নিজস্ব প্রতিবেদক,লালমনিরহাট : মাসখানেক আগেও তিস্তা নদীর পানিতে ভাসিয়েছিলো দু কূলের মানুষের জীবন, গ্রাস করেছে গ্রামের পর গ্রাম, ভেঙেছে কৃষকের কষ্টে বোনা ফসলের মাঠ, সেই সর্বনাশা তিস্তা এখন শুকিয়ে মরুভূমির বুকে দৃর্শমান ধু ধু বালুচর। এক মাসের ব্যবধানে তিস্তা নদী শুকিয়ে কঙ্কালসার বালুর স্তুপে পরিণত হয়েছে। তিস্তার বুকে নেই তার বুকে ছুটে চলা নৌকা, নেই জেলেদের নিত্যদিনের মতো মাছ ধরার প্রতিযোগীতা। নদীটি যেন মরে বালু মহালের রুপ লাভ করেছে। কিছু আগের বন্যার ক্ষত মুছে না যেতেই তিস্তার এই পরিণতি দেখে হতাশ নদীপাড়ের লাখো মানুষ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, তিস্তার নাব্য সংকট এতটাই প্রকোট আকার ধারণ করেছে যে, আসন্ন রবি মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজের সেচ প্রকল্পের কার্যক্রম চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে। প্রতিদিনই কমছে পানি। কোথাও সামান্য পানি আবার কোথাও দিগন্তজোড়া বালুচর। ব্যারাজ এলাকা থেকে শুরু করে তিস্তা নদীর ১৬৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পানি না থাকায় শঙ্কায় পড়েছেন কৃষক। ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে নিঃস্ব হচ্ছে। একদিকে,নষ্ট হচ্ছে কৃষকের শ্রমে-ঘামে অর্জিত ফসল ও ভাঙছে ফসলের মাঠ। অন্যদিকে, নদী ভাঙনের কবলে দিনদিন নি:স্ব হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষের মাথা গোজার একটু ভরসা স্বপ্নের বসতবাড়ি।
এদিকে, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে ভারত তাদের গজলডোবা বাঁধের সাহায্যে একতরফাভাবে পানি আটকিয়ে বাংলাদেশের উত্তর জনপদের লাখ লাখ কৃষকের চাষাবাদ ব্যাহত করছে। ফলে দিন দিন প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে দেশের বৃহত্তম তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প। এতে করে উত্তর জনপদের কৃষকের চোখে-মুখে দেখা দিয়েছে জীবন চলার পথে দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তা। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক এ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করে তিস্তা নদী বাঁচানোর পাশাপাশি কোটি মানুষের একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন কৃষিকেও বাঁচাতে আকুতি জানিয়েছে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর এলাকার কৃষি-সেচ নির্ভর মানুষ।
নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি এবং শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনের তুলনায় কম পানি থাকায় উত্তর জনপদের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বর্ষায় পানি উপচে ভাঙনের মুখে পড়ে বসতবাড়ি, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, সড়ক, পুল, কালভার্ট। আর শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে খাঁ খাঁ করে বালুচর। এর ফলে চাষাবাদ কমে যাওয়ায় বদলে যাচ্ছে এলাকার মানুষের জীবিকা। চলতি মৌসুমেই তিস্তাপাড়ের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ধু-ধু বালুচর দেখা যায়। বালু চরে চিনাবাদাম, মিষ্টিকুমড়া ও তরমুজ চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কৃষকেরা।
জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে লালমনিরহাটের দোয়ানীতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় তিস্তা সেচ প্রকল্প। নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলার ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দিতে নেওয়া হয় এ প্রকল্প। পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়া অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ১৮ অক্টোবর সকালে ব্যারাজ পয়েন্টে পানি ছিল ২৮ হাজার কিউসেক। কিন্তু স্বাভাবিক পানি প্রবাহ প্রয়োজন ৪০ হাজার কিউসেক। পানি প্রবাহ কম হওয়ায় সেচযোগ্য জমির আওতা এ বছর কমে যাবে। এলাকার কৃষি থেকে বঞ্চিত ভুক্তভোগী লোকজন আশা করছেন, ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি হলে তাদের ভোগান্তি আর থাকবে না। চুক্তি হলে তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ একটা নিয়মের মধ্যে থাকবে। তিস্তা নদীতে পানি কম থাকায় জেলেরা বেকার হয়ে পড়েছেন।
নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে সে অঞ্চলের শত শত মানুষ। বর্ষা শেষ না হতেই নদীতে পানিও নাই, মাছও নাই। পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে আছে জেলেরা। সাত-আট বছর আগেও মাছ পাওয়া যেত। এখন তিস্তায় পানি না থাকায় প্রতি বছর মাছ কমে যাচ্ছে। তাই অনেক জেলে পূর্ব পুরুষের এ পেশা ছেড়ে দিনমজুরের কাজে নেমেছে। তিস্তা শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির হয়ে পড়েছে। নদীতে জেগে ওঠেছে অসংখ্য চর। বর্ষায় হঠাৎ করে পানির ঢল নামায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে বাড়িঘর, গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্রীজ-কালভার্ট সব ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। এতে গৃহহীন হয়ে পড়ে শত শত পরিবার।
সান নিউজ/ এসকে