পি আর প্ল্যাসিড: মিতুল মূলতঃ দেশে ছাত্র থাকা অবস্থায়ই কিছু কিছু কবিতা আর গল্প লিখেছে। এসব লেখা বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতেও প্রকাশ পেয়েছে। জাপানে এসে কাজের অবসরেও বই পড়া তার কমেনি। এটা তার পুরোনো অভ্যাস। জাপানে ট্রেন বা বাসে চড়ে বই পড়ার সুবিধা অনেক তাই জাপানে আসার পর কাজের পর বিশেষ করে ট্রেনে বসে নিয়মিত ছুটির দিনে বই পড়েছে । জাপানে বেশির ভাগ যাত্রীকেই দেখা যায় যাত্রা পথে কিছু না কিছু পড়তে। তাই এই বই পড়ার অভ্যাস যেন জাপান এসে জাপানিদের দেখে আরো বেড়ে যায় তার।
যাত্রা পথে জাপানিরা প্রচুর বই পড়ে। তাদের দেখে মিতুলের হিংসে হয়। মনে মনে ভাবে, ওদের মতো যদি বই পড়তে পারতাম, কি মজা হতো। বই পড়তে চাইলে কি হবে? জাপানে বাংলা বই ততোটা পাওয়া যায় না। একটা বই কারো সংগ্রহে আছে জানলে সে দৌঁড়ে যেতো বই ধার করতে। মানুষের কাছ থেকে বই ধার নিয়ে সে তখন পড়ার চেষ্টা করতো। এরপর বই পড়ার পাশাপাশি বই লিখতেও শুরু করে এক সময়।
যখন বই লেখা শুরু করে তখন প্রতিদিন মনে যা আশে তাই লিখে রাখে মিতুল। এক সময় নিজেই মনে করে যে, না এসব দিয়ে বই করা ঠিক হবে না। এরপর জাপানে আসার পর যে কয়টি বই সে পড়েছে সেই বই গুলি পড়ার পর বইয়ের বিষয়ের সাথে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার তুলনা করে। আস্তে আস্তে তার জীবনের সেই সব ঘটনা গুলিকে গল্প বা উপন্যাসে রুপ দেবার কথা চিন্তা করে। এরপর থেকেই লেখা শুরু হয়ে যায় তার নতুন করে গল্প লেখা।
দোকান থেকে সাদা রাইটিং প্যাড এনে রাতের পর রাত লিখতে থাকে সে তার জীবনের গল্প। এভাবে লিখতে লিখতে অনেক গুলো রাইটিং প্যাড শেষ করে একটি বড় গল্প লেখা শেষ করে। লেখা শেষ হলে গল্পের নাম দেয় ‘অনুশোচনা’।
লেখার পর সে তার চেয়ে কয়েক বছরের সিনিয়র এক বড় ভাইকে সেই লেখা দেয় পড়তে। লেখাটি সে পড়ে মিতুলের লেখার বেশ প্রশংসা করে। শুধু তাই নয়, সে এমনভাবে মিতুলের লেখার প্রশংসা করে যেন, এটা দ্রুত বই হিসেবে প্রকাশ করা তার অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর বই প্রকাশ করলে যেন রাতারাতি সে হয়ে যাবে একজন খ্যাতিমান লেখক। তাকে বলা হয় আমাদের দেশের খ্যাতিমান লেখক ইমদাদুল হক মিলনের কথা। সেও এক সময় প্রবাসী ছিলেন। প্রবাসে বসে সে সাহিত্য চর্চা করেছেন। মিতুলও যেন তেমনটি করতে পারে তাই আগ্রহ যোগায় তার।
সামনে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হবে একুশে গ্রন্থ মেলা। তার আগেই দেশে কোন প্রকাশকের সাথে কথা বলে বই প্রকাশের জন্য পরামর্শ দেন সে। এরপর দু’জনে মিলে একদিন পুরো লেখাটি ধরে ধরে ফটো কপি করে। জাপানে এই ফটো কপি করাও সহজ লভ্য বিষয় নয়। তাই এই কাজটি করার জন্যই শুধু সেই লোকটিকে তার বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে। পরবর্তীতে তার একই কর্মস্থানে তাকে কাজ দেবারও ব্যবস্থা করে মিতুল।
দুইজন মিলে প্রতিদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে এসে রান্না করে খেয়ে টিভির সামনে বসে নিজেদের সাহিত্য সংস্কৃতি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা। টেলিভিশন বা ভিসিআরে হিন্দি সিনেমা দেখে যতো না সময় কাটায় তার চেয়ে বেশি সময় কাটায় মিতুল এই লেখালেখি করে। যখন লেখার বিষয়টি ফাইনাল করা হয় তখন মিতুল তার এই লেখা দেশে এক প্রকাশকের কাছে বিশেষ ডাকে পাঠিয়ে দেয়। দেশে প্রকাশক মিতুলের লেখা পাবার পর কম্পিউটারে কম্পোজ করে জাপান পাঠান পোষ্ট করে তা দেখার জন্য।
