পি আর প্ল্যাসিড
মিতুল অনেকদিন হয়ে গেলো জাপানে বসবাস করছে। তার পরিচিত অনেকেই চাকরি বাদ দিয়ে এর মধ্যেই ব্যবসা করতে শুরু করেছে। কেউ করছে হালাল খাবারের রেস্টুরেন্ট, কেউ করছে হালাল স্পাইসের ব্যবসা আবার কেউ করছে পুরাতন গাড়ির ব্যবসা। কারো কারো ব্যবসা শুরু থেকে ভালো চলছে। কারো আবার ব্যাংক লোন নিয়ে ভালো চালানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আবার কেউ নিজেদের ভালো থাকার ভাব প্রকাশ করে নিজেরাই ব্যবসার ঢাক বাজিয়ে চলেছে।
মিতুল এদের প্রায় সবার সম্পর্কেই খোঁজ-খবর রাখে। যে যতো বড় ব্যবসায়ী হিসেবে কমিউনিটিতে নিজেদের জাহির করার চেষ্টা করছে তারা ততোটাই যেন ব্যাংকের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে আছে। এসবের তাল সামলাতে না পেরে দেশ থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে লোক আনার ধান্দাও করছে কেউ কেউ। মিতুল এসব দেখে নিজে আর ব্যবসা করার দিকে এগোতে সাহস করে না। কিন্তু যখন বিয়ে করে, তখনই ভাবে এখানে এই চাকরি করে সে সংসার চালাতে পারলেও নিজের স্বপ্ন পূরণ কখনো সম্ভব হবে না জাপানে।
এর মধ্যে মিতুল চিন্তা করে, বাঙালিদের সবাই জাপানে যেখানে গদবাঁধা ব্যবসা করছে সে-ই একই ধরনের কোনো ব্যবসা সে জাপানে করবে না। মনে মনে ভাবে, যারা ব্যবসা করছে তাদের প্রায় সকলে তার পরিচিত। তাদের প্রচার প্রসারের কাজটি করার মতো ভিন্ন ধরনের ব্যবসা করার জন্য কমিউনিটিতে বাংলা পত্রিকা বা ম্যাগাজিন প্রকাশ করা যেতে পারে এবং জাপানে যেহেতু বাংলাদেশির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে তাই, মিডিয়া ব্যবসার দিকে এগিয়ে যাবার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। এ নিয়ে আলোচনা করে সে একজন অভিজ্ঞ লয়ারের সাথে। যার মাধ্যমে সে জাপানে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রেশনের কাজ সম্পন্ন করতে পারে।
যেহেতু সে নিজে কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত কিছু করতে পারবে না আবার তার স্ত্রীও এসব বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখে না তাই অভিজ্ঞ লোককে যথাযথ ফি দিয়ে কাজটি সম্পন্ন করানোটাই ভালো হবে মনে করে। এমনকি ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো পরামর্শ দরকার হলে তাকে সহযোগিতা করতে পারবে মনে করে একজন লয়ারকে তার ব্যবসার ধরন কি হবে তা নিয়ে কথা বলে। বিস্তারিত বিষয় খুলে বললে পর, জাপানের মতো দেশে মিডিয়া প্রতিষ্ঠান করার সকল প্রকার ভালো দিক, খারাপ দিক এবং এটা করা যে কতো কঠিন সে বিষয়েও ধারনা দিলেন মিতুলকে।
সবকিছু বোঝানোর পর মিতুল তার ব্যবসার ধরনের মধ্যে যতো ধরনের ব্যবসা সে আইনগতভাবে করতে পারে সব কিছু লিখে দিতে বলে। যখনই বলা হয় তার এটা হবে একটি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান তখন অন্য আর দশটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে কঠিন হয়ে যায় জাপানে এটি রেজিস্ট্রেশন করা। বলা হয়, প্রথমেই অফিস দেখাতে হবে। আর অফিস ভাড়া নিতে গেলে যখন বলা হয় এটি তার মিডিয়া ব্যবসার প্রতিষ্ঠান হবে তখন নিরাপত্তার কারণেই তাকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন সার্টিফিকেট নিয়ে তা দেখানোর কথা বলা হয়। মিডিয়ার কথা বললে অফিস ভাড়া হয়ে যায় সাধারণ ভাড়া থেকে বেশি, এডভান্সের পরিমান দেখাতে হয় বেশি। তারপর রয়েছে এটার জন্য বাড়তি স্পন্সর বা হোসোনিন। তাদেরকেও মোটা অংকের টাকা দিতে হবে। এছাড়া অফিস ভাড়া করা অসম্ভব।
বিষয়টি নিয়ে এখানে অনেকের সাথে আলোচনা করে মিতুল। বিশেষ করে যারা তার খুব ঘনিষ্ঠ বা শুভাকাঙ্খী তাদের সাথে। ব্যবসা সংক্রান্ত সব কিছু ঠিকঠাক হলে অফিস ভাড়া নেয়ার কাজও সম্পন্ন করে। টোকিওর প্রাণ কেন্দ্র তোশিমা ওয়ার্ডস্থ ইকেবুকোরোতে, যেখানে বাংলাদেশি লোকজনের আনাগোনা বেশি হয়, সেখানে অফিস ভাড়া নেয়।
অফিস ভাড়া নেবার পর সব কিছু গোছগাছ করে একদিন আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস উদ্বোধন করার দিন তারিখ ঠিক করে পরিচিত জনদের আমন্ত্রণ করা হয়। এদিকে অফিসে ধর্মীয় মতে মিলাদ বা সার্বজনীনভাবে প্রার্থনা করানো হবে বলে সব ঠিক করে। অফিস উদ্বোধনীর দিন সবাইকে আমন্ত্রণ করা হলেও একজন মিতুলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে শুরু করে প্রথম দিন থেকেই।
একই দিনে আরও একটি অনুষ্ঠান ছিল টোকিওর পাশের প্রিফেকচারে এক বাঙালির বাসায়। যে কারণে সেখানে অংশ গ্রহণ করে আসতে আসতে তার কিছুটা দেরি হয়ে যায়। তার জন্য অপেক্ষা না করায় সে ক্ষিপ্ত হয়ে এমন অপপ্রচার শুরু করে।
তার সাথে একই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়াদের অর্ধেক লোক অফিসে এসে দোয়া-দরুদ পড়ে যান। এটা দেখে তার সাথে থাকা বাকিদের প্রচার শুরু হয় টোকিওতে মিতুল কিভাবে এই অফিস চালায় সেটা তারা দেখে দিবে। যা ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তদের থেকেও খারাপ। শেষ পর্যন্ত এরা মিতুলের ক্ষতি করার নানা অপচেষ্টা চালাতে শুরু করে টোকিওতে।
মুখে মিতুলের বিরোধীতাকারী সেই লোক কয়জন টোকিওতে আওয়ামী লীগের সমর্থক বললেও চলা ফেরায় তাদের দেখা যায় প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের বাদ দিয়ে কাজ করে। অনেকে এদের কারো সম্পর্কে কথা তুলেছে ফ্রিডম পার্টির সমর্থক বলেও। বিষয়টি জানার পর মিতুল নিজেকে এই বলে শান্ত্বনা দেয় যে, তাদের কাজই মানুষের ভালো কাজে বাঁধা দেয়া। তারা নিজেরা যা করতে পারে না তারা অন্যদের ভালো কাজ করা দেখেও সহ্য করতে পারে না। তাই মিতুল নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা চিন্তা করে।
শুরু হয় মিতুলের কমিউনিটিতে চুপ হয়ে যাওয়া। কারণ সে অফিস নেবার পর যে কাজেই হাত দেয় সেই কাজেই বিরোধীতা করতে থাকে ওরা। অথচ এর আগে টোকিওর সবচেয়ে দামি এলাকা রূপপংগীর মিড টাউনে অফিস করেছে মিতুল। করেছে মেজিরো স্টেশনের পাশেও। তখন জাপান প্রবাসী বাঙালিদের কেউ মিতুলের এই অফিস নিয়ে কোনো কথাই বলেনি। তারা জানতোই না। সব কাজ ছিল মিতুলের জাপানিদের সাথে। বাঙালিদের সাথে আরো বেশি জড়িত হতে যে-ই নাকি বাঙালি প্রধান এলাকা বলে খ্যাত ইকেব্যুকোরো এলাকায় অফিস ভাড়া নিয়েছে তখনই তার উপর নেমে আসে এই বাঁধা দেবার পরিকল্পনা।
অফিস ভাড়া নেবার পর সে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রেশনের সকল কাগজপত্র তৈরি করে। সিদ্ধান্ত হয় কোম্পানির নাম রাখা হবে বিবেক কোম্পানি লিঃ এবং এটি হবে একটি প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠান। এর শেয়ার হোল্ডার মিতুল এবং তার স্ত্রী। শুরুতে কয়েকজন স্টাফ নিয়ে মিতুল তার কর্মকাণ্ড শুরু করলেও কিছুদিন না যেতেই দেখে তার শত্রুর সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে। বিষয়টি বুঝতে পেরে মিতুল এর পিছনে কারণ জানার চেষ্টা করে। কেউ কেউ বলল, এখানে যারা গাড়ির ব্যবসা করছে অর্থাৎ ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কাজ করছে তাদের অনেকের কাছেই মিতুল হয়ে উঠলো হিংসের পাত্র। এই হিংসের কারণেই শুধু তারা মিতুলের উন্নতি সহ্য করতে পারে না। এজন্যই নানান জনকে মিতুলের সম্পর্কে মিথ্যা অপপ্রচার করতে শুরু করে পিছন থেকে টেনে ধরার চেষ্টা চালায়।
টোকিওর তোশিমা ওয়ার্ডের ইকেবোকোরোতে যখন অফিস নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করতে শুরু করে, তার কিছুদিন পর থেকে তার কাজ আগের থেকে কমে যেতে থাকে। এতে করে তার প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড যেভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নেবার কথা তা না হয়ে ক্রমেই লাল বাতি জ্বলতে তাকে ব্যবসায়। এক সময় সিদ্ধান্ত নেয় অফিস বন্ধ করে দিবে মিতুল। যখন সে অফিস ছাড়ার নোটিশ দিয়ে দেয় বাড়ির মালিক পক্ষকে, তখনই হঠাৎ করে একদিন ফোন আসে তার এক পুরোনো জাপানি বন্ধুর কাছ থেকে।
মিতুল তার এই বন্ধুর কথা এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিল বলা যায়। দীর্ঘ কয়েক বছর হবে তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগই ছিল না। কিন্তু বন্ধুটির ফোন নম্বর তার মোবাইলে সেভ করা থাকায় ফোন আসলে সে বুঝতে পারে তার পুরোনো বন্ধুর কাছ থেকে যে ফোন এসেছে। জাপানি বন্ধু ফোন করে জানতে চাইলো, তুমি কোথায়?
মিতুল বলল, সে ইকেবুকোরো আছে।
বন্ধুটি তার জানতে চাইলো, - ইকেবুকোরোতে কি করছে।
মিতুল জানালো, এখানে তার অফিস।
বলার পর মিতুলের বন্ধু বললো, এস এম এস করে তার অফিসের ঠিকানা পাঠাতে। আধা ঘণ্টার মধ্যে সে চলে আসবে তার অফিসে। সত্যি সত্যিই বলার ঠিক আধা ঘণ্টার মধ্যেই সে তার অফিসে এসে হাজির হয়। এসে মিতুলের ব্যবসার ধরন এবং নানা বিষয়ে জানতে চায়। সব জেনে বলল, তুমি চিন্তা করো না আমি তোমাকে নতুন এক ব্যবসা দেবো। যদি করতে চাও।
তার বন্ধুও একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বলার পর মিতুল ভাবে বাঙালিদের সাথে তার কোন ধরনের ব্যবসা এখানে করা সম্ভব হবে না। তাই তার জাপানি বন্ধুটি যে-ই ব্যবসার কথা বলছে সেটাই সে ভালোভাবে করতে পারবে। সেই কাজে কোনো বাঙালির প্রভাব পড়বে না। তাকে কেউ এখানে আর পিছন থেকে টেনেও ধরতে পারবে না।
মিতুল আগে থেকেই তার এই বন্ধুটির ব্যবসার কথা জানে। সে বিভিন্ন দেশের উপর টেলিভিশনের ডকুমেন্টারি তৈরি করে টেলিভিশনে চালায়। সব কথা শুনে মিতুল মনে করে তার কাজের ধরনের সাথে মিলে যায়। তাই সেদিনই সে তাকে সম্মতি দিয়ে বলল, বাংলাদেশকে পজিটিভলি উপস্থাপনা করার জন্য হলে যে কোনো কাজ করতে সে প্রস্তুত। যদি নেগেটিভ কোনো কাজ করতে বলা হয় তাকে তবে কয়েকগুন বেশি টাকা দিলেও সে তা করবে না। এই শর্তে হলে সে তার সাথে কাজ করার বিষয়ে আপত্তি করবে না।
এরপর তার অফিস বন্ধ করে দেবার ঘোষণা আগে থেকেই দেবার কারণে সেই অফিস আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি মিতুলের। বাধ্য হয়ে তার কোম্পানীর ঠিকানা বদলে করা হয় তার সেই বন্ধুর ঠিকানায়। বিষয়টি বাঙালিরা পরবর্তীতে জেনে যায়। তাতে যেন সেই হিংসে করা বাঙালিরা আরো বেশি উঠে পড়ে লাগে তার পিছনে সে যেন কোথাও কোন কাজ করতে না পারে, তাই। এটা জেনেও মিতুল কোনো ভাবে থেমে থাকেনি। সে তার কাজ করতেই থাকে এবং দিনদিন সে আরো আগের থেকে ভালো কাজ করতে থাকে সব বিষয়ে। এটা দেখে তাদের যেন চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় বিরোধীতাকারী সবাই।
(চলবে)
লেখক, জাপান প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক।