শিল্প ও সাহিত্য
জাপানের গল্প-৩০

মায়ের মৃত্যু অতঃপর করোনা মহামারি

পি আর প্ল্যাসিড: জাপানে মিতুলের প্রবাস জীবনের ত্রিশ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এজন্য মিতুল তার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে, তার বাবা এক বছর আগে প্রয়াত হবার পর তার মা একা গ্রামের বাড়িতে থেকে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছেন। তাই তার মাকে শেষ বারের মতো আরো একবার জাপান এনে ঘুরিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

মিতুলের স্ত্রী মিতুলের কথা শুনে প্রথম বলল, এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু মাকে নিয়ে তো সমস্যা আমার একটাই, এটা খাবে না, সেটা খাবে না, ভালো কিছুর আয়োজন করলে একদম খেতে চায় না। এতো বাছাবাছি করে খায় যে, নিজের কাছেই খারাপ লাগে। মনে হয় আমার খাবার যেন পছন্দ করে না।

বলার পর মিতুল তার স্ত্রীকে বলল, চলো আমরা আগে দেশে গিয়ে ঘুরে আসি। দেশে গিয়ে মাকে নিয়ে দেশেই কিছুদিন বেড়িয়ে আসা যাক। এরপর না হয় মা জাপান আসলো। বলে তারা দু’জন দেশে যাবার জন্য দিন তারিখ সব ঠিক করে অগ্রিম টিকিটও কেটে ফেলে।

মিতুলের ইচ্ছে তার বুড়ো মাকে এ বছর কোন কিছু না বলে সরাসরি বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হবে। যাতে মা তাদের দেখে অবাক হন। মনে মনে তারা দু’জন এমন পরিকল্পনা নিয়ে সব কিছু গোছাচ্ছে। তাড়া যেহেতু বই মেলা সামনে তাই এ সময় দেশে গেলে বই মেলাটাও করে আসতে পারবে। এক কাজে দুই কাজ।

মিতুলের চিন্তা দেশে গেলে গ্রামের বাড়িতে মায়ের সাথে সময় কাটালেও প্রতিদিন গ্রাম থেকে ঢাকা আসা যাওয়া করে বই মেলা করতে পারবে। লেখালেখি করার কারণে দেশে তার কিছু ভক্ত তৈরি হয়েছে। ফেসবুকে তাদের সাথে মাঝে মধ্যে কথা বা চ্যাট করা হয়। তারা প্রায়ই বলে, মেলায় উপস্থিত থাকলে তারা বই মেলায় এসে মিতুলের বই কিনে তার অটোগ্রাফ নিবে। তাই ভক্তদের কথা মাথায় রেখেই মিতুল দেশে যাবার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।

দেশে যাবার কয়েকদিন আগে দেশ থেকে হঠাৎ করেই মিতুলের কাছে ম্যাসেজ আসে, গ্রামের বাড়িতে যোগাযোগ করার জন্য। মিতুলের মায়ের অবস্থা খুব বেশি ভালো না। আত্মীয়-স্বজন যারা ঢাকা থাকে তাদের সকলেই মাকে শেষ দেখা দেখবার জন্য বাড়ি যাচ্ছে। ম্যাসেজ পাঠায় তারই এক আত্মীয়। ম্যাসেজ পেয়েই মিতুল যোগাযোগ করে তার বড় ভাই বোনদের সাথে। সবার সেই একই কথা। মায়ের কন্ডিশন দেখে মনে হচ্ছে আজ রাতের মধ্যেই বিদায় নিতে পারেন। এ কথা শুনেই মিতুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

মিতুল ছিল বাইরে এক কফি হাউজে। সেখানে বসে কম্পিউটারে মন দিয়ে নিজের কাজ করছিল। হঠাৎ করেই মিতুলকে কাঁদতে দেখে পাশের এক লোক উঠে এসে মিতুলের কাছে জানতে চাইলেন তার কি শরীর খারাপ করেছে কিনা। ডাক্তার বা পুলিশ কল করে এ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলবে কিনা।

