পি আর প্ল্যাসিড
বাঙালিদের যখন দলে দলে জাপান আসার বিষয়টি কিছুটা স্থিতিশীল হয় তখন তাদের কেউ কেউ এখানে ভালো কোনো কাজ করার কথা ভাবেন। কাজ করার সুবিধার জন্য গড়ে তোলেন নানা সামাজিক সংগঠন এবং এনজিও প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অনেকেই আবার শুরু করেন ব্যবসা-বাণিজ্য।
তাদের মধ্যে একসময় আলোচনা হয় জাপানে দেশের জাতীয় দিবস উদযাপন করার বিষয় নিয়ে। মনে হলো একেক জন বা একেক সংগঠন জাপানে বাংলাদেশের একেক জাতীয় দিবস উদযাপন করার মধ্য দিয়ে এখানে কমিউনিটিতে নেতৃত্বের স্থান দখল করতে চাইছেন। একসময় তাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হলো বাঙালির প্রধান উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপনের। এই আলোচনার সংবাদ পেয়ে আবার বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হয়ে গেলো তাদের মাঝে। কে কার আগে কোথায় কাদের নিয়ে এই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবে তা নিয়ে।
জাপানে মিতুল কোনো রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠনের সাথে সরাসরি জড়িত হয়নি। এখানে তার পরিচয় সে একজন সাংবাদিক, তাই সব অনুষ্ঠানেই সে নির্দিধায় আসা যাওয়া করার সুযোগ পায়। শুরু হয়ে যায় টোকিওতেই কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে ভিন্নভাবে পহেলা বৈশাখের আয়োজনের প্রতিযোগিতা করা। মিতুল তার সাংবাদিকতার কাজ করার সুবিধায় সবগুলোতেই অংশ গ্রহণ করে। বিশেষ করে মিতুল পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজিত মেলায় বইয়ের স্টল দিয়ে বাঙালিদের মাঝে বাংলা বইয়ের প্রচার এবং প্রসার ঘটাতে কাজ শুরু করে।
একসময় মিতুলের মাথায় খেলে, এই মেলা উপলক্ষে সে দেশ থেকে বেশি করে খ্যাতিমান লেখকদের বই আনাবে। এ সময় জাপানে তার শুভাকাঙ্খীদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলে তাকে অনেকেই এ বিষয়ে সহযোগিতা দেবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। শুভাকাঙ্খীদের আশ্বাস পেয়ে সে দেশের খ্যাতিমান লেখক ইমদাদুল হক মিলনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। একসময় যোগাযোগ তার সাথে হয়েও যায়।
যোগাযোগ করলে তিনি বললেন, তার সাথে কথা বলতে দেশে যেতে। দেশে গিয়ে তার সাথে দেখা করে বিস্তারিত কথা বলতে বললেন। এদিকে জাপানে মেলার প্রচারণা শুরু হয়ে যায় পুরোদমে। সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে জানিয়ে দেয় মিতুল টোকিওতে অনুষ্ঠিতব্য বৈশাখী মেলা উপলক্ষে বিবেকবার্তা পত্রিকার পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত অতিথি আসছেন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক ইমদাদুল হক মিলন।
বিষয়টি তাদের কনফার্ম করে ঢাকা চলে যায় মিতুল। ঢাকা গিয়ে লেখক ইমদাদুল হক মিলনের সাথে দেখা করে কথা বলে রাজি করিয়ে আবার জাপান ফিরে আসে। এদিকে ক্রমেই মেলার সময় ঘনিয়ে আসছিলো। মিতুল তার নিজের কর্মব্যস্ততার কারণে দেশে আমন্ত্রিত অতিথির সাথে নিয়মিত যোগাযোগও করতে পারছিলো না। একদিকে তার প্রতিদিন কাজের চাপ অন্যদিকে সামাজিকতা এবং নিজের বক্তিগত কাজ, বিশেষ করে মেলা সংক্রান্ত কাজ নিয়ে নাভিশ্বাস উঠে যাবার উপক্রম।
