পি আর প্ল্যাসিড: এক অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় সাদিক নামের এক বাঙালির সাথে। কথায় কথায় সাদিক বলল, দেশে জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে পাশ করেছে। বিষয় ছিল তার বিজনেস ম্যানেজমেন্ট।
সাদিকের কথা শুনে মিতুলও বলল, সে-ও ছিল জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। শুধু তাই নয় তার বিষয়ও ছিল বিজনেস ম্যানেজমেন্ট। তখন জানতে চায় তাদের কার পড়াশুনার সেশন কত সাল ছিল। দু’জনই বলল যে যার মতো করে। হিসেব করে দেখে দু’জনের পড়াশোনার সালও এক।
তখন তাদের কয়েকজন বন্ধুর নাম বলে সেই সময়কার কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করে মিতুল এবং সাদিক। দু’জনের ঘটনাবলি এবং ঘনিষ্ঠদের সাথে হুবহু সব মিলে যায় তাদের দু'জনের।
তখন মিতুল বলল, বয়সের সাথে চেহারা বদলে যাবার কথা। সেটাকে মেনে নিয়ে আন্তরিক হয় সাদিক এবং মিতুল। সাদিক বলল, এখন তো আমাদের জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে। বলেই সাদিক সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে। সে নিজেও একসময় সেই সময়কার ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছিলো। বলল, তার মা-ও ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের একজন নেত্রী।
অনুষ্ঠান চলাকালে সে তার অনেক গল্পই করে। পুরোনো দিনের স্মৃতি মিতুলের যতটা না মনে রয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি মনে রেখেছে সাদিক। সাদিকের কথা শুনে মিতুল তার স্মৃতির সাগরে ডুব দেয়। দেখা যায় কথার প্রসঙ্গ বদলে গেলে পর সে মনে করতে পারেনি বিষয়টি। অল্প কিছু মনে করতে পারলে হেসে হেসে কথায় যোগ হয় মিতুল।
জাপানে তার পরিবারের এবং স্ত্রীর পরিবারের প্রায় সবাইকে জাপান নিয়ে এসেছে বলে জানায়। সে টোকিওতে একটি দেশের দূতাবাসে বাবুর্চির কাজ করছে। সাদিকের কথা শোনার পর এটা কিভাবে তার সম্ভব হয়েছে জানতে চাইলে সাদিক বলল, সে জাপান এসে জাপানি ভাষা পড়া লেখা করেছে। এরপর চাকরি করতে করতে সুযোগ বুঝে জাপানের পাসপোর্ট নিয়ে জাপানি নাগরিক হয়ে গেছে।
সাদিকের কথা শুনে প্রশ্ন করলো, আমি তো জানি জাপানের পাসপোর্ট নিলে হলে নিজের দেশের পাসপোর্ট স্যারেন্ডার করতে হয়। জাপানে দুই দেশের নাগরিকত্ব এক সাথে চলে না। কিন্তু তুমি কি করেছ?
জানতে চাইলে সাদিক একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, আমার বেলায় কি আর আলাদা হবে নাকি? আমি তা-ই করেছি। এছাড়া কি আর উপায় আছে, বলো? আমাদের এটা একটা দেশ? তাছাড়া যেই দেশে আছি, সেই দেশের পাসপোর্ট নেওয়া তো দোষের কোনো কিছু দেখছি না।
মিতুল সাদিকের দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে এতোক্ষণ তোমার মায়ের রাজনীতির আদর্শ কথা বললে আর তোমার দেশে রাজনীতি করে আসার কথা আমি জানি, এসবের সাথে তোমার দেশ প্রেমের যে গল্প করলে এসবই কি তাহলে তোমার মিথ্যে?
মিতুলের এমন প্রশ্নে সাদিক কিছুটা থতমত হয়ে বলল, আরে দেশে কোন বেটার ভিতর আবার দেশ প্রেম আছে? কতই তো দেখেছি, সবাই শুধু মুখে মুখে বলে দেশ প্রেমের কথা। আসলের বেলায় ভিন্ন। দেশে তুমি গিয়ে দেখো, সব নেতারাই তাদের ছেলে মেয়েদের বিদেশে পড়া লেখা করাচ্ছে। যারা পারছে না তাদের কথা ভিন্ন। পারলে গিয়ে দেখো তারাও দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত এখন।
সাদিক মিতুলকে তুমি করে সম্বোধন করে আপন করতে চায়। মিতুল হেসে তুমি সম্বোধন গ্রহণ করলেও সে পারে না তাকে তুমি সম্বোধন করে বলতে। বলল, আমি ভাই যেখানেই থাকি বাঙালি হয়েই থাকতে চাই। মরতেও চাই বাঙালি থেকেই। তোমার কথা ভিন্ন। শুনেছি তুমি নাকি আবার লেখালেখিও করো।
শুনেছ মানে? আমি কি আজকে নতুন এই লেখালেখি করি নাকি? জগন্নাথে থাকা কালেই তো আমি লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলাম। একটু থেমে আবার বলল, কেনো আমরা ডিপার্টমেন্ট থেকে যে দেয়াল পত্রিকা করেছিলাম, তোমার কি তা মনে নেই? সেখানে আমার কবিতা প্রকাশ করেছিলে তোমরাই। কবিতার নাম ছিল, ‘তোমার দেয়া রুমালটি’।
ছাত্র সংসদ যে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে স্মরণিকা প্রকাশ করেছিল সেখানেও তো আমার কবিতা প্রকাশ হয়েছিল। তাছাড়া, সেই বছরেই পত্রিকায় আমার প্রথম কবিতা প্রকাশ হয়েছে।
-কি জানি, আমার অবশ্য তোমার বিষয় এতো কিছু মনে নেই। আমি তো ছিলাম রাজনীতি আর খেলাধূলা নিয়ে বেশি ব্যস্ত।
-যাক এবার বলো তোমার ছেলে মেয়েদের সম্পর্কে। মিতুল জানতে চাইলো।
-আমার এক ছেলে এক মেয়ে।
-ওরা কি জাপানি স্কুলেই পড়া লেখা করছে নাকি দেশে রেখে এসেছ?
-না, সবাই জাপানে। এখানে জাপানি স্কুলেই ভর্তি করে দিয়েছি। ওরা জাপানিতেই পড়া লেখা করছে।
-ভাবি কি জাপানি নাকি বাঙালি।
-আরে না, আমার ওয়াইফ বাঙালি। তোমার কি জাপানি নাকি?
-হ ভাই। আমগো কেউ দেশের মেয়ে দিতে চায়নি। তাছাড়া কেউ আমার মতো ছেলেদের পছন্দ করে ভালোবাসেনি যে বিয়ে করবো। এখানেই ব্যবস্থা একটা করে ফেললাম।
-ও, তোমার তাহলে বিয়ে ভিসা?
-তাই বলতে পারো। কেনো? কোনো সমস্যা আছে?
-না, তা হবে কেনো?
কিন্তু তুমি যেভাবে কথাটা বলেছো, শুনে মনে হচ্ছে এটা করে মহা কোনো ভুল করে ফেলেছি।
-আজকাল তো অনেকেই বিয়ে করে বিয়ে ভিসায় আছে। আবার দেশে গিয়েও গোপনে আরেকটা বিয়ে করে ফেলছে।
-আরে ভাই, এখানে আর ওখানে আবার কি? বিয়ে তো বিয়েই। যে যেভাবে করে শান্তিতে থাকতে পারে সেভাবেই করুক। এনিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হয়। মিতুল তার কাজের সুবিধার্থে সামনের দিকে গিয়ে বসে। সাদিক কোথায় হারিয়ে যায় খেয়াল করে না মিতুল। অনুষ্ঠানের শুরুতে একসময় মিতুলকে মঞ্চে গিয়ে মাইকে কিছু বলার অনুরোধ করে। হঠাৎ এমন করে অনুরোধ করলে সে উঠে দাঁড়ায়।
মঞ্চে যাবার আগে পিছনে হলের ভিতর তাকিয়ে সাদিককে খোঁজে। সাদিক হয়তো বুঝতে পারে যে তাকেই খুঁজছে মিতুল। তাই তাকে ইশারা করে মঞ্চে যাবার ইঙ্গিত করে। মিতুল মঞ্চে গিয়ে মাইক হাতে নিয়ে তার বক্তব্য শুরু করে। শুরুতেই আয়োজকদের ধন্যবাদ দেয়। এরপর প্রসঙ্গক্রমে সাদিকের কথা বলে তার বক্তব্যে। দেশে ছাত্র জীবনে এই সাংবাদিকতা করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেয়ালিকা থেকে শুরু করে দৈনিক পত্রিকায় লেখালেখি করা সব বলার পর সাদিকের নাম বলল মিতুল।
সে আরো বলল, আমার একজন ক্লাস ফ্রেন্ড এর দেখা পেলাম আজ এখানে এসে। সে অনেক বছর পর আমাদের দেখা। আমরা দু’জনেই অনুষ্ঠান শুরুর আগে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে আবেগাপ্লুত হয়েছি। বন্ধুটি এখানে একজন জাপানি হয়ে বসবাস করছে যা আমার দিয়ে বাকি জীবনে সম্ভব হবে কিনা জানি না।
কারণ আমি মনে করি যেই জাতি তার মায়ের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে অন্য জাতি থেকে স্বাধীন হয়েছে আমি অন্তত সেই কাজটি করতে পারবো না। আমি নিজেকে বাঙালি বলতেই অনেক স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। আপনারা আমাকে সাথে রাখবেন। আমি এই জাপানে কিছুটা হলেও বাংলা, বাংলাদেশ আর বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
আমার আশা ও বিশ্বাস আপনাদের সহযোগিতা পেলে আমি কিছুটা হলেও সফল হবো। বলেই বলল, আমি আমার সেই বন্ধুকে তার জাপানি পাসপোর্ট নিয়ে কটাক্ষ করছি না। বলছি এই জন্যই যে আমরা যেহেতু পাসপোর্ট নিয়ে পুরোদমে জাপানি হতে পারছি না সুতরাং সেই পাসপোর্ট নিয়ে লাভ কি আমাদের। আমি অন্তত এতে কোনো রকম ক্রেডিট দেখছি না।
এরপর মিতুল মঞ্চ থেকে বক্তব্য শেষে নেমে আসলে সাদিক তার কাছে গিয়ে বসে। বসে বলল, মিয়া তুমি যে তোমার বক্তব্যে বলেছ, জাপানের পাসপোর্ট নেওয়া কি তুমি এতোই সহজ মনে করেছ যে চাইলেই করতে পারবে।
মিতুল তার সাথে আর এ নিয়ে কথা বাড়ানোর আগ্রহ দেখায় না। কারণ, সে দেখছে সাদিক খুব রেগে গেছে। তাই বলল, না না না। আমি তা বলছি না। আমি জানি তুমি অনেক যোগ্য। তোমার ছাড়া অন্য কারো বেলায় যে এটা আর করা সম্ভব হবে না, যা তুমি অসম্ভব ভাবছো। আমি ভাই পাসপোর্ট নেবো না, সে কথাই বলেছি।
সাদিক কন্ঠ উঁচু করে বলল, তুমি মিয়া করে দেখাও না। পারলে তো জাপানি পাসপোর্ট নিবা তুমি। পারো না দেখেই বলছো নিবানা। আমার এসব অনেক আগেই ঘেঁটে দেখা আছে।
সাদিকের কথায় মিতুল চুপ করে অনুষ্ঠানে অন্য বক্তাদের কথায় মনযোগ দেয়। একটু পর বক্তব্য পর্ব শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে। মিতুল ভাবে, বক্তব্য পর্ব শেষ হলে ব্র্যাক টাইমে সাদিককে হলের বাইরে নিয়ে কফি খাইয়ে ঠান্ডা করবে। সে যেন বিষয়টি নিয়ে তার সাথে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না করে।
এরপর সে খেয়াল করে, সাদিক তার এই পাসপোর্ট নেবার অহংকারে গদগদ করছে। তাই বিষয়টি নিয়ে মিতুল আর কথা না বাড়িয়ে হলের ভিতর চলে যায়।
(চলবে)
লেখক: জাপান প্রবাসী সাংবাদিক।
সান নিউজ/এমকেএইচ