মিতুল সেটা পাবার পর ভালো করে পড়ে এরপর কারেকশন করে। কারেকশন করা হলে আবার পাঠায় বাংলাদেশে। আবার সেটা কারেকশন করে জাপানে পাঠান প্রকাশক। সামনে একুশে বই মেলা। মেলায় বই প্রকাশের আনন্দ মিতুলের চোখে মুখে। তার বই প্রকাশ হবে দেশে, তাও আবার একুশে বই মেলায়। সে লেখক হবে। এই আনন্দ সে জাপানে কারো সাথে শেয়ার করতে পারে না, এমনকি দেশেও না।
সময় খুব দ্রুত যেতে থাকে। এদিকে সে তার কর্মস্থলে ব্যস্ততার কারণে লেখা গল্পের চূড়ান্ত প্রুফ দেখে শেষ করতে পারে না। এক পৃষ্ঠা পড়লে পর দুনিয়ার চিন্তা মাথায় এসে ভর করে। পরের পৃষ্ঠা পড়ে যে সে তার গল্প এডিট করবে সেই সুযোগ নেই, সময়ও নেই। দেশ থেকে প্রকাশকের তাগাদা দিয়ে চিঠি আসে, যতো দ্রুত সম্ভব ফাইনাল প্রুফ সহ খরচ পাঠানোর জন্য।
খরচ তার আগেই দেয়া হয়ে গেছে। কিন্তু প্রকাশকের হাতে কোনো কারণে হয়তো বই প্রকাশের জন্য খরচের টাকা পৌঁছানো বাকি ছিল। তাই দেশে খবর নিয়ে অগ্রিম টাকা পরিশোধের ব্যবস্থা করলেও চূড়ান্ত প্রুফ দিতে পারে না তখনও মিতুল। তাই বাধ্য হয়ে তার রুম মেটকে দায়িত্ব দিয়ে বলল, তাকেই সব কিছু দেখে দেবার জন্য।
মিতুলের রুম মেট লেখাটি সুন্দর ভাবে এডিট করে দেশে পাঠিয়ে দেয় প্রকাশকের ঠিকানায়। তার কিছু কাল পর দেশে একুশে গ্রন্থ মেলা শুরু হয়। দেশ থেকে কয়েকজন মিতুলকে টেলিফোন করে জানায়, তার লেখা বই তারা কিনে পড়েছে। পড়ে তাদের মনে হয়েছে বইয়ের বিষয় যেন তাদের কথা দিয়েই সাজানো হয়েছে। তাদের জীবনের সাথে এতোটাই মিল রয়েছে লেখায় যে, মনেই হবে তাদের নিয়ে লেখা তার এই ‘অনুশোচনা’ গল্প।
মিতুলের প্রথম প্রকাশিত বই সম্পর্কে পাঠকের প্রতিক্রিয়া শোনার পর তার অনেক ভালো লাগে। দেশ থেকে টেলিফোন করা অনেক ব্যয়বহুল, তাই চাইলেই মন খুলে তারা কথা বলতে পারে না। আবার অনেকে তার ঠিকানায় চিঠি লিখেছে এই বই পড়ে তাদের অনুভূতি জানিয়ে। চিঠি পেয়ে যেন মিতুল তাদের চিঠির উত্তর লিখে, তাই অনুরোধ থাকে অনেকের চিঠিতে।
মিতুল জানতে চায় তার ফোন নম্বর বা ঠিকানা পেয়েছে কোথায়? তারা জানায় সাপ্তাহিক বিচিত্রা ম্যাগাজিনের ‘প্রবাস জীবন’ পাতায় তার লেখা নিয়মিত তারা পড়ে। লেখার সাথেই তার টেলিফোন নম্বর আর ঠিকানা উল্লেখ থাকে। তাই যে কেউ চাইলেই তার ঠিকানা এবং ফোন নম্বর পেতে পারে। বিষয়টি মিতুল জানতো না এই জন্য যে, বিচিত্রার কোনো সংখ্যা তখনো মিতুল পায়নি এখানে, তাই।
দেশে মিতুল তার বই প্রকাশের সংবাদ পেয়ে মাকে চিঠি লিখে জানায় মেলায় গিয়ে যেন তার অবর্তমানে বই কিনে নিয়ে যায়। সে লিখেছে, এটা তার এক ধরনের ভালোবাসা এবং স্বপ্নেরই সফলতার প্রথম ধাপ। চিঠি পেয়ে মেলা চলা কালে মিতুলের মা তার এক বোনকে সাথে নিয়ে বাংলা একাডেমি চত্বরে অনুষ্ঠিত বই মেলায় যান বই সংগ্রহ করতে। বই কিনে বাসায় এসে টাকা খরচ হলেও পাশের বাসার টেলিফোন থেকে ফোন করেন মিতুলকে তার জাপানের বাসার নাম্বারে। মিতুল ফোন কল রিসিভ করেই কেটে দেয় মায়ের কল। এরপর সাথে সাথে কলব্যাক করে মিতুল তার বোনের বাসার পাশের বাসায় মায়ের সাথে কথা বলার জন্য।