কোনো দিগবিদিগ না দেখে তড়িঘড়ি করে আমন্ত্রিত অতিথি লেখক ইমদাদুল হক মিলনের জন্য আমন্ত্রণপত্র লিখে ই-মেইলে পাঠায় মিতুল। সেই আমন্ত্রণপত্র এবং লেখকের পাসপোর্ট নিয়ে লোক পাঠানো হয় বানানীস্থ জাপান দূতাবাসে। যাবার পরের দিনই তাদের পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেয়া হয় ভিসার সিল লাগিয়ে। তাদের বলতে, লেখকের সাথে আরো একজন যিনি দেশে মিতুলের নানা কাজ করেন তাকেও আমন্ত্রণপত্র দেয়া হয়েছিল। ভিসা হলে লেখক নিজেই ঢাকা থেকে টেলিফোন করে মিতুলকে জানান। সাথে সাথে তাকে টিকিট কাটার টাকার ব্যবস্থা করে বলা হয় মেলার দুই দিন আগে যেন ঢাকা থেকে ফ্লাই করেন তারা।
এদিকে কাজের জায়গা থেকে কোনোভাবে ছুটির ব্যবস্থা করতে পারে না মিতুল। সাপ্তাহিক দিন তো দূরের কথা সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও সে ছুটি পায় না কাজের জায়গা থেকে। মিতুলের সাথে আরো কয়েকজন বাঙালি কাজ করে। তারা দিনরাত কাজ করে টাকা রোজগার করার ফলে মালিক পক্ষ মিতুলকেও বলে তাদের মতো করে দিনরাত কাজ করতে। কিন্তু মিতুল বলে, আমি এতো কাজ করে টাকা রোজগার করবো ঠিক আছে কিন্তু সেই টাকা খরচই যদি করতে না পারি তাহলে এই টাকা রোজগারের কোনো মানে হয় না। টাকা রোজগার করে এই টাকা নিজের জন্য রিলাক্স করে খরচেরও সময় দরকার।
মালিক পক্ষ এর মধ্যে জেনে যান, মিতুল যে তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করা অন্য বাঙালিদের থেকে মন-মানসিকতা বা চলাফেরায় আলাদা। তারপরেও মিতুল যেহেতু অন্যদের থেকে কিছুটা হলেও ভাষা জানে বেশি তাই ছুটির দিন গুলোতে মালিক পক্ষের কেউ কাজে আসেন না। তাদের বিকল্প হিসেবে মিতুলকে মনে করে তাকে ছুটির দিনগুলোতে এসে একবার ওদের দেখে যেতে অনুরোধ করেন। দরকার হলে ফ্যাক্টরিতে এসে দুপুরে শুধু লাঞ্চ করে যেতে বলা হয় মিতুলকে।
কিন্তু মেলার আগে কোনোভাবেই কাজে আসতে রাজি হয়না মিতুল। এমনকি মেলার আগের দিন সে ফ্যাক্টরিতে কোনো নোটিশ না করেই এয়ারপোর্ট চলে যায় তার অতিথিদের রিসিভ করার জন্য।
এয়ারপোর্টে যাবার পর দেখা হলো মেলা উপলক্ষে আগত অন্য আরো অতিথিদের সাথেও। সেখানে ভিআইপি অতিথিদের সাথে কথা বলে মিতুল তার অতিথিদের নিয়ে চলে আসেন নিজের দায়িত্বে। এর আগে প্রবাসে তার এ ধরনের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় অনেকটাই অস্থির হয়ে যায় কিভাবে কি করবে মনে করে। তার এক বন্ধুকে দায়িত্ব দেয়া হয় অতিথিদের তার বাসায় রাখার জন্য। এদিকে মিতুল পরের দিন মেলার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
সেদিন রাতের মধ্যেই টোকিও এবং এর আশে পাশের জেলা শহরগুলোয় বসবাসরত বাঙালিদের কাছে সংবাদ পৌঁছে যায় দেশ থেকে খ্যাতিমান লেখক ইমদাদুল হক মিলন এসেছেন। লেখকের বাড়ি যেহেতু বিক্রমপুর এবং জাপানের অধিকাংশ বাংলাদেশির বাড়ি সেই এলাকায় তাই তাদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পায় মিতুলের আমন্ত্রিত অতিথির।
