পি আর প্ল্যাসিড
নববর্ষ উপলক্ষে জাপানে অফিস আদালত, বলতে গেলে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এই বন্ধে লোকজন শহর ছেড়ে যে যার মতো গ্রামের বাড়িতে চলে যায়, তাদের বাবা-মা বেঁচে থাকলে তাদের সাথে দেখা করতে। কিংবা কেউ আবার ছেলে মেয়ে নিয়ে দেশের বাইরে যায় বেড়াতে। কেউ আবার আড্ডা জমায় কোনো জাপানি রেস্টুরেন্টে মদ খেতে খেতে। এটা সব বয়সের লোকদের মধ্যেই হয়।
জাপানের আরো একটি ট্রেডিশন আছে। নববর্ষ উপলক্ষে পরিচিতদের মধ্যে পোস্ট কার্ডের মাধ্যমে একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময় করা। এই প্রথা অনেক পুরোনো দিনের। এখনো এই রেওয়াজ চলছে। এটি অনেক আগে থেকেই জাপানের সোসাইটিতে প্রচলিত। আধুনিক ইন্টারনেটের যুগে এতে কিছুটা ভাটা পড়েছে যদিও, তারপরেও একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি এখন পর্যন্ত।
অনেকে পোস্ট অফিস বা অন্য কোথাও থেকে সাদা পোস্ট কার্ড কিনে নিজেদের পছন্দ করা কোনো ছবি কার্ডে প্রিন্ট করে তা আবার পোস্ট অফিসের মাধ্যমেই আবার বিলি করে। তবে আগের বছরের শেষ সপ্তাহ থেকে পরের বছরের জানুয়ারি মাসের পাঁচ তারিখ অবধি এই কার্ড পোস্ট করে। এমনকি একে অপরের সাথে কোথাও দেখা হলে মুখে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। জাপানিজ ভাষায় এই শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় বলে " আগেমাস্তে অমোদিতো গোজাইমাছ "। যাকে উদ্দেশ্য করে বলে, উত্তরে সেও এই আগেমাস্তে অমোদিতো গোজাইমাছ বলে উত্তর দেয়। এটা জাপানিদের নববর্ষ উপলক্ষে খুব সাধারণ একটি সৌজন্যতা।
ছুটির মধ্যে মিতুল ঘরে বসে নিজের কাজ করতে করতে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠলে কিছুটা মনের রিলাক্স করতে বাইরে ঘুরতে বের হয়। ঘর থেকে বের হওয়া মানেই টোকিওর কোনো এক স্টেশন গিয়ে পরিচিত কারো সাথে বসে আড্ডা দেয়া। যেদিন বাসা থেকে সে বের হয় সে গভীর রাত না হওয়া পর্যন্ত আর ঘরে ফিরে আসে না। বাসা তার টোকিওর খুব কাছে বলে রাতে শেষ ট্রেনে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। সে যে-ই এলাকায় থাকে সেই এলাকার নাম ছাইতামা। অর্থাৎ ছাইতামা প্রিফেকচারের উরাওয়া শহর। আর যেখানে সে আড্ডা দিতে যায় নিয়মিত সেখানে যেতে তার বাসা থেকে আধা ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না। স্টেশনের নাম হিগাশি জুজো।
হিগাশি জুজো স্টেশন গিয়ে ট্রেন থেকে নেমে মিতুল নিয়মিত এক বাংলাদেশি হালাল খাবার এবং স্পাইসের দোকানে বসে আড্ডা জমায়। নববর্ষ উপলক্ষে ঘরে বসে ইউটিউবে দেশের নানা নাটক আর সিনেমা দেখে যখন বোর হয়ে যায় তখনই বাইরে চলে যায় হাঁটতে বা ঘুরতে। এবারেও বছরের প্রথমদিন ঘরে বসে নাটক সিনেমা দেখে কাটিয়ে দ্বিতীয় দিন বের হয় আড্ডা দিতে। হিগাশি জুজোর সেই দোকানে গিয়ে বসতেই এক জাপানি কাস্টমার দোকানে ঢুকে কোনো এক স্পাইসের কথা জানতে চায়। এসময় দোকানদার কুমার ছিল দোকানের বাইরে।
কাস্টমারটি মিতুলকে দেখে দোকানের স্টাফ মনে করে তাকে প্রশ্ন করে, সে যে-ই স্পাইস চাইছে সেটা আছে কিনা। তখন মিতুল বলল, আমি দোকানের কেউ নই। তুমি একটু সময় অপেক্ষা করো, দোকানের লোক এখনই চলে আসবে। বলাতে কাস্টমার মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো মিতুল থাকে কোথায়, সে জাপানে কতোদিন হয় আছে, জাপানে সে কি করে? এমনই আরো নানা প্রশ্ন।
