এনামুল কবীর, সিলেট : বৃহস্পতিবার বিকেল। তালতলা ভিআইপি রোডের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সাথে ফিসফাঁস করতে দেখা গেলো এক সুদর্শণ তরুণকে। ম্লান হেসে তিনি বললেন, খারাপ অবস্থায় আছি- বলতে বলতে মুখে পান পুরে চলে যাচ্ছিলেন তিনি। ঐ ব্যবসায়ী একটু শব্দ করে সালাম দিয়ে আরেকবার বললেন, কয়েকদিন একটু সাবধানে থাইকেন। পরে এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে ঐ ব্যবসায়ী জানালেন, তার আত্মীয় ঐ লোকটা সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানায় কর্মরত। কি একটা ব্যক্তিগত কাজে বেরিয়েছেন সিভিল পোশাকে। সচরাচর তিনি পুলিশের পোশাকই ব্যবহার করেন। আকবরকান্ডের পর এখন ভালো বা মন্দ, সব পুলিশ সদস্যের মধ্যেই এমন চাপা আতঙ্ক আশঙ্কা বিরাজ করছে। তাই বাড়তি সর্তক তারা।
অবশ্য ইতিমধ্যেই পুলিশকে ধাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। একই দিন বিকেলে আখালিয়া এলাকায় বিক্ষুব্ধ জনতার ধাওয়া খেতে হয়েছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের জালালাবাদ থানার ৩ টহল পুলিশ সদস্যকে। বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদের নিজের এই এলাকার প্রায় অর্ধ সহস্রাধিক বিক্ষুব্ধ মানুষ হত্যাকান্ডের বিচার ও বরখাস্তকৃত এসআই আকবরকে গ্রেপ্তারের দাবিতে সিলেট সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করেছিলেন। তাদের রাস্তা থেকে সরাতে গেলে ঐ ৩ জনকে ধাওয়া করেন বিক্ষোভকারীরা। এসময় তাদের উদ্দেশ্যে জুতাও নিক্ষেপ করেছেন কেউ কেউ।
পুলিশ সদস্যরা দ্রুত একটি দোকানে ঢুকে পড়লে তাদের নিরাপত্তা দিয়েছেন ঐ দোকানের মালিক ও কর্মচারীরা। কোন অঘটন ঘটেনি, তবে ঘটতে পারতো। এসব বিচার বিশ্লেষণ ও মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন সাধারণ পুলিশ সদস্য জানালেন, হামলা-টামলার ব্যাপারে এখন তাদের অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হচ্ছে।
এসএমপির কোতোয়ালি মডেল থানার বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে গত শনিবার রাতে নগরীর আখালিয়া-নেহারীপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান আহমদকে (৩৪) ধরে নিয়ে রাতভর নির্যাতন করা হয়। সকাল পৌণে ৮টার দিকে ওসমানী হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রায়হান মৃত্যুবরণ করেন।
পুলিশ ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার করলেও তার স্ত্রী তানিয়া আক্তার তান্নি রোববার রাতে হত্যা মামলা দায়ের করেন। তার অভিযোগ, রায়হানের শরীরে মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন তারা দেখেছেন। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে নগরজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। বিক্ষোভ-মানববন্ধন কর্মসূচি নিয়ে রাস্তায় নামেন সচেতন মানুষ। নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। বরখাস্ত করা হয় বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ ৪ জনকে। প্রত্যাহার করা হয় আরও ৩ জনকে। এরমধ্যে আকবর নিখোঁজের খবর আন্দোলনের আগুনে যেনো ঘি ঢেলে দেয়। প্রতিদিন বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সভা থেকে আকবরসহ দায়ীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানানো হচ্ছে।
এ অবস্থায় সিলেট মহানগরীর ৬টি থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্য, বিশেষ করে টহল পুলিশ সদস্যরা কিছুটা হলেও লজ্জা ও দুর্বলতায় ভুগছেন। সিনহার পর রায়হানের এমন পরিণতি তারা নিজেরাই মানতে পারছেন না। মানুষ বিক্ষুব্ধ, কখন কি ঘটে অনুমান করা কঠিন। আর তাই দায়িত্ব পালনে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছেই। এমনিতে বিশেষ কোন নির্দেশনা দেয়া না হলেও তাদের সতর্ক থেকেই কাজ করতে হচ্ছে।
তবে ‘আকবরকান্ডের’ পর কেউ আর নির্দেশনার অপেক্ষায় না থেকে নিজ দায়িত্বেই সতর্ক থাকছেন। এসএমপির নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হ্যাঁ আমরা সতর্কতার সাথে কাজ করছি। কোন পুলিশ ভালো আর কোন পুলিশ মন্দ- এটাতো আর সাধারণ মানুষ জানেন না। সুতরাং বাড়তি সতর্কতা অবশ্যই দরকার। আমরা তা করছি।
বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার বিএম আশরাফ উল্লাহ তাহের বলেন, “এমনিতেইতো আমাদের সতর্ক থেকে কাজ করতে হয়। এখন এই পরিস্থিতিতে যারা যে দায়িত্ব পালন করছেন বা অফডিউটিতে ব্যক্তিগত কাজে বের হচ্ছেন, তারাতো বাড়তি সতর্ক থাকবেনই। থাকা উচিৎও। তবে এ সংক্রান্ত কোন বিশেষ নির্দেশনা তাদের দেয়া হয়নি।”
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এখনো কোন অঘটন ঘটেনি। সিলেটবাসী আইনের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ও সহযোগীতা পরায়ণ। তারা আমাদের কাজে সহযোগীতা করছেন। আগামীতেও করবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।”
সান নিউজ/এক/এস