লোকটির কথা শুনে সে ইশারায় বলতে চাইলো, না, তার কোন কিছুই হয়নি। কান্নার কারণে মুখে আর কিছু বলতে পারে না মিতুল। লোকটির কথায় সে তখন আরো আবেগে জড়িয়ে যায়। সেই অবস্থায়ই বাসায় ফোন করে মিতুল তার স্ত্রীকে। কাঁদো কাঁদো ভাবে জানালো দেশ থেকে ম্যাসেজ এসেছে। মায়ের অবস্থা শংকটাপন্ন। মিতুলের স্ত্রী জানে, মিতুল যে তার মা বলতে পাগল। মাকে ছাড়া যেন অন্য আর কিছু বোঝে না সে।

একবার মিতুল তার নিজের শরীর খারাপ হলে হসপিটালে যাবে, সব প্রস্তুতি নেওয়া শেষ। বলা যায় খুব সিরিয়াস অবস্থা ছিল তার। হসপিটালে যাবার জন্য ঘর থেকে বের হবে এ সময় দেশ থেকে সংবাদ এলো তার মা অসুস্থ। মাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। টাকা নেই, টাকার ব্যবস্থা সেদিনই করতে হবে। মিতুল সেদিন আর নিজের জন্য হসপিটালে যায় নি। নিজের জন্য আলাদা করে তুলে রাখা টাকা মায়ের চিকিৎসার জন্য সাথে সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে দেশে। এসব কারণেই মিতুলের বিষয়টি অন্যভাবে নেয় তার স্ত্রী। মায়ের কথা শুনে মিতুলের স্ত্রী বলল, তুমি যেখানেই থাক, জলদি করে বাসায় চলে আসো।

মিতুল তাড়াতাড়ি করে সব গুছিয়ে তখনই বাসায় চলে আসে। বাসায় এসে স্ত্রীর সাথে আলোচনা করে যার মাধ্যমে টিকিট কেটেছিল তার সাথে যোগাযোগ করে কোন ভাবে টিকিটের তারিখ দুইদিন এগিয়ে আনার ব্যবস্থা করা যায় কিনা, পারলে তাই করবে। আলোচনা করে সেই লোকের সাথে যোগাযোগ করে মিতুল।

তখন সেই লোক তার টিকিট কাটার পদ্ধতি নিয়ে অনেক কিছু বুঝিয়ে বলল, এটা পরিবর্তন করা সম্ভব না। নির্ধারিত তারিখের আগে দেশে যেতে চাইলে তাকে এই টিকিট ক্যানসেলই করতে হবে। ক্যানসেল করার পর নতুন করে টিকিট কাটতে হবে। তাতেও টিকিট পাওয়া যাবে কিনা এখনই ঠিক বলতে পারে না সে। তাই কথা শেষ করে নেটে টিকিট কাটার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু রাত বেশি হয়ে যাওয়ায় তখন আর কোন কিছু করা সম্ভব হবে না বলে লোকটি পরের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে মিতুলকে।

গভীর রাত পর্যন্ত মিতুল তার স্ত্রীর সাথে আলোচনা করে, দরকার হয় সে একা আগে চলে যাবে। দুইদিন পর মিতুলের স্ত্রী যাবে। কিন্তু রাত বারটার দিকে সংবাদ আসে মিতুলের মা আর নেই। এই কথা শোনার পর মিতুল স্তব্ধ হয়ে যায়। কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশেরও যেন তার মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই তখন। বুকের মধ্যে কেউ যেন ভারী পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। চিৎকার করে কাঁদতেও পারে না।

পাশে তার স্ত্রী সবে ঘুমের জন্য চুপ হয়ে শোয়। এতোক্ষণ সময় মিতুলকে সান্ত্বনা দিতে তার সাথে কথা বলে জেগে ছিল। যেই ঘুমের জন্য পাশে বালিশে মাথা রেখে ঘুমানের চেষ্টা করে, অমনি মিতুল মা আ আ আ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। মিতুলের চিৎকার শুনে তার স্ত্রী লাফ দিয়ে উঠে মিতুলের পাশে এসে বসে। মিতুল তার স্ত্রীকে শুধু বলল, মা আর নেই।