ফোন করে পরে মায়ের সাথে কথা বলে মায়ের অনুভূতি জানার চেষ্টা করে মিতুল। বই নিয়ে এবং মেলায় মিতুলের নাম ঘোষণা করার কথা শুনে মায়ের কেমন অনুভূতি হয়েছিল তা নিয়ে লম্বা সময় কথা বলে মিতুল।
ফোন করলে প্রথমেই তার মা তার এই বইয়ের কথা বলতে গিয়ে বললেন, বাবা, তোমার নাম মেলায় মাইকে অনেকবার বলেছে শুনেছি। হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে আমার নিজের কানে যখন তোমার নাম বলতে শুনেছি তখন আনন্দে আমার চোখের পানি গাল গড়িয়ে পড়েছে। পরে অনেক খুঁজে খুঁজে যেই দোকানে তোমার বই পাওয়া যায় সেই দোকানে গিয়ে বই কিনে আনলাম। বই হাতে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে মনে করেছি তোমাকেই যেন আমি বুকে জড়িয়ে ধরেছি বাবা।
মিতুল তখন তার মায়ের অনুভূতির কথা শুনে আবেগে আর কোনো কথাই যেন বলতে পারছিল না। হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলে সে। এই কান্না কোনো কষ্টের নয়, কান্না ছিল আনন্দের। মিতুলের কান্না দেখে পাশে বসে থাকা তার সেই রুম মেটও অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে যান।
কান্না যেন তার আর থামে না। তখন পাশ থেকে তার সেই রুম মেট টেলিফোন রিসিভার হাত বাড়িয়ে নিয়ে মিতুলের মার সাথে নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। কথা হয় মিতুলের চাকরি নিয়ে, কথা হয় তার শরীর নিয়ে। এরপর কথা হয় মিতুলের এই লেখা বই নিয়ে। পাশ থেকে মিতুল শুনছিল তাদের আলোচনা।
যখন কথা বলার পরিবেশ পরিস্থিতি হয় তখন মিতুল আবার রিসিভার চেয়ে নিয়ে কথা বলে তার মায়ের সাথে। এসময় তার মা তাকে আশীর্বাদ দিয়ে বললেন, - আমি আশীর্বাদ করি তুমি যেন তোমার স্বপ্ন সফল করতে পারো। তোমাকে আমরা সব সময় আমাদের প্রার্থণায় স্মরণ করি। বিদেশের বাড়িতে কখন কি হয় আমরা তো দেখতে বা জানতে পারি না। প্রার্থণা করাই এখন আমাদের একমাত্র কাজ। তুমি ভালো থেকো। ঈশ্বর তোমার সহায় থাকুন।
মায়ের আশীর্বাদ সাথে রয়েছে মনে করেই মিতুল নিয়মিত প্রবাসে এতো কষ্টের পরেও এই বই পড়ে আর ফাঁকে ফাঁকে কিছু না কিছু লেখার চেষ্টা করে। কিছুদিন পর দেশ থেকে তারই এক শুভাকাঙ্খী মিতুলের ঠিকানায় পার্সেল করে বই পাঠায়। সেই বই পেয়ে আবারো আনন্দে মাতে। বই হাতে নিয়ে মিতুল আনন্দে বেশ লাফাতে থাকে। বই যেন আর হাত থেকে ছাড়ে না বা অন্য কোথাও রাখে না। একবার বইয়ের কভারে নিজের নাম দেখে, একবার বইয়ের গন্ধ নেয়। নতুন বইয়ের গন্ধই যেন অন্যরকম, আলাদা। তার কাছে এই বই যেন তখন হয়ে যায় সন্তান তুল্য।
এরপর নিয়মিত সে বই লিখে দেশে পাঠায় প্রকাশকদের ঠিকানায়। তারা বই প্রকাশ করেন। এর মধ্যে অনেক গুলো বই তার প্রকাশ করা হয়। অনেকে তার বই খুঁজে নেয় পড়ার জন্য। ফেসবুকের বদৌলতে ভক্তের সংখ্যাও বাড়ছে আগের চেয়ে অনেক। এভাবে মিতুল হয়ে উঠে একজন লেখক। কেউ কেউ আবার তার নামের আগে লেখক কথাটিও জুড়ে দিয়ে কথা শুরু করেন। এটাই ছিল শুরুতে মিতুলের স্বপ্ন। স্বপ্ন সে সফল করেছে। পেরেছে সে প্রবাসে বসে এত কঠিন পরিশ্রম করেও একজন লেখক হতে।
(চলবে)
লেখক: জাপান প্রবাসী সাংবাদিক
সান নিউজ/এমকেএইচ