পি আর প্ল্যাসিড: মিতুল জাপানে বিয়ে করে ভিসা পাবার পর থেকেই জাপানের বাইরে যে কোন দেশে আসা যাওয়া করার অনুমোদন পায়। অনেকটা ভ্রমণে আর কোন বাধা রইলো না তার। তাই মিতুলের ইচ্ছে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানো। তখন থেকেই এগিয়ে চলে তার নতুন স্বপ্নের ট্রেন চলা।
প্রথম প্রথম স্ত্রীকে বলতো, চলো ছুটিতে কোথাও ঘুরে আসি। স্ত্রী তার ভ্রমণ করা অতোটা পছন্দ করে না, যতোটা মিতুলের পছন্দ। তাই মিতুল আবদার করলে তার স্ত্রী বলতো, আমার কোথাও বেড়ানোর ইচ্ছে নেই। ছুটির সময়টুকু ঘরে ঘুমাবো। তোমার ইচ্ছে হয় তুমি যেতে পারো। গিয়ে ঘুরে আসো। তাই স্ত্রীকে রেখে মিতুলের আর যাওয়া হয় না।
জাপানিরা অনেক বেশি কাজ পাগল। এটা আসলে তাদের এক ধরনের কাজের প্রতি দায়িত্ব বোধ থেকে জন্মেছে। মিতুলের স্ত্রীর মধ্যেও এমনটা আছে। তবে তার চেয়ে বেশি আছে মিতুলের মধ্যে। সে যেখানে যা-ই করে সেটা মনোযোগ সহকারে নিজের মনে করেই করে। যে কারণে তাকেও পরিচিতরা কাজ পাগল বলতে শুরু করে।
যেহেতু তার শিকড় এখন জাপানে গেড়েছে সুতরাং তার এই শিকড় থেকেই ভবিষ্যত প্রজন্মের বিকাশ ঘটানোর পরিকল্পনা তার। কাজের সাথে যে নিজের কেরিয়ার জড়িয়ে আছে তাই। স্ত্রীর সাথে সাথে তার মনমানসিকতা জাপানিদের মতোই হয়ে উঠতে থাকে ক্রমে।
একবার তারা দু’জনে পরিকল্পনা করে বাংলাদেশে যাবে, কিন্তু এক সাথে যাবার আর সময় সুযোগ মিলাতে পারে না। তাই একসময় মনে করে, জাপানে থেকে জাপানিদের মতো হতে চাইলেই জাপানি আর হতে পারবে না। জাপানিরা সময় পেলে ভ্রমণ করে। পরিবার নিয়ে বা দল নিয়ে। বছরে একবার অন্তত ভ্রমণের পরিকল্পনা এবং বাজেট দু’টোই করে বাইরের কোনো দেশে যাবার জন্য।
তাই শুরু করে জাপানের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়ানো। স্ত্রীর সাথে তার মনের মিল হলে পর সে তার বিশ্বাস অর্জন করতে পারে। তখনই শুরু করে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো। কখনো কখনো স্ত্রী তার সঙ্গী হয় কিন্তু সর্বদা তা করতে পারে না। তাই একাও যেতে হয় কখনো তাকে।
জাপানে বিভিন্ন সময় দেশ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারী আসেন সেমিনারে যোগদান করতে। তখন মিতুল তাদের সাথে দেখা করে। সময় সময় সাথে তার স্ত্রীও থাকে। তারা তাদের নিয়ে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে নিয়ে যায়। একসাথে কোথাও বসে খাবার খায় আর দেশ বিদেশের গল্প করে। এসব শুনে মিতুলের স্ত্রীর মাঝে ভ্রমণের শখ জাগে। তাই নিজে থেকেই একসময় বলল বাংলাদেশে ঘুরতে যাবার কথা।
বিয়ের কিছুদিন পরেই মিতুলের স্ত্রী সন্তান সম্ভবা হয়, যে কারণে নিজের স্বামীর দেশ বাংলাদেশে যাবার ইচ্ছে হলেও শারীরিক অবস্থার কারণে আর যাওয়া হয় না। পরিকল্পনা করে সন্তান হলে তিনজন এক সাথেই বাংলাদেশে যাবার। এজন্য তারা আলাদা করে টাকা জমাতে থাকে।
