দিনাজপুর প্রতিনিধি:
বিল বকেয়ার জটিলতায় দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া এলাকার তিনটি পানির পাম্পের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এতে খাবার পানির তীব্র সংকটে পড়েছেন বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি এবং তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী পার্বতীপুর ও ফুলবাড়ি উপজেলার অন্তত ১৫ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। বোরো মৌসুমেও তারা পাচ্ছেন না চাষাবাদের পানি। এদিকে পুণ:সংযোগের মাধ্যমে বিনামূল্যে পানি না দিলে আন্দোলনের মাধ্যমে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের হুমকি দিচ্ছেন তারা।
বড়পুকুরিয়ায় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় পানি তুলতে গিয়ে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় এলাকাবাসীর আন্দোলনের মুখে ৯ বছর আগে প্রায় ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে দুধীপুর, রামভদ্রপুর, শেরপুর ও মধ্যপাড়া মৌজায় চারটি গভীর নলকূপ বসায় পিডিবি। ওই বছরই বিদ্যুৎসেবাও পান গ্রামবাসী। সেই থেকে চারটি পাম্পের মাধ্যমে যথেষ্ট না হলেও অন্তত ১ হাজার পরিবার খাবার ছাড়াও কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় পানি পেয়ে আসছিলেন। কিন্তু তিনটি পাম্পের বিদ্যুৎ বিল ৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা বকেয়া পড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। প্রায় এক বছর বন্ধু রয়েছে পাম্পগুলো। এতে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৬ সালে নির্মিত বড়পুকুরিয়া কয়লা কিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ পানির চাহিদা মেটাতে পিডিবি প্রথমে একই বছর পার্শ্ববর্তী ইউসুফপুর মৌজায় ১৪টি পানির পাম্প বসায়। পরে আরও ৬টি পাম্প বসানো হয়। এসব পাম্প থেকে ঘণ্টায় দেড় হাজার টনের বেশি পানি উত্তোলন করা হচ্ছিল। দীর্ঘদিন পানি তোলার কারণে ওই এলাকার ভূগর্ভস্থ্য পানির স্তর নেমে যায়। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন কয়লা খনির চারদিকের দুধীপুর, পশ্চিম দুধীপুর, ইউসুফপুর, রামভদ্রপুর, উত্তর রামভদ্রপুর, পাতিগাও, শেরপুর, বাগড়া, শাকগ্রাম, চৌহাটি, রামপুরা, তেলিপাড়া, কালিয়াডাঙ্গা, বৈদ্যনাথপুরসহ অন্তত ১৫ গ্রামের বাসিন্দারা।
২০০৯ সালের পর পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করে বড়পুকুরিয়া এলাকায়। আগে গ্রামবাসী যেখানে চাপকলের মাধ্যমে ভূগর্ভের ৫০-৬০ মিটার থেকে পানি পেতেন, পরবর্তীতে ২০০ মিটার নিচ থেকেও পাওয়া যাচ্ছিল না পানি। শুষ্ক মৌসুমে পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরও ভয়াবহ। এক পর্যায়ে এলাকাবাসী পানি, বিদ্যুৎসহ ৬ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু করলে ২০১১ সালে ওই চার গভীর নলকূপ বসানো হয়।
গ্রামবাসী শুরু থেকে বিনামূল্যে পানির দাবি জানালেও দেনদরবার শেষে সেচ পাম্পের ভর্তুকি মূল্যে (প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ৮২ পয়সা) সরবরাহের কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু অন্যত্র পানি বিক্রির অভিযোগে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড সাত বছর পর ২০১৮ সালে পানি পেতে বিদ্যুতের বাণিজ্যিক দর নির্ধারণ করে প্রতি ইউনিট ৭ টাকা ৭০ পয়সা করে। এতে অধিকাংশ পরিবার নিম্নবিত্ত হওয়ায় সঠিকভাবে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারছিল না। ফলে বকেয়া গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকায়।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সংলগ্ন ধাপেরবাজার এলাকার ভুক্তভোগিরা বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য মানুষের মধ্যে হাহাকার পড়ে যায়। বোরো মৌসুমে গভীর নলকূপ বসিয়েও জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা চললে এলাকার কৃষকরা পথে বসবেন।’
বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ ও দাম বাড়ানোর বিষয়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঈন উদ্দিন সান নিউজকে বলেন, ‘কয়লা খনি ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষতিগ্রস্ত বিবেচনায় পিডিবি পানির সমস্যা সমাধানে পাম্প দিয়েছিল। শুরুতে আমরা ভর্তুকি মূল্য নিয়েছি। কিন্তু পাম্পের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা স্থানীয় দুধীপুর সমবায় সমিতি লিমিটেডের লোকজন এই পানি দিয়ে ব্যবসা করেছে। তারা পাইপ বসিয়ে অন্য গ্রামে বিক্রি করেছে। তদন্তে প্রমাণ পাওয়ার পর আমরা বিদ্যুতের বাণিজ্যিক মূল্য নির্ধারণ করেছি। এরপর বিপুল পরিমাণ বিল বকেয়া পড়ায় দুধীপুর, রামভদ্রপুর ও শেরপুরের পাম্পে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। শুধুমাত্রা মধ্যপাড়া মৌজার পাম্পটি চলছে।’
তবে দুধীপুর সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দাম বাড়ানোর আগে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড পানি নিয়ে ব্যবসার ভুয়া অভিযোগ করছিল। পরে মনগড়া তদন্ত করে দাম বাড়িয়েছে। এলাকাবাসী বারবার পানি নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে না বললেও তারা শোনেনি। সমিতির সদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রম দেন। আমরা এখনো চ্যালেঞ্জ করছি, নিরপেক্ষ তদন্ত হলে এমন কিছুই পাওয়া যাবে না।’
এ বিষয়ে পিডিবির মালিকানাধীন বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান সান নিউজকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে আমরা পাম্পগুলো করেছিলাম। বিদ্যুতের বাণিজ্যিক মূল্য বসানোয় অনেক দিন ধরে সংকট দেখা দিয়েছে। আমরাও অস্বস্তিতে আছি। বিদ্যুৎ বিতরণ পল্লী বিদ্যুতের হাতে। এজন্য আমরা সরাসরি কিছু করতে পারি না। তবে এলাকাবাসী অভিযোগ দেওয়ার পর আমাদের চেয়ারম্যান (পিডিবি) পল্লী বিদ্যুতের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করছেন।’দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম বলেন, ‘বিল না দিলে সংযোগ থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জনস্বার্থের কথাও ভাবতে হবে। দ্রুত বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করব।’