এমনভাবে মেয়েটি হেলেদুলে কথা বলছে, যে কেউ তাকে দেখে মনে করতে পারে এই দোকানের সে পুরোনো বা নিয়মিত কাস্টমার। তাই মিতুল তার নিজের পরিচয় দিয়ে জাপানি ভাষায় আগেমাস্তে মেদেতো গোজাইমাছ বলে শুভেচ্ছা দেয়। মেয়েটিও হাসতে হাসতে উত্তর দিয়ে বলল, তুমি খুব ভালো জাপানি বলতে পারো দেখছি।
মেয়েটির কথায় মিতুল রসিকতা করে বলল, - একসময় আমার বাবার বান্ধবী ছিল জাপানি। একারণেই আমি ভালো জাপানি ভাষা রপ্ত করতে পেরেছি।
মিতুলের কথা শোনার পর মেয়েটি অংক কষার মতো করে হিসাব মিলাতে চেষ্টা করে। অনেকটা কপালের চামড়া কুচকিয়ে বিড়বিড় করে মুখে বলে, বাবার বান্ধবীর সাথে তার ভাষা জানার সম্পর্ক কি হতে পারে। এরপর প্রশ্ন করে, - আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। তোমার বাবার বান্ধবী জাপানি ছিল। তোমার তো না। কিন্তু এর সাথে তোমার ভালো ভাষা জানার সম্পর্ক কি? তোমার বান্ধবী যদি জাপানি হতো তাহলে না হয় বুঝতে পারতাম যে তুমি তোমার বান্ধবীর কাছ থেকে ভাষাটা রপ্ত করেছ। খুব চিন্তায় পড়ে যাওয়ার মতো করে মিতুলের সাথে কথা বলে সে। মেয়েটির এভাবে চিন্তাগ্রস্ত দেখে মিতুল বলল, - আরে এটা তো আমি তোমার সাথে জোদান (রসিকতা) করেছি। তুমি জাপানি হয়ে জোদান বোঝ না?
- তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হয় না তুমি যে আবার জোদান করতে জানো। খুব মাজিমে (সিরিয়াছ) মনে হয় তোমাকে দেখে।
বলার পর মিতুল হা হা হা করে হাসে। হেসে বলে, তোমার নামটা কিন্তু আমাকে বলোনি। বলেই মিতুল নিজে থেকে জাপানের কিছু মেয়ের যেমন কমন নাম থাকে তা বলতে শুরু করে, - আয়াকো, মারিকো, সাসাকি, ইউকা এর মধ্যে তোমার নাম কি কমন পড়েছে?
মেয়েটি "না" বলেই নিজের নাম বলল, - হিরুমি।
এমন সময় দোকানদার কুমার দোকানের ভিতর এসে সামনে পিছে কিছু না বুঝেই কাস্টমার মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,- তুমি তার সাথে কি বলছো, সে কিন্তু জাপানে বিয়ে করেছে। তার স্ত্রী জাপানি।
কুমারের এভাবে হঠাৎ করে দোকানে এসে মিতুলের বিয়ে করার বিষয়টি বলার কোনো কারণ বুঝতে পারে না তাদের দু'জনের কেউ-ই। তারপর আবার বলছে, - আমি এখন পর্যন্ত অবিবাহিত। তুমি কিছু জানার থাকলে আমাকে বলো। আমি তোমাকে যে কোনো বিষয়ে সাহায্য করতে পারবো।
জাপানি মেয়েদের কাছে কে বিয়ে করেছে আর কে বিয়ে করেনি এ নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। যাকে ভালো লাগে তার সাথে সম্পর্কে জড়ায়। তাই বলল, - আমি তো তোমার সাথে কিছু বলিনি। তুমি কেনো নিজে থেকে তার সম্পর্কে আমাকে বলছো?
কুমার বুঝতে পারে মেয়েটি তার কথায় যে মাইন্ড করেছে। তাই বিষয়টি হালকা করতে বলল, - আমি রসিকতা করলাম। তুমি কি এই এলাকাতেই থাকো নাকি?
- হ্যাঁ। অল্প কিছুদিন হয় আমি এই এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে এসেছি। বলেই বলল, - ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখলাম তোমাদের এই দোকান। আমি কারি রান্না করার কিছু স্পাইস কিনতে এসেছি। এরপর মিতুলকে বলার মতো করে একইভাবে কুমারের প্রশংসা করে বলল, - তুমিও দেখছি খুব ভালো জাপানি ভাষা বলতে পারো। কিভাবে শিখেছ এই জাপানি ভাষা তোমরা? তার মানে তুমিও বিয়ে করেছ এখানে জাপানি মেয়ে?
কুমার বলল, - আমি দশ বছর আগে জাপানে ছাত্র হিসেবে এসেছি। আমার ভাষা শিক্ষা কোর্স শেষ করে বর্তমানে জাপানে আমি চাকরির ভিসায় আছি। এখন ভাবছি ভালো কোনো জাপানি মেয়ে পেলে বিয়ে করে জাপানেই থেকে যাবার জন্য।
- তুমি কি জাপানি মেয়ে খোঁজ করছো বিয়ে করার জন্য?
কুমার উত্তর দেয়, - তুমি কি সিঙ্গেল নাকি বিবাহিত?
- আমি সিঙ্গেল। তবে ভাবছি এই দেশে আর কয়েক বছর কাজ করে আরেকটু বয়স হলে থাইল্যান্ড চলে যাবো। জাপান তো অনেক ব্যয়বহুল, তাই জাপান থেকে টাকা নিয়ে থাইল্যান্ডে থাকবো। সেখানে খরচ অনেক কম হয়। সুবিধাও আছে অনেক।
হিরুমির কথা শুনে কুমার বলল, - আমি এখনো বিয়ে করিনি, দকশিন, (অবিবাহিত)। তোমার মতো ভালো কোনো মেয়ে পেলে আমি বিয়ে করে জাপান থেকে যাবার কথা চিন্তা করছি। তবে অন্য কোনো দেশে গেলে নয়।
- তুমি কি ইংরেজি ভালো পারো।
- কেনো?
- আমি ইংরেজি শিখতে চাই।
- আমি আসলে ইন্ডিয়ান। হিন্দি বলতে পারি। মিতুল আমার থেকে বয়সে বড়। তার বাড়ি বাংলাদেশে। সে ইংরেজিও বলতে পারে।
- তাহলে তোমরা কথা বলছো কোন ভাষায়?
আমাদের দু'জনের ভাষাই বাংলা। বলেই কুমার বলল, - আমি কিন্তু পাঁচটা দেশের ভাষা বলতে পারি। তুমি যেটা শিখতে চাইবে আমি সেটাই তোমাকে শিখাতে পারবো।
এরমধ্যে দোকানে বেশ কয়জন কাস্টমার চলে আসে। কাস্টমার আসলে কুমার বেশ ব্যাস্ত হয়ে পড়ে তাদের সাথে। এ সময় হিরুমি মিতুলকে তার মোবাইল নম্বর দিয়ে বলল, - আমি এখন চলে যাই। তুমি আমার সাথে পরে ফোনে যোগাযোগ করো। তোমার সাথে আমি পরে কথা বলতে চাই। বলে সে কুমারকে কোনো কথা না বলে দোকান থেকে বের হয়ে চলে যায়।
হিরুমি চলে যাবার পর মিতুল দোকানে অন্য কাস্টমারদের সাথে কথা বলতে শুরু করে। এমন সময় তার মোবাইলে টুন করে একটা শব্দ হয়। শব্দ শুনে সে বুঝতে পারে কোনো ম্যাছেজ এসেছে। তাই অন্যদের সাথে কথা থামিয়ে নিজের মোবাইলের সুইচ টিপে অন করতেই দেখে স্ক্রিনের উপর দেখাচ্ছে তার নতুন ম্যাছেজ আসার সংকেত। ওপেন করেই দেখে হিরুমি লিখেছে, আগেমাস্তে অমেদেতো গোজাইমাছ। কোরে কারা ইউরোশিকো অনেগাইশিমাছ। মানে, নতুন বছরের শুভেচ্ছা। সে সাথে এখন থেকে এবছর একসাথে চালিয়ে নেবার অনুরোধ।
মিতুল এতো তাড়াতাড়ি ম্যাছেজ আসবে ভাবতে পারেনি। তাই কিছু সময় ম্যাছেজটি দেখে সেও লিখলো, খচিরা কোছো (আমার পক্ষ থেকেও)। লিখে সেন্ট করে কুমারের দিকে তাকায়। কুমার একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, - মশাই, আমি জানতাম, আমি যতোই কিছু বলি না কেনো সে যে আপনার দিকেই নজর দিয়েছে। আপনি আসলেই সেই রকম কপাল নিয়ে এসেছেন এই জাপান।
বলেই কুমার তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে মিতুল আস্তে করে উঠে বাইরে চলে যায়। এসে আবার লিখে, আমাদের এই নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় যেন আগামী দিনের সম্পর্ক ধরে রাখার ভিত্তি হয়ে থাকে, এই প্রত্যাশা করি। লিখে ম্যাছেজটি হরুমির মোবাইল নম্বরে পাঠিয়ে সামনে এক ভ্যান্ডিং মেশিন থেকে গরম একটা কফির কৌটা কিনে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের দিকে চলে আসে। উদ্দেশ তার, বাসায় ফিরে আসা।
(চলবে)
লেখক, জাপান প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক।