সৈয়দ মেহেদী হাসান, বরিশাল: ১৪ অক্টোবর ২০২০। শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাপাতালের দন্ত বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন রূপাতলী হাউজিংয়ের বাসিন্দা ষাটোর্ধ রেহেনা বেগম। করোনাকালীন ভীড় কম থাকায় অনেকটা সহজেই পেয়ে যান ডাক্তারের সিরিয়াল। ডাক্তার তার দাঁত দেখে জানালেন তুলতে হবে। এও বললেন, ১০৮ নম্বর কক্ষে সিরিয়াল দিয়ে যাবেন দাঁত তোলার। রেহেনা বেগম কুজো হতে হতে গিয়ে দাঁড়ালেন ১০৮ নম্বর কক্ষের সামনে। সেখানে সিলিপ দিতেই রেজিস্ট্রার বহিঃতে নাম ঠিকানা তুলে দায়িত্বরত কর্মচারী জানিয়ে দিলেন ২০২১ সালের মার্চ মাসের ১৬ তারিখ তার দাঁত উত্তোলন করা হবে।
দাঁতের যন্ত্রনায় কাতর রেহানা বেগম তাজ্জব বনে গেলেন; শেবাচিম হাসপাতালের ওই কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা দাঁত তুলে মারা যেতে পারবো? জবাবে সেই কর্মচারী বললেন, দাঁত তুলে আপনাকে মরতে হবে কেন! আগেই মরতে পারেন। বয়সতো কম হয়নি। লাইন ছাড়েন। পরের জনকে আসতে দেন। রেহানা হতাশ হয়ে ফিরে আসছিলেন। তখন অবশ্য উপায়ও বাতলে দিলেন, দন্ত চিকিৎসকের সেই সহযোগী। তিনি সদর রোডের একটি ঠিকানা দিয়ে জানালেন এখানে যান; কালই দাঁত তুলতে পারবেন।
শুধু যে রেহানা বেগম তেমন নয়, প্রতিদিন এমন অসংখ্য রোগী হয়রানির শিকার হন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তেমনি ২৫ অক্টোবর বিকেলে স্টাফ নার্স শহিদুল ইসলামের হাতে মারধরের শিকার হন বানারীপাড়া উপজেলার বাসিন্দা জুয়েল মোল্লা ও তার চাচী। এমনকি মার খেয়েও মুচলেকা দিয়ে পার পেতে হয়েছে ওই রোগীর স্বজনকে।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে এমন অবহেলা, হয়রানি আর লাঞ্ছনা রোগীর স্বজনদের নিত্যদিনের সঙ্গী। যে কারনে শের-ই-বাংলা মেডিকের কলেজ হাসপাতালকে আতঙ্ক বলে মনে করেন রোগীরা।
বছরের পর বছর ধরে এমন হয়রানি আর রোগী অবহেলা চললেও পরিচালক ডাঃ বাকির হোসেন জানিয়েছেন, নিয়ম মতই সব কিছু চলছে। তিনি মনে করেন, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আয়তন যেমন বড় তেমনি এখানে সেবা নিতে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন আসে। কয়েক হাজার মানুষ একস্থানে হলে নির্ধারিত নিয়মের একটু ব্যত্যয় হতে পারে। এই কর্মকর্তা মনে করেন, বরংছ তার প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক লোকবল সংকট রয়েছে। সেই কারনে সেবায় বিচ্যুতি হতে পারে। যা কারও ইচ্ছাকৃত নয়।
তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে গড়ে ওঠা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কারনে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ সরকারী এই প্রতিষ্ঠানের সেবার মান নিম্নমুখি করছেন কেউ কেউ। যা নিয়ে বর্তমানে দুটি পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানেও রয়েছে। এমনকি চিকিৎসকরা ইন্টার্নদের হাতে মারধরের শিকার হয়েছেন। মূলত, শেবাচিমের সামনে গড়ে ওঠা শ’ খানেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠানো এবং সেখান থেকে কমিশন প্রাপ্তি নিয়ে মূল অন্তঃকোন্দল চলছে হাসপাতালটিতে।
কমিশন বাগিয়ে রাখতে গিয়ে রাজনৈতিক দলের পরিচয় নিয়ে আসছেন কেউ কেউ। গঠিত হচ্ছে একের পর এক সংগঠন। চলছে কমিটি কমিটি খেলা। সেই সংগঠনগুলো রোগী সেবার মানোন্নয়নে কাজ না করলেও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে দরকষাকষির মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছাতে কাজ করছেন।
হাসপাতালের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারী এই হাসপাতালেরও ওপর থেকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রভাব খর্ব করতে না পারলে সেবার মান আরও তলানীতে নামবে। তাছাড়া হাসপাতালের অভ্যান্তরে এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানের বিষয়ে পরিচালকও কোন ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। তার কারন অক্টোবরে শেষ হওয়া মন্ত্রণালয়ের তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ পায় অডিট বিভাগ। বিষয়টি হাসপাতলে জানাজানি হলে বেকায়দায় পড়েন পরিচালক। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় চিকিৎসক-কর্মচারীরা। সেই সুবাদে ইন্টার্ন চিকিৎসক এবং চিকিৎসকরা ‘অর্থ আয়ের শস্যক্ষেত’ হিসেবে ব্যবহার করছেন হাসপাতালকে। চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, এমনও ডাক্তার রয়েছেন যারা বর্হিঃবিভাগে বসেন তার বেসরকারী চেম্বারের ভিজিডিং কার্ড বিতরণের জন্য।
জানা গেছে, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠানো নিয়ে দুই গ্রুপ চিকিৎসকের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক (যিনি ডাঃ মাসুদের সাথে বিরোধে জড়িয়েছেন) জানিয়েছেন, ছোট্ট একটি অনুরোধ উপেক্ষা করাকে কেন্দ্র করে এই ঘটনার সূত্রপাত।
ওই ইন্টার্ন চিকিৎসক দাবি করেছেন, ২০ অক্টোবর ইন্টার্ন চিকিৎসক সজল পান্ডের পরিচিত একজন রোগী আসলে তিনি তার পরিচিত একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করানোর জন্য যেতে বলেন। কথামত সেই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করিয়ে এসে একই বিভাগের ডাক্তার মাসুদকে সেই রিপোর্ট দেখাতে গেলে অসন্তোষ প্রকাশ করেন ডাক্তার মাসুদ। ডাক্তার মাসুদ উষ্মা প্রকাশ করলে সেই বিষয়টি সজল পান্ডের পরিচিত রোগী গিয়ে পান্ডেকে জানান। রোগীর কাছে বলা ডাঃ মাসুদের কথা শুনে ক্ষেপে যান সজল পান্ডে। তিনি তার বন্ধু তারিকুল ইসলামকে নিয়ে ডাঃ মাসুদের কক্ষে গিয়ে জানতে চান। সেখানে উভয়ের মধ্যে বাগবিতন্ডা হয়। এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে সজল পান্ডে, তারিকুল ইসলাম ৮/১০ জনকে নিয়ে এসে কক্ষে আটকে মারধর করেন মেডিসিন বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডাঃ মাসুদকে। এ ঘটনার বিচার চেয়ে ২১ অক্টোবর পরিচালকের কাছে অভিযোগ করেন ডাঃ মাসুদ। ২২ অক্টোবর ছাত্রলীগ পরিচয় নিয়ে পাল্টা স্মারকলিপি প্রদান করেন সজল পান্ডে ও তার সহযোগীরা। এর একদিনের (২৩ অক্টোবর) মাথায় শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি কমিটির ঘোষণা দেন নিজেদের পেশিশক্তি দেখানোর জন্য। পাশাপাশি ‘ছাত্রলীগ’ পরিচয় ব্যবহার করে ওই শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা সিনিয়রদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন।
জানা গেছে, রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে আন্তঃবিভাগ চিকিৎসকদের সাথে কয়েক দফায় দেখা করে এক ধরণের চাপ সৃষ্টি করেন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা। তারা দাবী তোলেন, ডাঃ মাসুদকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সহায়তা করলে ‘অসহযোগ’ আন্দোলনে যাবে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। তারা কর্মবিরতি করবে। পাশাপাশি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠালে সমআনুপাতিক হারে পাঠাতে হবে। শুধু চিকিৎসকদের সাথে যেসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার চুক্তিবদ্ধ সেখানেই নয়, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সাথে চুক্তিবদ্ধ ডায়গনস্টিক সেন্টারেও রোগী পাঠাতে হবে। কর্মবিরতির হুমকির বিষয়টি আমলে নিয়ে আন্তঃবিভাগ চিকিৎসকরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করতে সাময়িক বহিস্কার করেন ওই সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মাসুদকে।
তবে ডাঃ মাসুদ জানিয়েছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর আমার বিশ্বাস আছে। আমি ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দ্বারা মারধরের শিকার হয়েছি তার সুবিচার পাবো। বিস্তারিত তিনি বলতে রাজি হননি। ওদিকে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা এবং তাদের সংগঠনের নেতা ডাঃ সজল পান্ডে ও তারিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ডাঃ মাসুদের দুর্নীতির প্রতিবাদ তারা করছেন। তাকে মারধর করেননি। যা অভিযোগ আনা হয়েছে তা মিথ্যা।
হাসপাতালের প্রশাসনিক দপ্তর জানিয়েছে, সবার অভিযোগ খতিয়ে দেখছে তদন্ত কমিটি। ইতিমধ্যে তদন্ত অনেক দুর এগিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে দ্রুতই কার্যকর সিদ্ধান্ত জানাবে কর্তৃপক্ষ। ওদিকে ডাঃ মাসুদকে হাসপাতাল থেকে বদলী করার জন্য দুই দফায় হাসপাতাল পরিচালক ডাঃ বাকির হোসেনের সাথে রাজনৈতিক পরিচয়ে দেখা করে সুপারিশ পাঠানোর জন্য দাবী জানিয়েছে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কমিটি।
দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে পরিচালকের বিরুদ্ধেও : সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করা অডিটে ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে পরিচালক ডাঃ বাকির হোসেনের যোগসাজশে ৮০ কোটি টাকার অনিয়ম দুর্নীতির প্রমান পেয়েছে বলে জানা গেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান অডিট অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কথা জানিয়েছেন। তিনি জানান, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অডিট এখনো চলমান। যে কারনে স্পষ্ট করে কোন কথা বলা যাচ্ছে না। তবে এই হাসপাতালে এক বছরে প্রায় ৮০ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে।
সেই অডিটে উঠে এসেছে আর্থিক ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে ক্রয়চুক্তি অনুমোদন করেন পরিচালক ডাক্তার বাকির হোসেন। যাতে নিয়ম বর্হিভূতভাবে ব্যয় হয় ৪ কোটি ৫৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। আমদানির পক্ষে কোনো রেকর্ডপত্র গ্রহণ না করা সত্যেও ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহ বাবদ ঠিকাদারকে জালিয়াতির মাধ্যমে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫৪ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। এমএসআর কেমিক্যাল রি-এজেন্ট বাজারমূল্য অপেক্ষা অতিরিক্ত দরে পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয় ১৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা। স্পেসিফিকেশন বহির্ভূত এমএসআর ওষুধ ও সার্জিক্যাল টেপ ক্রয়ে আর্থিক জালিয়াতি ১ কোটি ১৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। অতিরিক্ত দরে ব্রয়লার মুরগির মাংস ক্রয়ে আর্থিক ক্ষতি ৬০ লাখ ৫৬ হাজার টাকা আত্মসাৎ। পণ্য খাতে রোগী অপেক্ষা পাউরুটি, কলা ও ডিম সরবরাহ দেখিয়ে ৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা আত্মসাৎ। বেড সংখ্যা অপেক্ষা অধিক রোগীর পথ্য দেখিয়ে ১ কোটি ৮২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ। এ ছাড়া অন্যান্য খাতে ৬৫ কোটি ৭৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৯৬ টাকার গুরুতর অনিয়ম হয়েছে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সান নিউজ/এমএইচ/এনকে/এস