রনি রেজা
শাওনের ঘুম শতভাগ নিশ্চিত হয়েই মোবাইলটা হাতে নেয় মুর্শিদা। তবু বুক ধড়ফড় করছে। সাবধানে পা টিপে টিপে রুম থেকে বের হয়ে যায়। অতি সাবধানে বাইরে থেকে সিটকিনি আটকে দিয়ে একা হয়। যেন চৌদ্দ বছরের কিশোরী বয়সে ফিরে গেছে মুর্শিদা। চৌদ্দ বছর বয়সে যখন প্রথম প্রেমে পড়ে তখনও ঠিক এভাবেই বাবার ফোন চুরি করতে হতো। আজও একইভাবে চুরি করছে শাওনের মোবাইল। একইরকম হৃদস্পন্দন আছে। বুক ধুকপুক অবস্থা আছে। আছে বিস্তর ফারাক। তখন চুরি করতো নিজে প্রেম করতে। আজ চুরি করতে হচ্ছে আরেকজনের গোপন প্রেম ধরার জন্য।
ড্রয়িংরুমে গিয়ে মুর্শিদা মোবাইলের লকটা খুলে নেয় সাবধানে। অমনি মোবাইলটি ফোঁস করে ওঠে সাপের মতো। সাপের মতোই তো। মুর্শিদার খলবলানি সংসার বিষাক্ত করে তুলেছে ওই মোবাইলটি। মুর্শিদা মোটেও সন্দেহপ্রবণ মেয়ে নয়। শাওনের রাত করে বাসায় ফেরা, মেয়ে কলিগদের নিয়ে আড্ডাবাজির রসালো গল্প, এমনকি অতীত নিয়েও আজ অবধি কোনো কথা তুলেনি সে। ভালোবাসার বিয়ে না হলেও তাদের মধ্যে বোঝাপড়ার কমতি নেই। বিয়ের আগে পারস্পরিক জানাশোনার জন্য একাধিক ডেটিং হয়েছে। তখনই অতীত চুকিয়ে নিয়েছে দু’জনে। এতগুলো বসন্ত যেভাবে-সেভাবে কাটতেই পারে। সেগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে বর্তমানকে বর্ষার আকাশের মতো মেঘাচ্ছন্ন করার মানে হয় না। তাছাড়া দু’জনই যথেষ্ঠ উদার ও সুবিবেচক। একজন আরেকজনের মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করার মতো ব্যাকডেটেডও নয়। শাওনের অনুপস্থিতিতে তার একটা ফোনকল কখনো রিসিভ করেছে বলেও মনে পড়ে না মুর্শিদার। শাওনের ভেতরও এমন সন্দেহজনক কিছু আগে কখনো দেখেনি। ইদানীং মোবাইলটির প্রতি শাওনের আহ্লাদ দেখে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। কী এমন আছে ওই মোবাইলে! যে কারণে এমন দরদ; ভেবে পায় না মুর্শিদা। এতদিন অল্প আয়ের সংসারে টানাটানির দোহাই দিয়ে এসেছে শাওন। মুর্শিদাও ভালো মোবাইল কেনার কথা বললেও তেমন জোর করেনি। চড়া দামের বাজারে টিকে থাকাই যেখানে কষ্টসাধ্য ভালো মোবাইল দিয়ে কী হবে; ভেবে সান্তনা নিয়েছে। আবার চাইলেই তো যেনতেনভাবে চলা যায় না। ন্যূনতম একটা স্ট্যাটাস রক্ষা করে চলতে হয়। শাওনের হাতে এমন মোবাইল এখন মানায় না। কোনো অনুষ্ঠান বা পার্টিতে গেলে নিজেকে ছোট মনে হয় মুর্শিদার। পাঁচ বছর আগের ভার্সনওয়ালা মোবাইল দিয়ে কথা বলার বাইরে আর কিছুই করা যায় না। শাওনের অফিসের সহকর্মীরা পর্যন্ত মোবাইলটা নিয়ে ট্রল করে। শাওনের মুখেই এসব শুনেছে মুর্শিদা। শাওন এসব কৌতুক হিসেবেই দেখে; মজার সঙ্গে এসে বর্ণনা করে মুর্শিদার কাছে। কিন্তু মুর্শিদার তো হৃদয়টা ভেঙে যায়। ইচ্ছে হয়- পুরনো ফোনটা ফেলে দিয়ে একটা লেটেস্ট ব্র্যান্ড এর মোবাইল কিনে দিতে। কিন্তু সে সাধ্য তো মুর্শিদার নেই। যা করার শাওনের অল্প আয়ের ভেতর থেকেই করতে হবে। শাওনকে বলে বুঝিয়ে ‘আমরা দু’তিন মাস একদিনও বাইরে খাব না। কোথাও ঘুরতে যাব না। ওই টাকা জমিয়ে একটা ভালো ফোন কিনে নিও।’ শাওন সেকথা কানে তোলে কিনা বোঝা যায় না। হুট করেই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে। হয়তো ওরও ইচ্ছে হয় একটা নতুন, ভালো মোবাইল চালাতে। কিন্তু অসহায়ত্ব ঢাকতে প্রসঙ্গ পাল্টায়। মুর্শিদাও তিক্ত বিষয়টিতে পড়ে থাকতে চায় না। কিন্তু ঘুরেফিরে বিষয়টা হৃদয়ে বিঁধতে থাকে। শেষে মুর্শিদার ইতালি প্রবাসী বড় ভাইকে বলেছে শাওনের জন্য একটা মোবাইল পাঠাতে। পাঠিয়েছেও সময়ের সেরা ব্র্যান্ডের একটি মোবাইল। মুর্শিদার খুবই পছন্দ হয়েছে মোবাইলটি। বাবার বাসা থেকে এনে লুকিয়ে রেখেছে। শাওনকে অফিস থেকে দ্রুত আসতে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে রেখেছে। শাওনের পছন্দের খাবার রান্না করেছে। দিনটিকে আনন্দঘন করে তোলার সব চেষ্টাই চালিয়েছে সাধ্যমতো। শাওনকে সারপ্রাইজ দিবে বলে মনে মনে সাজিয়েছে কত পরিকল্পনা। নাটকীয় কায়দায় শাওনের হাতে ফোনটা তুলে দিবে মুর্শিদা। আগে ফোন দিবে, নাকি আগে খাওয়া দাওয়া করে তারপর ফোন হাতে তুলে দেবে? প্রথমে কী বলবে? মোবাইলটি দেখার পর শাওনের এক্সপ্রেশনই বা কেমন হবে? কী বলবে শাওন? এমন নানা ভাবনার ভেতর দিয়ে কয়েকবার মনে মনে স্ক্রিপ্ট করেছে আর কেটেছে। আবার ভেবেছে এত নাটকীয়তার দরকার নেই; সরাসরিই মোবাইলটা শাওনের হাতে তুলে দিবে। শাওনই আনন্দে মুহূর্তটাকে আলোকিত করে তুলবে নিশ্চয়। সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে মুর্শিদাকেই শেষ পর্যন্ত সারপ্রাইজড করে দিল শাওন। এক কথায় প্রত্যাখান করলো এমন ফোনটি!
কেউ কিছু দিলে এভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হয়? তাছাড়া পর তো কেউ নয়। ভাইয়ার প্রতি তোমার কোনো অভিমান আছে বলেও আমার জানা নেই। তবে কেন এই প্রত্যাখ্যান? বলে মুর্শিদা।
শাওন নিরস গলায় বললো ‘এই ফোনটা নিয়েই ভালো আছি। পাঁচ বছর ধরে ওর সাধ্যমতো আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে ঔদার্যতার সঙ্গে। অনেক সুখ-দুঃখের সাক্ষী ও একাই। নিজেও এনে দিয়েছে অনেক সুখের সংবাদ। দুঃসময়েও পাশে থেকেছে। তাকে ফেলে নতুন ফোন নিতে ইচ্ছে হয় না।’
বাকরুদ্ধ হয়ে যায় মুর্শিদা। এমন আজগুবি কথা শোনার পর আর কী-ই বা বলার থাকতে পারে; ভেবে পায় না মুর্শিদা। কিছু ভেবে না পেলেও ভাবনাটা পিছু ছাড়ে না। এটা-সেটা নানা ভাবনার খই ফোটে মনের ভেতর। বেশিরভাগই কু-ভাবনা। সেই ভাবনা বড় হতে হতে অজগরে পরিণত হয়েছে। রাত-দিন ছোবল মারে মুর্শিদাকে। বিষাক্ত করে তোলে চঞ্চল, চপল আনন্দপ্রিয় মানুষটিকে। সেই বিষের নীল শাওনের দৃষ্টিও এড়ায় না। তবে কোনো রাঁ নেই।
‘যেন কিছুই হয়নি। কোনো পরিবর্তন ঘটেনি তাদের সংসারে। যা হয়েছে তাই হওয়ার কথা ছিল। অথবা শাওন আগে থেকেই জানতো অথবা চাইতো এমন হোক। মুর্শিদার চঞ্চলতা যেন এতদিন চিরতাপানির মতো গিলেছে শাওন। এতদিনে মুর্শিদার নির্লিপ্ততা তাকে স্বস্তি এনে দিয়েছে। এসব ভেবেও মন খারাপ হয় ইদানীং। আরো জমাট বেঁধে শক্ত পাথর হয়।
‘অথচ শাওন চাইলেই রোমান্টিক ভঙ্গিতে সে অভিমান ভাঙিয়ে ক্ষীর বানাতে পারতো। তরল নয়; তবে শক্তও নয়। নরম রঙিন ক্ষীর মিষ্টি সুভাস ছড়াতে পারতো। তবে কি মুর্শিদার চেয়ে ওই ফোনটাই শাওনের কাছে বেশি প্রিয়?’ প্রশ্নগুলোয় বিদ্ধ হয় মুর্শিদা প্রতিদিন হাজারবার। সেই যন্ত্রণা নিয়েই শাওনের ফোন চুরি করে ঘেঁটে দেখা। না; তেমন কিছু পাওয়া যায় না। অন্য কোথাও প্রেম আছে বা গোপন কিছু আছে বলেও মনে হয় না। ফেসবুক, মেসেঞ্জার সবই লগইন করা থাকায় সব ঘেঁটে দেখতে সুবিধে হয় মুর্শিদার। কোথাও কোনো সন্দেহ করা যায় এমন কিছুও নেই। তারপরও সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে, শাওন নিশ্চয় সাবধানে সব ডিলিট করে বা লুকিয়ে রাখে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক কিছুই অনিচ্ছায় করতে হয়। অনেকের সঙ্গে না চাইলেও কথা বলতে হয়। নিজ থেকে কাউকে নক না করলেও কেউ তো অবশ্যই করে। সেগুলো তো থাকবে। সেসব কিছুও নেই শাওনের মোবাইলে। হুট করে বন্ধ হয়ে যায় মোবাইলটি। চেষ্টা করেও চালু করতে পারে না। চার্জে বসিয়ে, ব্যটারি খুলে, ফের লাগিয়ে চেষ্টা করে বার কয়েক। কিছুতেই কাজ হয় না। চুপি চুপি আবার শাওনের বালিশের নিচে গুঁজে রাখে মোবাইলটি। ধরা পড়ার ভয়ে ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটে মুর্শিদার। ধরা পড়লে শাওন তেমন কিছু বলবে এমন নয়। তবে কী ভাববে এটা ভেবেই খারাপ লাগছে। সঙ্কোচ থেকেই সকালে শাওনকে কিছুটা এড়িয়ে চলে মুর্শিদা। শাওনের ভেতরও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। কয়েকদিন ধরেই এমন চলছে। শাওন যেন মুর্শিদার দিকে খেয়ালই করছে না সেভাবে; এই ভেবে মনটা আরো একটু ভারি করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় মুর্শিদা। আচমকা দুপুরে হাজির হয় শাওন। হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট। সঙ্গে দু’টি মোবাইলের বক্সও চোখ এড়ায় না মুর্শিদার।
‘অবশ্যই আমার কাছে মোবাইলটির চেয়ে আমার দেবীর গুরুত্ব অনেক বেশি। তবে কিছু কিছু ভালোবাসা থাকে শিরোনামহীন। সেগুলো সহজে কাটিয়ে ওঠা যায় না। মোবাইলটির জীবন না থাকলেও আমার দুঃসময়ে আমাকে সমর্থন দিয়েছে। তাই চাচ্ছিলাম, ওর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অন্য কোনো ফোন সঙ্গী না করি। এদিকে তোমার অভিমান গাঢ় হচ্ছিল টের পেয়ে ও নিজ থেকেই আত্মহুতি দিয়েছে গতরাতে। দেখেছ; মোবাইলটিও কত প্রেম বোঝে?’ বলে শাওন।
মোবাইলটির মৃত্যু যে মুর্শিদার হাতে হয়েছে সে বিষয়টি শাওন বুঝতে পেরেছে কিনা বোঝা যায় না। এক্ষেত্রেও সন্দেহ হয় মুর্শিদার। পরক্ষণেই মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নেয় নিজের কাছে। বুঝতে পারে, এ ক’দিনে সন্দেহের ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। সন্দেহপ্রবণতা দূর করতে বুকে টেনে নেয় শাওনকে। শক্ত করে জড়িয়ে নেয়। একাকার হয়ে যায় দু’জন। যেন সন্দেহের বাতাস প্রবেশের বিন্দুমাত্র ফাঁকা না থাকে।
রনি রেজা: কথাশিল্পী ও সাংবাদিক
সান নিউজ/সালি