নিজস্ব প্রতিবেদক:
স্বল্প বিনিয়োগে অধিক লাভের আশায় দক্ষিণাঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের বিভিন্ন খামারে হাজার হাজার মানুষ কুচিয়া ও কাঁকড়া চাষ শুরু করেন। থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ব্যাংকক, হংকং, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হলেও কুচিয়া ও কাঁকড়ার বড় বাজার মূলত চীন। দক্ষিণাঞ্চলের এসব জেলায় প্রায় এক দশক ধরে কয়েক হাজার চাষি বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া ও কুচিয়া চাষ করছেন। এর মধ্যে মূলত সাতক্ষীরা অঞ্চলের কাঁকড়া ও কুচিয়া’র ৮০ ভাগই রফতানি করা হয় চীনে।
তবে করোনা ভাইরাসের কারণে গত ২৫ জানুয়ারি থেকে এই দুই পণ্য চীনে রফতানি বন্ধ রয়েছে। এর ফলে কেনা-বেচায় চরম নেমেছে ধস। বিপাকে পড়েছেন কয়েক হাজার চাষি। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে চাষিরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এরইমধ্যে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। পণ্যের দাম কমে গেছে পাঁচগুণ। আগে যে কাঁকড়া প্রতি কেজি বিক্রি হতো ১ হাজার ৫০০ টাকা এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকায়।
জানা যায় বাগেরহাটের সাত উপজেলায় ১৫০০ হেক্টর জমিতে ৩ হাজার ৭৭৮টি কাঁকড়ার খামার রয়েছে। তবে সেখানে গত ২২ জানুয়ারি থেকে স্থানীয় ডিপো মালিকরা কাঁকড়া কেনা-বেচা বন্ধ রেখেছেন। বড় হয়ে যাওয়া পূর্ণ বয়সের এ কাঁকড়া বেশিদিন খামারে রাখা যায় না। ভরা মৌসুমে বিক্রি করতে না পারায় খামারে প্রতিদিনই কাঁকড়া মারা যাচ্ছে।
খুলনার পাইকগাছার চাষি বিধান ঘোষ জানান, চীনে করোনা ভাইরাসের কারণে বাংলাদেশ থেকে কুচিয়া ও কাঁকড়া রফতানি বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন পাইকগাছার হাজার হাজার চাষি ও ব্যবসায়ী। কয়েক হাজার পরিবারে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা।
সাতক্ষীরার রামলাল জানান, কয়েক বছর আগে চীনসহ মধ্যপ্রাচের কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের কাঁকড়া ও কুচিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে শুরু হয় বাংলাদেশ থেকে ওইসব দেশে কাঁকড়া ও কুচিয়া রফতানি। সাতক্ষীরায় সাধারণত মিষ্টি পানির কুচিয়া ও লোনা পানির কুচিয়া পাওয়া যায়। মিষ্টি পানির কুচিয়া কেজিপ্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়। আর লোনা পানির কুচিয়া বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১১০ টাকায়। ফলে সাতক্ষীরার মানুষ কাঁকড়ার পাশাপাশি কুচিয়া সংগ্রহের প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ে। কুচিয়া রফতানি করে বাংলাদেশ সরকার মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতো। কিন্তু বর্তমানে ক্রেতা না থাকায় প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে এসব পণ্য।
সাতক্ষীরা জেলা কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বলেন, ঢাকার বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে আমরা কাঁকড়া ও কুঁচিয়া সরবরাহ করে থাকি। ওইসব কোম্পানি মূলত চীন ও উত্তর কোরিয়ায় এগুলো পাঠায়। কিন্তু রফতানি বন্ধ হওয়ায় ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ টাকা আটকে পড়েছে ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে। অনেকে তাদের দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। চীনে কাঁকড়া ও কুচিয়া রফতানি না হলে পুঁজি হারিয়ে বেকার হবেন এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মানুষ। আগে যেখানে গড়ে প্রতিদিন ৪-৫ টন কাঁকড়া পাঠানো হতো। সেখানে গত একমাসে মাত্র ৩-৪ টন কাঁকড়া রফতানির জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছি।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসার মশিউর রহমান বলেন, এ অঞ্চলে উৎপাদিত শতকরা ৯০ ভাগ কাঁকড়া রফতানি হয় চীনে। গত বছর জেলায় ৩১০ দশমিক ৯ হেক্টর জমিতে কাঁকড়া চাষ হয়। ওই জমি থেকে দুই হাজার ১৯০ দশমিক ৪ মেট্রিক টন ও সুন্দরবন থেকে এক হাজার ১০৯ মেট্রিক টন কাঁকড়া সংগ্রহ করা হয়। একই সময়ে কুচিয়া উৎপাদন হয় ৩৫০ মেট্রিক টন। কিন্ত বর্তমানে রফতানি বন্ধ থাকায় চীনের আমদানিকারকদের কাছে এখানকার ব্যবসায়ীদের ১৫০ কোটি টাকা আটকে আছে। ফলে একদিকে ব্যবসা বন্ধ, অপরদিকে পাওনা টাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দিতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন আড়তদাররা।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশে ২০১৯ সালে কাঁকড়া-কুচিয়ার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণ প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। চলতি বছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ১১০০ কোটি টাকা। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়ল এ খাত।
বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিলড ফুড এক্সপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত রফতানিকারকের সংখ্যা রয়েছে ২০৪টি। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। রফতানিকারকদের হিসেবে, বর্তমানে প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাঁকড়া-কুচিয়া মজুদ আছে। ১০০ কেজিতে দৈনিক ৫-৭ কেজি কাঁকড়া-কুচিয়া মারা যাচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে দ্রুত সরকারকে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ অবস্থায় এর বিরুপ প্রভাব পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতিতেও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন তারা। হুমকিতে পড়বে রফতানিমুখী এই খাত।
তবে মৎস্য বিভাগ বলছে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, নতুন বাজার সৃষ্টিসহ নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
সান নিউজ/সালি