মিতুলের স্ত্রী মিতুলকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু কি হবে তার এই ব্যর্থ সান্ত্বনায়। শত কষ্টেও মিতুল তার মাকে প্রতিদিন স্মরণ করে। সারাদিন যত ব্যস্তই থাকুক না কেনো, রাতে ঘুমানোর আগে একবার হলেও মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু সময় ধ্যান করে। এটা তার অভ্যাস। অনেক বছর ধরে পড়ার টেবিলের সামনে মায়ের ছবি বড় করে সাজিয়ে রেখেছে।

মিতুল সবসময় তার স্ত্রীকে বলতো, এই মা-ই আমার স্বর্গ। সৃষ্টিকর্তার পরেই মা। মিতুল বলল, এই পৃথিবীর স্বর্গ আমার আর নেই। পরকালে চলে গেছে। সেখানে গিয়ে আমাদের আর কখনো দেখা হবে কিনা কে জানে।

পরের দিন অফিসের সময় হলে, টিকিটের বিষয় আলোচনা করে আগের দিনের সেই লোকের সাথে। টিকিটের দাম বলা হয় প্রায় তিন হাজার ডলারের কাছাকাছি। আগে কেনা টিকিট বাতিল হয়ে যাবে, তাই নতুন করে ইমার্জেন্সি টিকিট কেটে তবেই যেতে হবে। এছাড়া বিকল্প আর কোনো পথ খোলা নেই তার আর। মিতুল টিকিটের দাম শোনার পর সব হিসেব করে দেখে এখন গিয়ে আর যেহেতু মাকে জীবিত পাচ্ছে না তাই দুইদিন পরে যাওয়াই ভালো। আর তাই করবে তারা।

মিতুল শান্ত হয়। বাড়িতে যোগাযোগ করে বলে মায়ের লাশ কোথাও রাখার ব্যবস্থা করতে। যদি সে পারে তাহলে এর মধ্যে আসবে। এসে নিজেরা সব ব্যবস্থা করবে। মিতুলের কথা অনুযায়ী বাড়িতে মিতুলের মায়ের লাশ দুইদিনের জন্য হিমাগারে রাখার ব্যবস্থা করা হয়।

এতে নানা জন তাকে নানা কথা বলতে থাকে। যখন মিতুল সামাজিকতার কথা ভাবে তখন আবার মত পাল্টিয়ে লাশ হিমাগারে না রেখে তাদের মতো করেই কবর দেবার কথা জানিয়ে বলে তারা আগের নির্ধারিত তারিখেই আসবে দেশে। অবশেষে মিতুলের মার লাশ ঢাকা হিমাগার থেকে নিয়ে গ্রামে বাড়ির পাশে কবরস্থানে কবরস্থ করা হয়।

মায়ের মৃতদেহ কবরস্থ করার দুইদিন পর মিতুল তার স্ত্রীকে নিয়ে দেশের উদ্দেশে রওনা দেয়। রওনা দেবার প্রাক্কালে মিতুল জাপানে করোনাভাইরাস সম্পর্কে বিভিন্ন মিডিয়ায় জানতে পায়। এর আগে এই করোনা সম্পর্কে এতোটা না জানার কারণে সে সিরিয়াস ছিল না।

এমনকি করোনা ভাইরাস এবং এর ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে সকল যাত্রীদের সতর্কতাবস্থা পালনের জন্য এয়ারপোর্টে অনুরোধ করা হয়। সে সাথে সকল যাত্রীকে ভালোভাবে স্যানিটাইজেশন করার কথা বলে দেওয়া হয়। সাথে মুখে বাধ্যতা মূলক ভাবে মাস্ক ব্যবহার করার নির্দেশও দেয়। মিতুলের কাছে বিষয়টি বিরক্তিকর মনে হলেও সার্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করে, সকল নিয়ম নীতি মেনেই নারিতা এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের যাবতীয় করনীয় সম্পন্ন করে বিমানে চড়ার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