রাতভর মিতুলের বাসার ফোনে একটার পর একটা ফোন আসতে শুরু করে। ফোন আসা যেন থামেই না তার। একসময় মিতুল তার ফোনের রিসিভার তুলে নামিয়ে রাখে বিরক্ত হয়ে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় তখন আর সে পায় না খুঁজে। যারা ফোন করে তাদের সকলেরই আবদার একটাই, ইমদাদুল হক মিলনকে নিয়ে তাদের বাসায় একদিন বেড়াতে যেতে হবে কিংবা দেখা করতে চান। সময় দিতে হবে, এমনই সবার অনুরোধ। মিতুল সকলকে এই বলে জানিয়ে দেয় যে, পরের দিন মেলায় আসলেই দেখা হবে। সময় মতো যেন সবাই মেলায় চলে আসেন। মেলায় আসলেই দেখা এবং কথা হবে অতিথির সাথে। কথা শেষে সবাইকে শর্ত জুড়ে দেয় মিতুল, লেখকের একটি করে অন্তত বই কিনতে হবে।
সবারই কথা, বই তারা একটা নয় প্রয়োজনে দশটা কিনে নিবে। অনেকে আবার এটাও স্বীকার করে বলে যে, তারা বই পড়তে পারে না তারপরেও বই নিয়ে মিতুলকে সহযোগিতা করবে। বিক্রমপুরবাসীর কথা তারা তাদের নিজের এলাকার খ্যাতিমান এই লেখককে মূলায়ন করতে বা সম্মান জানানোর কথা ভাবেনি কখনো অথচ মিতুল ভেবে কাজটি সফল হয়েছে তাই তারা অনেক খুশি। তাদের এলাকার একজন খ্যাতিমান লেখককে জাপানে আমন্ত্রণ করে সম্মান দেবার জন্য সবার একই কথা, "ধন্যবাদ মিতুল ভাই আপনাকে"।
ইমদাদুল হককে আমন্ত্রণ জানানোর কারণে অনেকেরই তখন ধারণা হয় মিতুলের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর এলাকাতেই হবে হয়তো। তাই ফোন করে অনেকে আবার জানতে চায় মিতুলের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর কোথায়?
মিতুল সবাইকে একই কথা বলে, সে জাপান আসার আগে অনেক বিক্রমপুরবাসীর সাথে মেলা মেশা করলেও কখনো সে বিক্রমপুর যায়নি। বাড়ি তো দূরের কথা। একথা শুনে সবাই অবাক হয়। অনেকের সেই এক কথা, তার বাড়ি বিক্রমপুরে নয়, অথচ সে বিক্রমপুরের এই লেখককে কেন জাপান এনেছেন তাহলে? মিতুল ভাবে, যার চিন্তার দৌড় যতটুকু ততটুকুই চিন্তা করে কথা বলবে, এটা দোষের কিছু নয়।
পরেরদিন মিতুল সকাল সকাল মেলা প্রাঙ্গনে গেলে অনেকেই চলে আসে তার স্টলের সামনে। এসে ভিড় জমায় লেখকের খোঁজে। সবার উৎসুক চোখ দোকানের দিকে, কোথায় তাদের লেখক? তাদের চোখ জোড়া সার্চ লাইটের মতো করে লেখককে খুঁজতে থাকে। অনেকে আবার এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে, - মিলন ভাই কোথায়? মেলা প্রাঙ্গনে কখন আসবেন তিনি। মিতুল তার স্টল সাজানো নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে সবার সাথে প্রাণ খোলা কথা বলে তখন উত্তর দিতে পারে না। তাই পরে আসার কথা বলে।
মেলা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার আগে আগে মিতুলের বন্ধু তার অতিথিদের নিয়ে এসে হাজির হয় মেলা স্থলে। এসময় সব রেখে লোকের ভীড় জমে মিতুলের বিবেকবার্তার স্টলে। আর এই সুযোগে লেখক ইমদাদুল হক মিলন সেখানে এসেই তার ভক্তদের হাতে বই তুলে দিতে শুরু করে দেন। সবাই তখন তাঁর অটোগ্রাফ নেবার জন্য অস্থির।