এর মধ্যে হঠাৎ করে মিতুল তার কাজ বদলায়। সে কাজের ধরনই হচ্ছে তার বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ানো। জাপানের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য বিভিন্ন দেশের উপর ডকুমেন্টারি তৈরি করে এমন এক প্রতিষ্ঠান থেকে তার কাছে প্রস্তাব আসে, বাংলাদেশের দায়িত্ব নেবার। মিতুল মনে করে এটা যেন তার স্বপ্নেরই কাজ। কাজটির ধরন জানার পর স্ত্রীর সাথে কোনো পরামর্শ না করেই সম্মতি দিয়ে দেয়।
শুরু হয় তার দেশে যাওয়া। কিছুদিন পরপর দেশে আসা যাওয়া করতে শুরু করে মিতুল। এতে টেলিভিশনে তাকে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখে এবং তার নাম দেখে পুরোনো জাপানি বন্ধুরা তার সাথে আবার যোগাযোগ করতে শুরু করে। তার সাথে আলোচনা করে বাংলাদেশে ব্যবসা করার বিষয়েও।
মিতুল চেষ্টা করে সে সকল আগ্রহী জাপানিদের দেশে নিয়ে তাদের চাহিদা অনুযায়ী যারা ব্যবসা করেন তাদের সাথে কথা বলিয়ে দিতে। এতে তার আসা যাওয়ার ভাড়া দেশে থাকা খাওয়া এবং যতদিন থাকে ততদিন গাড়ি ভাড়া এমনকি বাড়তি খরচও দেয়। যে কারণে স্বাধীন কাজে তার মন চলে বেশি।
একসময় টেলিভিশনের কাজে সে ছুটে যায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায়। কখনো সুন্দর বন, কখনো সিলেট, কখনো চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, কখনো রোহিঙ্গা ক্যাম্প, এভাবে সারা বাংলাদেশ প্রায় তার ঘোরা হয়ে যায়। একসময় মনে করে এই কাজের সুবাদে সে অন্যান্য দেশও ঘুরতে পারে।
কিন্তু ভাষার কারণে স্থানীয় লোক বা প্রতিনিধি ছাড়া সে সেই দেশের কাজ করতে পারবে না। তাই বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি খুঁজে পরিচয় করিয়ে দেয় তার প্রতিষ্ঠানে। এভাবে সেই প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাছে সে হয়ে উঠে একজন দক্ষ এবং একনিষ্ঠ প্রতিনিধি। এই সুবাদে তার যাওয়া হয় ভারত, শ্রীলংকা, ব্যাংকক, চিন, হংকং, কোরিয়া।
একবার মিতুল মালোয়েশিয়াতে যায় বেড়াতে। সেখানে গিয়ে এক বাঙালি ছেলের দেখা পায়। তাকে নিয়ে যতটা সম্ভব মালোয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর ঘুরে বেড়ায় সে। তাছাড়া মিতুল যে দেশেই যায় সে চায় সেই দেশের বর্তমান অবস্থায় আসার আগের সব বিষয় দেখার। তাই মিতুল সেই লোককে বলল, জাপানে সবই আছে যা আপনি দেখাতে চেয়েছেন।
কিন্তু এই দেশের অতীত কেমন ছিল তার কোনো নিদর্শন থাকলে বলুন আমি সেগুলো দেখায় আগ্রহী বেশি। একথা বলার পর মিতুলকে সে নিয়ে গেল এক রেস্টুরেন্টে যেখানে এখনো মানুষ কলা পাতায় ভাত খায়। এখানে এটা তাদের এখনো ট্রেডিশন।
বাংলাদেশে অনেক আগে মিতুল এমন পরিবেশে ভাত খেতে দেখেছে মানুষদের। তার ঠিক মনে নেই। তবে কোনো বিয়ের আয়োজন কিংবা কারো শ্রাদ্ধে এই কলাপাতায় ভাত খেয়েছিল। মালোয়েশিয়াতে এসে ঐতিহ্য ধরে রাখার যে আয়োজন সেটা দেখেই তার খুব ভালো লাগে। তাই আগ্রহ নিয়ে সে খেতে বসে আর দেশে ছোট বেলা হিন্দু বাড়িতে বড় কোনো আয়োজনে অংশ নেবার কথা মনে করে মিতুল।
সেবারে মিতুল মালোয়েশিয়া গিয়ে যেখানে যা যা দেখেছে তাতে যেন মোটেও মন ভরেনি। জাপান ফিরে আসার পর ভাবে যদি সে আবার কখনো এভাবে মালোয়েশিয়া যাবার সুযোগ পায় তাহলে মালোয়েশিয়ার উপর ভ্রমণ কাহিনী লিখবে। এরপর অনেকবারই মালোয়েশিয়া সে গিয়েছে কিন্তু সময়ভাবে লেখার মতো কোথাও ঘুরে দেখা হয়নি। তাই লেখাটিও তার হয়নি।
এরপর ভারতের কলকাতা হয়ে কৃষ্ণ নগর যায় ঘুরতে। সেখানে তার অনেক পুরোনো স্মৃতি রয়েছে। যাবার পর তারই এক বন্ধু তাকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে গিয়েছিল ঘুরতে। সেখানে যাবার পর মনে পড়ে যায় মিতুলের হাইস্কুলের পাঠ্য বইয়ে ইতিহাস পড়ার কথা। ইতিহাসে সেই পূর্ব আমলের রাজা বাদশাহদের কথা, তাদের যুদ্ধ এবং যুদ্ধে জয় পরাজয়ের কথা, মিরজাফরের কথা পড়েছে। কিছু ঐতিহাসিক জায়গা ঘুরে দেখার পর ইতিহাস বইতে পড়া সব কিছুই যেন চোখের সামনে ভেসে আসতে শুরু করে তার।
সেখান থেকে ফিরে আসার সময় ঘুরে দেখে ইসকনের হেড কোয়ার্টার। জাপানে বসে ইসকন সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে। কিন্তু ইসকনকে সে কেবলই একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী ভাবতো। কিন্তু ইসকনের হেড কোয়ার্টারে গিয়ে নিজের চোখে এসব দেখে আসার পর সেখানকার গল্প শুনে তার যেন ধারণা সব বদলে গেলো এই ইসকন সম্পর্কে।
বাংলাদেশেও ইসকন আছে। তাদের সম্পর্কেও কিছুটা ভুল ধারণা পরিষ্কার হয় মিতুলের। জানার আগ্রহ বেড়ে যায় তার এই ইসকন এর পৃথিবীব্যাপী তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে। জাপানে এসে সে টিভি চ্যানেলের পরিচালকের সাথে কথা বলে ইসকনের হেড কোয়ার্টার সম্পর্কে। প্রস্তাব করে এর উপর কোন ডকুমেন্টারি করার বিষয় নিয়ে।
এসব নিয়ে লিখতে শুরু করে সে নারিতা থেকে কলকাতা ভ্রমণ কাহিনী। এই লেখা লিখে প্রকাশ করে নিজেকে একজন সৌখিন ভ্রমণ বিলাসী হিসেবে। এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তার আমন্ত্রণ আসতে থাকে ভ্রমণের। এটাও বলা হয় তার ভ্রমণের যত খরচ হবে সবটাই তারা বহন করবে। তবে শর্ত থাকে ভ্রমণ শেষে যেন সে নারিতা থেকে কলকাতা-র মতো করে ভ্রমণের উপর বই লিখে। মিতুল তা মেনে নেয়। আলোচনা হয় তাদের কোনো অনুষ্ঠানের কথা। এভাবেই মিতুল হয়ে উঠে একজন সৌখিন ভ্রমণ বিলাসী।
(চলবে)
লেখক: জাপান প্রবাসী সাংবাদিক
সান নিউজ/এমকেএইচ