নারিতা থেকে শরীরের তাপমাত্রা মেপে দুই হাতে স্পিরিট জাতীয় তরল পদার্থ লাগায়। সেই তরল পদার্থ দিয়ে হাত পরিষ্কার করার পর মুখে মাস্ক লাগায়। মাস্ক লাগিয়ে বিমানে গিয়ে তারা বসে। একটু পর বিমান আকাশে উড়াল দেয়। মূহুর্তের মেঘমালা ভেদ করে নীল আকাশে উড়তে থাকে তাদের উড়োজাহাজ।

একসময় ব্যাংকক এয়ারপোর্টে গিয়ে বিমান অবতরণ করে। সেখানে তাদের ট্রানজিট থাকায় সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে আবার ইমিগ্রেশনের সীমা পার হয়ে ভিতরে গিয়ে বসে তারা। কিছু সময়ের জন্য সেখানে মোবাইলে নেট কানেকশন দিয়ে ঢাকা আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করে মিতুল। অপেক্ষা আর বেশি সময় করতে হয় না। আবার একই ভাবে গিয়ে বিমানে বসে। সময় হলে বিমান আবার আকাশে উড়ে। সেখান থেকে ঢাকা এয়ারপোর্ট গিয়ে পৌছায়।

ঢাকা বিমানবন্দরে পৌছালে তাদের ইমিগ্রেশন পার হবার আগেই আবার আটকানো হয়। মিতুল এতে অবাক হলেও বাধ্য হয় তাদের কথা অনুযায়ী কাজ ধাপে ধাপে সম্পন্ন করে সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা বাঁধে তার জাপানি বধূকে নিয়ে। তাকে ধরে তার সকল ডাটা একটা ফরমে লিখতে বলে।

অন্যান্য যাত্রীদের থেকে মিতুল আর মিতুলের স্ত্রীকে বেশি করে জেরা করতে শুরু করে সেখানে। মিতুলের স্ত্রীকে একটা ফরম ফিলাপ করতে দিলে তা পূরণ করে সেখানে জমা দেবার পরেও বারবার প্রশ্ন করা হয় তাদের, তারা কোন দেশ থেকে ভ্রমণ করছে। মিতুলের স্ত্রীর বিষয় জানতে চাওয়া হয়, সে কোন দেশের নাগরিক?

মিতুল যতোই বলে তার স্ত্রী একজন জাপানি, তারা জাপানের নারিতা এয়ারপোর্ট থেকে এসেছে, তার পাসপোর্ট লাল এবং ন্যাশনালিটি জাপানি লেখা রয়েছে, তারপরেও তারা বলতে থাকে যাত্রী একজন চাইনিজ অর্থাৎ চীনের নাগরিক। এটা নিয়ে মিতুলের সাথে বেশ কয়েক দফায় তর্ক হয় ঢাকা এয়ারপোর্টে কর্মরত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে।

অবশেষে ঢাকার একটি টিভি চ্যানেল, ৭১ টিভি-এর একজন সংবাদ কর্মী তাদের সামনে এসে ক্যামেরা অন করে চেহারা ভিডিও করে আর কথা বলে তাদের সাথে। মিতুল সেখানেও খুব স্পষ্ট করে বলে যে তার স্ত্রী একজন জাপানি নাগরিক, তারপরেও সংবাদ প্রচারের সময় তাদের চেহারা দেখানো হয় আর বলা হয় তারা চায়নার নাগরিক। চায়না থেকে দেশে প্রবেশ করেছে। এ কারণে তাদের বিশেষভাবে করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।

দেশের সংবাদ মাধ্যমে তাদের নিয়ে এমন মিথ্যা তথ্য প্রচারে মিতুল মনে মনে ক্ষিপ্ত হলেও কিছু আর বলে না। না বলার কারণ তার মায়ের মৃত্যুতে তার মন খারাপ হয় সেখানে। পরের দিন জাপান থেকে মিতুলের পরিচিত অনেকেই তার ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারে নিউজের ফুটেজ পাঠায়। পাঠিয়ে বলে টিভিতে তাদের অনেকবারই দেখানো হয়েছে। এটা তার প্রমাণ। নিউজের ফুটেজ মিতুল তার স্ত্রীকে দেখালে সে অনেকটা বিরক্ত এবং মনক্ষুন্নই হয়ে বলে মিতুলকে প্রতিবাদ করতে কিন্তু মিতুল মায়ের মৃত্যুর কারণে শোকার্ত থাকায় চেপে যায় বিষয়টি।