অনুষ্ঠান শুরু হলো। মাইকে মিতুলের অতিথি দেশ থেকে আগত খ্যাতিমান লেখক ইমদাদুল হক মিলনকে মঞ্চে আহ্বান করে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। সাথে মিতুলকেও ডাকা হলো মঞ্চে। মেলা কমিটির পক্ষ থেকে মিতুলকে ধন্যবাদ দেয়া হয় মেলায় দেশ থেকে এই ভিআইপি অতিথি এনে মেলাকে আরো সফল করে তোলার জন্য।
মিতুল এসময় মনে করলো সে এবার টোকিওতে বাঙালি কমিউনিটির সাথে আগের থেকে আরো বেশি কাজ করার সুযোগ পাবে। সে অন্তত এখানে তার যে চিন্তা চেতনা তার প্রতিফলন ঘটাতে পারবে এখন থেকে কমিউনিটির সকল শ্রেণীর বাঙালিদের সাথে মিশে।
এ সময় বিভিন্ন জন এসে মিতুলের কন্টাক্ট নম্বর চেয়ে নিতে থাকে। পরবর্তীতে তার সাথে যোগাযোগ করবে বলে। একথাও বলে যান সবাই যে লেখককে নিয়ে তাদের সময় দিতে হবে। মেলার দিন শতাধিক বাঙালি মিতুলের স্টলে এসে কথা বলে লেখকের অটোগ্রাফ সহ বই নিয়ে যায়। পরিচিত হয় একে অপরের সাথে বিক্রমপুরের বাসিন্দা বলে।
পরের দিন টোকিওতে দেশ থেকে আগত অতিথিদের সংবর্ধনা দেবার কথা বলা হয়। মেলায় জাপানের ব্যবসায়ী কমিটি তাদের ব্যবসার প্রচার করতে দু'জন টিভি ব্যক্তিত্বকে জাপানে আমন্ত্রণ করেছিল ঠিক একই সময়। তাদেরকেও সেখানে আসতে বলা হয় একই মঞ্চে সবাইকে সম্মান দেখানোর ব্যবস্থা করা হবে বলে। আয়োজনে থাকবে জাপানের বাঙালি কমিউনিটি।
সপ্তাহিক দিনে সবাই কাজে থাকে ব্যস্ত। যে কারণে চাইলেই সবাই সাপ্তাহিক দিনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারে না। তারপরেও সেদিন হল ভরা ছিল উপস্থিতি দিয়ে। অনুষ্ঠানের শুরুতেই মিতুলকে কিছু বলতে সুযোগ দেয়া হয় অনুষ্ঠানের আয়োজকদের পক্ষ থেকে। মিতুল মঞ্চে গিয়ে হাতে মাইক নিয়ে তার মতো করে বক্তব্য শুরু করে।
শুরুতে মিতুল বললো, - আমি ছাত্রজীবনে দেশে এমনই অনেক কাজ করে এসেছি। জাপানে এসে আপনাদের সাথে এতো সুন্দর প্রশংসনীয় কাজে যুক্ত হতে পেরে সত্যি প্রাউডফিল করছি আমি। আমার অন্য কোন স্বার্থ নেই নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এমন কিছু করায়। তবে এটুকু বলতে পারি আমি যে, আপনাদের টোকিওতে মেলায় দেশ থেকে দু'জন ভিআইপি অতিথিকে আমন্ত্রণ করে আনতে পেরে মনে হচ্ছে সুন্দর কাজের একটি পিলার হতে পেরেছি। এজন্যই ভালো লাগছে আমার নিজের কাছে। আগামীতেও আমি আপনাদের এমন সুন্দর সৃষ্টিশীল কাজে পাশে থাকার জন্য চেষ্টা করবো। যদি আপনারা আমাকে সেই পিলার মনে করে কাজ করার সুযোগ দেন।
মিতুলের কথা শুনে অনুষ্ঠানের আয়োজকদের সকলেই খুশি। সিরিয়াল ভেঙে মূল আয়োজক মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে নিয়ে তখন মিতুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমারা চাই মিতুল আমাদের সাথে থাকবেন। আমাদের কাজে আপনার মেধা এবং ক্রিয়েটিভিটি কাজে লাগাতে চাই।
সেদিনের পর থেকে মিতুল টোকিওর নানা অনুষ্ঠানাদিতে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত হতে শুরু করে। সকলের কাছে হয়ে উঠে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য একজন।
(চলবে)
লেখক, জাপান প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক।