পি আর প্ল্যাসিড: জাপানে মিতুল তার যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেছিল তার নাম দিয়েছিল বিবেক কোঃ লিঃ। একসময় সে তার ব্যক্তিগত নানা কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। জাপানে বিবেক কোম্পানীর কর্মকাণ্ড বন্ধ করলেও দেশে প্রতিনিয়ত এই বিবেক নাম ব্যবহার করে নানা কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করতেই থাকে। তার পরিকল্পনার মধ্যে বেশ কিছু সামাজিক কাজ করার পরিকল্পনা করলেও যে কয়টি প্রজেক্ট সে চালিয়ে যাচ্ছে সেগুলো হচ্ছে বাচ্চাদের স্কুল পরিচালনা, নিজে লেখালেখি করার কারণে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুরু করে। এছাড়াও নানা সময় বিবেকবার্তার ব্যানারে সে নানা কাজ নিয়মিত চালিয়ে যায় দেশে।
সম্প্রতি জাপানে সে বিবেকবার্তার পক্ষ থকে জাপানে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য কমিউনিটির কয়কেজন সামাজিক নেতৃবৃন্দকে তাদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিবেক সম্মাননা ক্রেস্ট দেবার ব্যবস্থা করে। এ উপলক্ষে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে টোকিওতে। এতে করে মিতুল বিগত দিনে তার কর্মকান্ডে যতোটা পিছিয়ে পড়েছিল এই অনুষ্ঠান করার পর সে তার বিপরীতে যেন নতুন করে কাজ করার জন্য যেমন পায় উদ্যোম, তেমনই পায় কিছু ভালো শুভাকাঙ্খীও।
তাদের সাথে কয়েক দফা আলোচনা করে দেশে একজনকে দায়িত্ব দেয় তার বিবেক মিডিয়া এন্ড পাবলিকেশন দেখা শোনার জন্য। তাকে বলা হয় এটাকে দাঁড় করাতে পারলে এটা থেকে আয়ের অংশ নিয়ে তাকে চলতে। মিতুলের এমন উদারতা দেখে সে-ই বলে তার অন্য কাজ বাদ দিয়ে বিবেক মিডিয়া এন্ড পাবলিকেশনের হয়ে মিতুলের লেখা গল্প দিয়ে দেশে টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য টেলিফিল্ম এবং ধারাবাহিক নাটকের কাজ করবে সে।
প্রতিদিন এনিয়ে তাদের আলোচনা হয়। ঢাকায় তার প্রতিনিধি প্রথম প্রথম নানা জনের গল্প শুনে সে মনেই করেছিল অনেক সহজ হবে হয়তো তার জন্য এই কাজ করা। কিন্তু যখন কাজ করা শুরু করে তখন দেখে বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। যখন কাজ শুরু করে তখন বুঝতে পারে বাস্তবতার সাথে কল্পনার তফাৎ যে কতো বেশি। তাই মন খারাপ করে ঢাকার তার সেই প্রতিনিধি। নাম তার ওয়াশিম রেজা।
রেজা যখন কাজ করার জন্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে গিয়ে প্রোগ্রাম পরিচালকদের সাথে কথা বলে তখন বুঝে যায় তার জন্য এই কাজ করা যে কতো কঠিন হবে। কয়েকদিন এই পথে হাঁটার পর মানুষের মুখের কথা আর অন্তরে ধারণ করা বিষয় বুঝতে পেরে হাল একদম ছেড়ে না দিলেও উদ্যোম যেন রেজার কমে আসতে থাকে। তার পরেও মিতুল বলল, জাপানে আমার ত্রিশ বছর থাকার পর বাংলাদেশে এই পাঁচ দশ হাজার টাকা লাভের আশায় কোন কাজ করার ইচ্ছে আমার বিন্দু মাত্র নেই।
তাছাড়া আমি যতোটা জানি এই টাকাও ঠিক মতো পাওয়া যায় না। এমনকি দশ হাজার টাকা তুলতে গিয়েও বেশ হিমশিম অবস্থা হয় প্রযোজকদের। অনেকটা একটা ছাগলের জন্য গরু হারানোর মতো অবস্থা। তাই মিতুল বলল, আমার গল্প এবং ইনভেস্টে আপনারা কয়েকজন যদি দেশে সততার সাথে কাজ করে নিজেরা চলতে পারেন বা আপনাদের সংসার চালাতে পারেন তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।
তবে আমার সাথে কাজ করতে হলে শুধু তিনটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, এক. আমার লেখা গল্প দিয়ে কাজ করতে হবে। দুই. ইনভেস্ট যেন ফেরৎ আসে। তিন. বিবেক মিডিয়া এন্ড পাবলিকেশনের নাম যেন যথাযত প্রচার হয়। এই তিনটি বিষয় ঠিক থাকলে আমার আর বেশি কোনো চাহিদা নেই।
মিতুলের এমন কথা শুনে তাকে আশ্বাস দেয় রেজা তার তিনটি শর্তই সে রক্ষা করতে পারবে। তাই আবার সে দেশে যতোগুলো টেলিভিশন চ্যানেল আছে প্রত্যেকটা টেলিভিশন চ্যানেলে গিয়ে মিতুলের গল্প দিয়ে কাজ করার কথা আলোচনা করে। এমনকি প্রস্তাবের সাথে আর যা যা লাগে সব জমা দিয়ে তার মতো দায়িত্ব নিয়ে প্রোগ্রাম পরিচালকদের সাথে নাটক, টেলিফিল্ম নির্মানের কথা বলে।
সব কিছু গুছিয়ে আনার পর এই দুর্দিনের বাজারে কোন স্পন্সর না পাওয়ার কারণে আবার কিছুটা পিছিয়ে যায় রেজা। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ঘুরে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে কথা বলার পর ব্যর্থ হলেও রেজা বলে, অল্প কিছুদিনে সে এই লাইনের কাজ সম্পর্কে কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছে।
এমন কি অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকজনদের সাথে তার সরাসরি দেখা কথা এবং পরিচয় হয়েছে। এতে তার সান্ত্বনা একটাই, সেটা হচ্ছে সবগুলো টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রাম পরিচালক অন্তত জেনে গেছেন বাংলাদেশে বিবেক নামে নতুন একটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে। এটি হচ্ছে মিতুলের ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ায় সরাসরি কাজ শুরু করার পূর্ব প্রস্তুতি।
অন্যদিকে বিবেক প্রকাশনী নিয়ে শুরু হয় তার বাল্যকালের এক বন্ধুর সাথে ভুল বোঝাবুঝি। তাকে বই প্রকাশের দায়িত্ব দিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয় মিতুলের, তাতে সে মনে করে, যার যে কাজ নয় তাকে দিয়ে সেই কাজ করানোর পরিকল্পনা মোটেও ঠিক নয়। যা শুরু করেছিল মিতুল দেশে।
কয়েকবার মিতুল কাজের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যখন দেখে যে, যা সেই তার বন্ধু বোঝে না সে এমন ভাব দেখায় যে সবই যেন জানে সে বা বোঝে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় যে, বন্ধুটি তার সাথে অনেক মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করে নানা কারণে। মিতুল একসময় তার বন্ধুটির নানা অব্যবসায়িক মনোভাবের কারণে মত পাল্টায়।
এমনকি তার অবুঝ মানুষের মতো আচরণ দেখে নিজে মনে করে, আমার কিছু টাকা যদি লসও হয় বা আর্থিক ক্ষতিও হয়, তবুও আর তার সাথে কোন নেগোশিয়েট না করেই পাবলিকেশনের কাজ বন্ধ করে দিবে। তাই নিজেই নিজের এই কাজ করতে প্রস্তুতি নেয় পরবর্তীতে নতুন করে।
পাশাপাশি মিতুল একসময় টাঙ্গাইল মধুপুর এলাকায় ঘুরতে গিয়ে পরিচিত হয় গারো সম্প্রদায়ের কিছু লোকের সাথে। সেখানে সে গিয়েছিল তার পুরোনো এক বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। গিয়ে সেখানকার জায়গা এবং পরিবেশ পারিপার্শ্বিতার কাছে অনেক ভালো লাগে। তাই পুরোনো সেই বান্ধবীকে একটা দোকান ভাড়া নিয়ে দেবার কথা বলে মিতুল।
বান্ধবীকে দোকান ভাড়া করে দেবার আগে শর্ত দেয় যে, দোকানের নাম করণ করা হবে ‘বিবেক’। দোকানের মালিক থাকবে মিতুল আর দেখাশোনা করবে তার সেই বান্ধবী লিপি। তাই দোকানের যা লাভ হবে সেটা দু’জনে ভাগাভাগি করে নেবার কথা বলা হয়।
মিতুল ভাবে টাঙ্গাইলের এই দোকান চালিয়ে যদি কিছু টাকা লাভ হয় আর সেই লাভ দিয়ে যদি প্রতিবছর মিতুল দেশে আসা যাওয়ার মতো খরচ উঠাতে পারে তাহলে তার আর অন্য কিছু বলার থাকবে না বলে মিতুল লিপিকে জানায়। বাকি সব তার পুরোনো বান্ধবী লিপিকে নিয়ে নেবার কথা বলে। লিপি সেটাতে রাজি হয় না।
লিপি বলল, আমাকে তুমি আমার পারিশ্রমিক দিলেই হবে। আমি তোমার হয়ে এখানে সব দেখা শোনা করতে পারবো। তবে তুমি মাঝে মধ্যে দেশে এসে আমার বাড়িতে বেড়ালেই চলবে। সেই প্রস্তাবনা থেকে তাদের আরো কিছু পরিকল্পনা মাথায় আসে পরবর্তীতে, যা নিয়ে কাজ করার কথা ভাবতে শুরু করে মিতুল।
মিতুল প্রস্তাব দেয় সেই দোকানে গারোদের বিশেষ ছবি সংবলিত টি-শার্ট, গারোদের তৈরি গামছা, পাঞ্জাবী, লুঙ্গি, শাড়ি পাশাপাশি বিবেক মিডিয়ার বইও রাখা যেতে পারে এই দোকানে। এমনকি এই দোকানের কিছু পণ্য সে জাপানে এনে বিক্রি করতে পারবে। দোকানের এই ব্যবসা ভালো চললে বা লাভবান হয়ে এ থেকে পরবর্তীতে গারোদের মাঝে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প চালু করার কথা হয়।
লিপি তার সাথে ক্ষুদ্র ঋণ দেবার বিষয় চূড়ান্ত কোনো কিছু আলোচনা না করেই তার এলাকার মানুষদের কথা দিয়ে দেয় সে তাদেরকে মিতুলের হয়ে টাকা ঋণ দিবে। মিতুল এর মধ্যে লিপির সাথে নানা কাজে জড়িয়ে যাবার কারণে এবং সে তার কথা ঠিক রাখার জন্য অনেকটা বাধ্য হয়েই কয়েক পরিবারকে টাকা ঋণ দিয়ে ব্যবসায়িক কাজ চালিয়ে নিতে সাহায্য করে।
লিপিকে বলা হয়েছিল, মিতুল দেশে যাবে। দেশে গিয়ে সরাসরি তার এলাকার লোকদের সাথে কথা বলবে এরপর পরিবেশ পরিস্থিতি এবং তাদের মনমানসিকতা বুঝে কয়েকজন অভিজ্ঞ লোকের সাথে কথা বলবে। তারা যদি মিতুলকে এই প্রজেক্ট করতে বলে তবেই শুরু করবে সে।
মিতুল এটাও বলে যে, দেশে তার পরিচিত এবং অভিজ্ঞরা যদি চালাতে বলে এই ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প তাহলে চালাবে না হয় বন্ধ করে দিবে। যদি চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় তাহলে এটার আইনগত বিষয় যারা ভালো বোঝে তাদের সাথে পরামর্শ করে না হয় সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। সে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আরো আলোচনা করা দরকার।
এ কথা বললে পর মিতুলের সাথে লিপি ক্ষেপে যায়। ক্ষেপে অভিমানীর মতো বলল, মিতুল একেক সময় একেক কথা বলে, তাই তার সাথে সে আর কোনো কাজ করবে না। লিপির একথা শুনে মিতুল অবাক হয়। সে পরে বলল, তুমি যে এই পর্যন্ত ঋণ দেবার নামে টাকা নিয়েছ, সেই টাকা কি তাহলে হাওয়ায় মিশে যাবে?
এ কথা বললে লিপি কিছুটা শান্ত হয়। তাই দেশে এ পর্যন্ত বিবেকের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে আবার স্থগিত করে দেয় মিতুল। সে লিপির সাথে কাজ নিয়ে কথা কাটাকাটি করার পর সর্বশেষ ভাবে অন্য কারো মাধ্যমে আর কোনো কাজ করবে না। তবে সে দেশে ফিরে গিয়ে নিজে থেকে তার গ্রামে একটি বৃদ্ধাশ্রম চালু করার কথা ভাবে।
জাপানে মিতুল তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন জাপানি বন্ধুর সাথে আলোচনা করে তার এই বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করার বিষয় নিয়ে। মিতুলের এমন সুন্দর পরিকল্পনার কথা শুনে তারা সকলেই মিতুলকে সহযোগিতা করার কথা ভাবে। এমনকি তারা একটা বড় গ্রুপ মিতুলের এই কাজে সহযোগিতা করার কথা ভেবে বেশ আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশে ঘুরতে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করে। তাদের ভাষ্য, আমরা একবার গিয়ে নিজেরা স্বচোখে দেখে আসি এরপর না হয় বৃদ্ধাশ্রমের এই পরিকল্পনা নিয়ে তারা যা ভাববার তাই ভাববে।
এদিকে লিপি তার কাজে এমন সব ঘটনা ঘটায় যা না পারে মিতুল তাকে কিছু বলতে না পারে সইতে। তবুও বিবেক নিয়ে মিতুল অনেকটা আশাবাদী। সে যখন বিবেক নাম দিয়ে তার কর্মকাণ্ড শুরু করে তখন তার প্রথম সন্তান মারা যায়। এজন্য মিতুল তার স্ত্রীকে বলেছিল, প্রয়াত সন্তানের কথা মাথায় রেখে সন্তানের বিকল্প হিসেবেই সে এই বিবেক প্রতিষ্ঠান চালাবে। এটাই হবে তার ধ্যান ধারনা আর স্বপ্ন। এটাকে মৃত্যুর আগে এক ধরনের ব্র্যান্ড হিসেবে জাপান-বাংলাদেশ দুই দেশে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে যেতে চায় মিতুল।
নানা বিষয় ভেবে মিতুল টোকিওতে একসময় বিবেক এর পক্ষ থেকে দেশের কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্য পুরস্কার দেবার কথা ঘোষণা করে। এটা এখন থেকে প্রতিবছর নতুন লেখক লেখিকাদের প্রদানের ইচ্ছে তার। এমনকি সে তার এলাকায় বিবেক স্পোর্টিং ক্লাবের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করার প্রস্তাব করে তার এলাকায়। তার এমন সুন্দর কাজের প্রস্তাবে অনেকেই তাকে সম্মতিসহ সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসতে শুরু করেন।
এমনকি তার এমন কাজে ফান্ডিং করার কথাও ভাবে। তাই বলা যায় মিতুল এখন আর কোনো ব্যক্তি নয়। মিতুল দিনদিন হয়ে উঠছে একজন প্রতিষ্ঠান স্বরূপ। এ কারণেই তাকে অনেকে বিবেক ভাই বলেও সম্বোধন করতে শুরু করেন জাপানে। দীর্ঘ ত্রিশ বছর জাপানে থেকে নানা কর্মকাণ্ড করার পর এটাই যেন তার বড় প্রাপ্তি। মিতুল এখন হয়ে উঠে কারো কারো চোখে বিবেকবান, বিবেক ভাই। হয়ে উঠেন জাপানে বিবেক প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র কর্ণধার।
(চলবে)
লেখক: জাপান প্রবাসী সাংবাদিক
সান নিউজ/এমকেএইচ