ক্লান্তি জুড়াতে ছুটে আসেন সৌন্দর্য় পিয়াসীরা। এদের মধ্যে থাকেন স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ, যারা বিকেলে একটু হাটাহাটি পছন্দ করেন, আড্ডা প্রিয় তরুণ-তরুণী, কলেজের শিক্ষার্থী, প্রেমিক-প্রেমিকা, নবদম্পতি ছাড়াও থাকেন অনেক প্রবাসী।
প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে হাতে হাত রেখে অসংকোচে ঘুরে বেড়ানোর মতো এমন একটা জায়গা এখন আর মোটেও নিরাপদ নয়। দুমাস আগের এক শুক্রবার সন্ধ্যায় এই কলেজের প্রধান ফটক থেকে তুলে নিয়ে ১৯ বছরের এক গৃহবধূকে গণধর্ষণ করেছে কলেজ ছাত্রলীগের ‘রঞ্জিত গ্রুপ’ হিসাবে পরিচিত কয়েকজন লম্পট নেতা। ছিনিয়ে নিয়েছে মোবাইল ও গহনা। পবিত্র এ ক্যাম্পাসকে কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত করেছে তারা। এই ঘটনায় আতঙ্কিত নগরবাসী সেদিকে এখন আর যাচ্ছেন না। গত দু’মাস ধরে ক্যাম্পাসটা পর্যটক শূণ্য। অবশ্য প্রশাসন থেকে সেদিকে আপাতত না যাওয়ার যে নির্দেশনা ছিল, তাও বহাল এখনো।
সরেজমিনে বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থানকালে ২/১ জন স্টাফ, কর্মরত একদল নির্মাণ শ্রমিক ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি। এই ক্যাম্পাসেই গত প্রায় ২৮/২৯ বছর ধরে চা-বিস্কুট ফেরি করে নিজের সংসার চালাচ্ছেন বৃদ্ধ হানিফ মিয়া (৭০)। কথায় কথায় সান নিউজকে জানালেন, এখন আর ভেতরে পর্যটকরা প্রবেশ করছেন না। নির্মাণ শ্রমিকদের কাছে কয়েক কাপ চা বিক্রির জন্যই আসেন তিনি। তাও সব দিন নয়।
শুধু হানিফ মিয়াই নয়, ৪/৫ জন পান সিগারেট ও বাদাম ওয়ালা এবং ফটকের বাইরের কিছু চা ওয়ালার জীবনেও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তাদের বেঁচা-বিক্রিও অর্ধেকের চেয়েও বেশি কমে গেছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন ছোট ব্যবসায়ী। মূল ফটকে দায়িত্বরত কলেজের কর্মচারী শওকত হোসেন জানালেন, দু’মাস ধরে কেউ এদিকে তেমন একটা আসছেন না। দু’একজন তরুণ ভেতরে ঢুকতে চাইলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।
সান নিউজ/এক/এনকে