সেদিন বেশি দেরি হওয়ায় মিতুল তার স্ত্রীকে নিয়ে আর গ্রামের বাড়ি যায়নি। পরেরদিন তার এক বোনকে নিয়ে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে যায়। গ্রামে গিয়ে বাড়িতে যাবার আগে প্রথমেই যায় কবরস্থানে। সেখানে বাবা মা-র কবরের পাশে দাঁড়িয়ে প্রার্থণা করে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে।

এরপর কবরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়। কবরস্থানে বাবা-মার আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থণা করে বাড়িতে যায়। বাড়িতে গিয়ে সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে কয়েকদিন বাড়িতে থেকে সামাজিকতা যা করণীয় ছিল তা করে আবার ঢাকা ফিরে আসে।

মিতুল এবং তার স্ত্রীর একই দিনে আবার জাপান ফিরে আসার কথা। কিন্তু কয়েকদিন পর বাইশে ফেব্রুয়ারি মিতুলের স্ত্রীকে তার টিকিটের মেয়াদ অনুযায়ী পাঠিয়ে দেয় জাপান। মিতুল কিছুদিনের জন্য একা থেকে যায় দেশে। দেশে তার কিছু কাজ করা বাকি ছিল, তাই। কাজগুলো সেরেই সে চলে যাবে আবার জাপান, এই ছিলো তার পরিকল্পনা।

মিতুল তার স্ত্রীকে বিদায় জানিয়ে বাসায় ফিরে যায়। বাসায় গিয়ে বিছানায় শুয়ে রেস্ট করছিল, এমন সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে টেলিফোন কল আসে মিতুলের মোবাইল নাম্বারে। কল করে মিস খামিজোর স্বাস্থ্যের কোন পরিবর্তন বা সমস্যা হয়েছে কিনা তা জানতে চায়। ফোন করে প্রথমই প্রশ্ন করে, আপনার সাথে যে একজন চাইনিজ মহিলা এসেছেন, তার স্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন? কোন সমস্যা হয়নি তো?

তখনও তারা বলছে মিস খামিজো একজন চায়নিজ নাগরিক। বিষয়টি মিতুল শুনে তখন তাদের কিছুটা ধমক দিয়ে বলল, আপনারা কোথায় পেলেন যে মিস খামিজো একজন চায়নার নাগরিক? এতোবার করে বলার পরেও আপনারা এটাকে মিথ্যা প্রচার করছেন এতে আপনাদের লাভ কী? আপনাদের যদি কোনো লাভ থাকে তাহলে বলবেন কী খুলে আমাকে? আর তা-ই যদি না হয় তা হলে এজন্য ক্ষমা চাইতে হবে পাবলিকলি। বলে মিতুল রাগ করে ফোন রেখে দেয়।

তার কিছুদিন পর মিতুল জাপান চলে আসে। জাপান এসে পৌঁছায় পহেলা মার্চ। এসে দেখে করোনার কারণে তার কর্মস্থল বন্ধ। কবে খোলা হবে তার কর্মস্থল সে বিষয়ে কেউ কোনো কিছু বলতে পারে না তাকে। বলা হয় খুব জরুরি কোন কাজ না থাকলে বাসার বাইরে না যাবার জন্য।

তাছাড়া জাপানের বাইরে থেকে এসেছে তাই তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য কিছুদিন বাসায়ই থাকতে হবে। এরপর যে মিতুল বাসায় বসেছে এখন পর্যন্ত বাসায়ই বসা। কবে যে সে তার আগের কর্মক্ষেত্রে যোগ দিবে সে নিজেও কিছু বলতে পারেনা। যা-ও আগে টেলিভিশনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ব্যস্ততাও নেই এখন আর।

ঘরে বসে শুরু করে অনলাইনে সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে আড্ডা দেওয়া, সারা পৃথিবীর করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা, বই পড়া আরো যতো কিছু আছে সব করে সে ঘরে বসেই। প্রতিদিন তার সময় চলে যায় নানা জনের সাথে এই আলোচনা আর খোশ গল্প করে। মাঝে মধ্যে পত্রিকায়ও লেখা পাঠায় জাপানে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে।

