এনামুল কবীর, সিলেট প্রতিনিধি : রাস্তার বাদাম ওয়ালা থেকে পান-সুপারী বা তরকারি ওয়ালা, সবাইকেই টাকা দিতে হয়। সিলেট মহানগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ি তাই যেকোন পুলিশ সদস্যের জন্য লোভনীয় পোস্টিং। অনেক আগে থেকেই এই ফাঁড়ির এমন কুখ্যাতি। আর তাই বড়কর্তাদের ম্যানেজ করে প্রায় ১ বছর আগে ডিবি ছেড়ে এই ফাঁড়ির দায়িত্ব নিয়েছিলেন সদ্য বরখাস্তকৃত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া।
এরপর তো সোনায় সোহাগা! ফাঁড়ির চাঁদা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় দৈনিক লাখ টাকার উপরে। শুরু হয় কাঁচা টাকায় বিলাসবহুল জীবন-যাপন। সাথে নিজের এলাকায় একের পর এক জমি-প্লট ক্রয়, ব্যাংক ব্যালেন্সের স্ফিতি ছাড়াও ব্যায়বহুল প্রাসদ নির্মাণ।
বছরের পর বছর ধরে চলে আসা চাঁদাবাজির ধারাবাহিকতা শুধু রক্ষাই নয়, আকবর গত প্রায় একবছরে তা আরও দ্বিগুণ বাড়িয়েছেন। খুব সাধারণ ঘরের ছেলের চাকচিক্যময় জীবন ও বিলাসবহুল বাড়ি নিয়ে এখন সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জুড়ে দারুণ চর্চা চলছে।
ইতিমধ্যে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আশুগঞ্জের দুর্গাপুর ইউনিয়নের বগইর গ্রামের দরিদ্র স্কুল শিক্ষক জাফর আলীর ছেলে আকবর হোসেন ভুঁইয়া ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দিতে না দিতেই পাল্টাতে শুরু করে পুরো পরিবারের ভাগ্য।
টিনশেডের ঘরের জায়গায় উঠেছে বিশাল দালান। প্রাসাদোপম বাড়িটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে অতিসম্প্রতি। শুধুই কি বাড়ি? নতুন নতুন জমি ও প্লট কিনতে থাকেন একের পর এক। এক
সময়ের নিরিহ ও নিম্নবিত্ত পরিবারটির ঠাটবাট দেখে এখন অনেকরই চক্ষুচড়ক গাছ হওয়ার উপক্রম। অবশ্য তার এক ভাই সিঙ্গাপুরেও আছেন।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের গণমাধ্যম কর্মকর্তা আশরাফ জানিয়েছেন, বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তার নিয়োগ হয়েছে গত বছরের ২ নভেম্বর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, এই সময়ে আকবর ও তার পরিবারের সদস্যদের ঠাট-বাট বেড়েছে কয়েকগুণ।
বন্দরবাজার এলাকার একাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও হকারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেক আগে থেকেই ১০ টাকা থেকে ৭০/৮০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয় ফাঁড়ির নিযুক্ত দালালের হাতে। গত ১ বছরে এই অত্যাচার আরও বেড়েছে। আগে যারা ১০ টাকা করে দিতেন, এখন তাদের দিতে হয় ২০ টাকা। যারা ২০ টাকা দিতেন, এখন তাদের দিতে হচ্ছে ৩০/৩৫ টাকা। এভাবেই চলছে। না দিলে বা প্রতিবাদ করলেই মারধর নির্যাতন। কখনো বা ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে চড়-থাপ্পড় লাথি।
এছাড়া একটু রাতে রিক্সা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে বৈধ স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে এ রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়াতেও টাকা গুণতে হতো। ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে বিয়ের প্রমাণ চাইতেন। ১০ হাজার থেকে ২০/৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে তারপর ছাড়া পান ভুক্তভোগীরা। আর সিলেটের সুইপার কোলোনি হিসাবে খ্যাত কাষ্টঘর-মহাজনপট্টি রাস্তার মুখে প্রতিদিন ওঁত পেতে থাকে ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা। নানা ধান্দায় বা বাহানায় নেশা করেছেন কি না, তা পরীক্ষা করা হয় কখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কখনোবা বন্দরফাঁড়িতে নিয়ে। সেখানে নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়ে আসতেন অভিভাবকরা। তারপর ছাড়া হয়।
এমনি এক ঘটনায় শনিবার রাতে নির্যাতনের পর রোববার সকালে হাসপাতালে মারা যান নগরীর আখালিয়া-নেহারীপাড়ার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান উদ্দিন (৩৪)। তিনি ২ মাসের এক কন্যা সন্তানের পিতা। পুলিশ প্রথমে ছিনতাইয়ের অভিযোগে গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে বলে চালিয়ে দিতে চাইলেও রায়হানের পরিবারের সদস্যদের কারণে তা আর সম্ভব হয়নি।
তার স্ত্রী কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। আকবরসহ তার ৪ সহযোগী পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত ও ৩ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরপর থেকে প্রতিবাদে উত্তাল সিলেট মহানগরী। এসআই আকবরসহ রায়হান হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবি জোরালো হচ্ছে। রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শিক্ষার্থীসহ সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) বিকেলে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক প্রায় আড়াই ঘন্টা অবরোধ করে রেখেছিলেন রায়হানের নিজ এলাকার অর্ধ সহস্রাধিক বিক্ষুব্ধ মানুষ। তারা টায়ার জ¦ালিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। তখন একদল পুলিশ রাস্তা থেকে তাদের সরাতে গিয়ে ধাওয়া খেয়ে আত্মরক্ষার্থে এক ব্যবসায়ীর দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এসময় বিক্ষোভকারীরা তাদের দিকে জুতা খুলে ছুঁড়ে মেরেছেন।
বিক্ষোভকারীরা ঘোষণা দিয়েছেন, অবরোধ আবার হবে। আন্দোলন-সংগ্রাম চলবে। আকবরসহ জড়িত অন্যান্যদের গ্রেপ্তার করা না পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। রায়হান হত্যা মামলাটি পিবিআই তদন্ত শুরু করেছে। আকবর যাতে দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।
সান নিউজ/এক/এম