এভাবেই অবসর সময় কাটে মিতুলের। ইনকাম তার স্থগিত। সরকার ঘোষণা দেয় জাপানে সকল নাগরিকদের ডেমারেজ দেওয়া হবে। এটা শুনেই যেন মিতুলের গলায় পানি আসে। সরকারি ডেমারেজের আশ্বাস, বিশ্বাস করে দিন কাটায় অদৃশ্য ভাইরাস করোনা বা কোভিড - নাইনটিন থেকে সতর্ক থাকার জন্য।

একসময় নানা জন অনলাইনে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করা শুরু করে দেয়। বলতে গেলে ঘরে ঘরে, জনে জনে, প্রতিদিন, প্রতি মূহুর্ত। বিষয়টি একেবারে বিরক্তিকর পর্যায় চলে যায় মিতুলের কাছে। মিতুল মনে করে সবাই যদি অনলাইনে এভাবে আলোচনা করে, তাহলে দেখবে কে? এসবের দর্শক শ্রোতার সংখ্যা তো কম। একসময় যা আছে সেটার সংখ্যাও নেই হয়ে যাবে।

আবার ভাবে, জনে জনে যেহেতু আয়োজক হয়ে গেল এবার তার এসব বন্ধ করা দরকার। মানুষ ভালোর চেয়ে এতে মনে হচ্ছে কিছুটা হলেও বিরক্ত হচ্ছে। তাই সে এসব থামিয়ে দিয়ে শুরু করে লেখালেখি। মিতুল ভাবে এটাতে তার কোনো প্রতিযোগী নেই বরং ঘরে বসে সাহিত্য চর্চা করলে তার লেখাই একসময় ভালো মানের দিকে এগোবে। তাই সে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করে পুরোদমে।

ঘরে বসে এর পর থেকে মিতুল লেখালেখি করা শুরু করে। প্রথমই শুরু করে তার জাপান আসার পর থেকে নানা ঘটনা নিয়ে জাপানের গল্প। এতে হয়ে যায় তার জাপানে প্রবাস জীবনের লেখালেখিতে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ত্রিশ। ত্রিশ তম বই প্রকাশের পর সে নিজেকে একজন লেখক ভাবতে থাকে। এটাই যেন তার প্রবাস জীবনের বড় এক সফলতা। এটাই যেন ছিলো তার জীবনের বড় চাওয়া পাওয়া।

(শেষ)

লেখক: জাপান প্রবাসী সাংবাদিক

সান নিউজ/এমকেএইচ

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

সবজির বাজারে স্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে কমেছে পেঁয়াজ, সবজি...

বড় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলেন পূজা 

বিনোদন ডেস্ক: ঢাকাই চিত্রনায়িকা ও মডেল পূজা চেরি ডজনখানেক ছব...

স্বামীকে মৃত দেখিয়ে মামলা, নারী আটক

জেলা প্রতিনিধি : সাভারের আশুলিয়ায় জীবিত স্বামীকে বৈষম্যবিরোধ...

বৈষম‌বিরোধী আন্দোলনে বেঁচে ফেরার আশা করেনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন আন্দোল&zwnj...

ইসলামী ব্যাংকের সাথে হাব-এর মতবিনিময়

নিজস্ব প্রতিবেদক: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি-এর উদ্যোগে হ...

সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি

নিজস্ব প্রতিবেদক : বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছ...

ফের বাড়ল সোনার দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বাজারে ফের সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা...

ফের হারলো সাকিবের দল

স্পোর্টস ডেস্ক : আবুধাবির টি-টেন টুর্নামেন্টে ফের হারের মুখ...

নোয়াখালীতে দুই গৃহবধূর লাশ উদ্ধার

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীতে পৃথক স্থান থেকে দুই গৃহবধূর...

ঢাকাবাসীকে নিরাপদ রাখতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকাবাসীকে যেকোনো উপায়ে নিরাপদ রাখতে হবে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা