শিল্প ও সাহিত্য
জাপানের গল্প - ১১

মানবিক ও সামাজিক হয়ে উঠা  

পি আর প্ল্যাসিড

এক সকালে রেস্টুরেন্টে ঢোকার আগে মিতুল ভাবে দেশ থেকে তার কোনো চিঠি এসেছে কিনা? সেই ইচ্ছা থেকে গেইটের সাথে লাগানো চিঠির বাক্স খুলে দেখে নীল খামে তার নামে একটা চিঠি। তাও চিঠিটি জাপান থেকেই আসা। দেখে অবাক হয়ে তখনই গেইটে দাঁড়িয়ে চিঠিটি খুলে। খুলে দেখে চিঠিটি ইংরেজিতে লেখা। উপরে নাম ঠিকানা লেখা থাকলেও চিঠি খোলার আগে সেটা মন দিয়ে দেখেনি। চিঠি ইংরেজিতে লেখা দেখে আবার খামের উপর ভালো করে প্রেরকের নাম ঠিকানা দেখে মিতুল। চিঠির উপর হাতে নীল কালিতে লেখা রয়েছে ফাদার খ্রিস্টিয়ায়েন, ফ্রম সেতাগায়া, টোকিও। দেখেই সে চিঠিটি পড়তে শুরু করে। পরে হাতে করে সেভাবেই নিয়ে রেস্টুরেন্টের কিচেনের পিছনে তার কাপড় পরার রুমে আলাদা লকার রয়েছে সেখানে রাখে।

দুপুরে লাঞ্চের সময় সে আবার চিঠিটি পড়ে। সেখানে চিঠির সাথে নাম ঠিকানা এবং টেলিফোন লেখা রয়েছে দেখে সে রেস্টুরেন্টুর বাইরে যায়। রাস্তার ধারে ফোন বুথের কাছে গিয়ে হাতের চিঠিতে লেখা ফোন নম্বর দেখে টেলিফোন করে সে। ফোন রিসিভ করেন এক মহিলা। বুঝতে পারে এটা কোন প্রতিষ্ঠানের রিসিপশনের কেউ রিসিভ করেছে। মিতুল নিজের পরিচয় দিয়ে অনুরোধ করে বললো, সে ফাদার খ্রিস্টিয়ায়েনকে চায়। তখন অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো, এখন ফাদার ফোন ধরবেন না। তিনি রেস্টে আছেন। ফোন করলে বিকেল তিনটার পর পাঁচটার আগে যেন করেন।

মিতুল জানালো, এ সময় সে কাজে থাকবে। সে কারণে তার পক্ষে এ সময় ফোন কল করা সম্ভব হবে না। ফাদার যদি কিছু মনে না করেন তাহলে যেন তার কাজের জায়গাতে ফোন করেন। বিষয়টি মনে হয় রিসিপশনের সেই মহিলা বুঝতে পেরে ফাদারকে এখনই গিয়ে বলবেন বলে জানালেন। ফাদার যদি চান তাহলে কলব্যাক করবেন। মিতুল টেলিফোনে কথা বলে, কথা শেষ করে মিতুল রেস্টুরেন্টে এসে কিচেনের পিছনে তাদের স্টাফদের বিশ্রামের জন্য আলাদা ঘর রয়েছে, সেখানে বসে বিশ্রাম করছিলো। এমন সময় বাইরে হলের একজন স্টাফ এসে মিতুলকে বললো, তার ফোন কল এসেছে।

সে তখন দৌড়ে যায় তার ফোন কল রিসিভ করতে। ফোন রিসিভ করে মসি মসি বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে ইংরেজিতে বললেন, হ্যালো আই এম ফাদার খ্রিস্টিয়ায়েন। হাউ আর ইউ মিতুল?

মিতুল তাকে করা "হাউ আর ইউ"-র উত্তর দিতে গিয়ে যেন গোলমাল লাগিয়ে ফেলে। সে কিভাবে কি উত্তর দিবে তা ভাবে। তাও আবার ইংরেজিতেই দিবে নাকি জাপানি ভাষায় দিবে, সেটা ভাবতেই ত্রিশ সেকেন্ড সময় চলে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই ফাদার আবার প্রশ্ন করলেন, - আই মেট ইউর ব্রাদার ইন ব্রাজিল। দেয়ার ওয়াজ এ মিটিং অব ইন্টারনেশনাল ক্যাথলিক প্রেস কনফারেন্স। আই এটেন্ড দেয়ার। এন্ড দিস ইয়ার আই সিলেক্টেড এ বোর্ড মেম্বার অব দেট অরগানাইজেশন। ডু ইউ নো এবাউট দ্য অরগানাইজেশন?

মিতুল উত্তর দেয়, - ইয়েস, আই ডু। আই গট ইউর লেটার এন্ড আই নো এবাউট ইউ অন দ্য লেটার।
- ডু ইউ স্পিক জাপানিজ?
- ইয়েস। স্কোশি হানাসেমাস।
- হুইচ ল্যাংগুয়েজ ডু ইউ স্পিক বেটার?
- বোথ আর সেম।
এবার মিতুল তার মতো করে জাপানি আর ইংরেজির মিশ্রণে ফাদারের সাথে কথা বলে। ফাদার বললেন, - আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। কোনদিন তোমার জন্য ভালো হয়, বললে আমি নিজে তোমার ওখানে যেতে পারি।
মিতুল বললো, আমার জন্য শনি-রোববার ছাড়া অন্য যে কোনো দিন হলে ভালো হয়। তবে সোমবার দিন আমাদের রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকে।
এরপর সব ফাইনাল করে ফোন রাখে। ফাদারের সাথে কথা বলে তার ভিতর যেন প্রশান্তিতে ভরে যায়। অন্য রকম আনন্দ অনুভব করতে থাকে তখন মিতুল। মনে মনে অহংবোধ করে, জাপানের মতো দূর দেশেও তার খোঁজ নেবার মতো কেউ আছেন ভেবে। তাও আবার একজন বিদেশি পুরোহিত। মিতুল দেশে থাকাকালে এই পুরোহিতদের থেকে কিছুটা দূরে থাকলেও যারা স্বভাব চরিত্রগতভাবে ভালো তাদের কাছে গিয়ে সময় কাটাতো। আজ তার সেই কথাই মনে পড়ে।

পরের সপ্তাহেই একদিন ফাদার খ্রিস্টিয়ায়েন মিতুলের কর্মক্ষেত্র ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে আসেন। এসে নিজের মতো করে খাবারের অর্ডার দিয়ে খেয়ে হলের একজন স্টাফকে প্রশ্ন করলেন, এখানে মিতুল নামে কেউ আছেন? থাকলে তার সাথে দেখা করে তিনি কথা বলতে চান।
সেই সময় রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের ভিড় অনেকটা কমে যায়। সেই স্টাফ তখন কিচেনের ভিতরে গিয়ে মিতুলকে বললো, হলে একজন গেস্ট তার সাথে কথা বলতে চান। বলার পর মিতুল তা বুঝতে পারে। তাই সাথে সাথে সে হাতের কাজ সব একদিকে সরিয়ে রেখে বাইরে এসে দেখেন জানালার ধারে এক টেবিলে বসে খাবারের শেষ পর্যায় কাটা চামুচ নাড়ছেন ফাদার খ্রিস্টিয়ায়েন।

মিতুল দেখেই বুঝতে পারে, এই-ই যে ফাদার খ্রিস্টিয়ায়েন। সামনে গিয়ে মিতুল বললো, - কনিচিউয়া। ওগেনকি দেসকা?
ফাদার মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, - হাই মিতুল, গেনকি দেস। তোমার রান্না কারি খেলাম। অনেক স্বাদ হয়েছে।
- আরিগাতো, আরিগাতো গোজাইমাস। আপনি এসেছেন আগে বলবেন না? আর কি কিছু লাগবে আপনার?
- আমাকে তোমাদের মাসালা টি দিতে পারো।
- ফাদার আপনার কি হাতে সময় আছে? একটু পরেই আমার বিশ্রামের সময়। গেস্ট সব চলে গেলে না হয় আমি আপনার সাথে বসে কথা বলি?
ফাদার তাকে কোনো তাড়াহুড়ো করতে মানা করে বললেন, - তার হাতে যথেষ্ট সময় আছে। টেনশন করতে মানা করে আবার বললেন, আজ আমি শুধু তোমার জন্যই সময় রেখেছি। তবে সন্ধ্যার আগে মিশনে ফিরলেই হবে।

ফাদার বলার পর মিতুল সাময়িক সময়ের জন্য বিদায় নিয়ে আবার কিচেনের ভিতর চলে যায়। গিয়ে ফাদারের জন্য নিজে যতটা পারে ডেজার্ট বানিয়ে সার্ভিস দিতে থাকলে ফাদার হলে থাকা স্টাফকে ডেকে বললেন, - তার পক্ষে এতো কিছু খাওয়া এখন আর সম্ভব নয়। এখন এক কাপ চা দিলেই চলবে। বলে বাড়তি খাবার ফিরিয়ে দেন। দুপুরে মিতুলের বিশ্রামের সময় শুরু হলে মিতুল কিচেন থেকে বাইরে হলে এসে ফাদারের সাথে কথা বলতে শুরু করে। পরিচয় হয় ফাদারের সাথে নতুন করে আবার।

ফাদার খ্রিস্টিয়ায়েন বললেন, তার বাড়ি বেরুগি (বেলজিয়াম)। তিনি জাপান আছেন প্রায় চল্লিশ বছর হয়। যে সময় তিনি জাপান আসেন তখনকার এই জাপান আর এখনকার জাপানের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। সবকিছুই বদলে গেছে তার চোখের সামনে। প্রতিবছর তিনি জাপানি টিম নিয়ে দেশে যান বেড়াতে। সেখানে তিনি তার নিজের উদ্যোগে একটি স্কুল, একটি চিকিৎসালয় এবং একটি বৃদ্ধাশ্রম চালান। যার পুরো ফান্ড পান এই জাপানের সাধারণ খ্রিষ্টভক্তদের কাছ থেকে। পরে বললেন, আমি তোমার ভাইয়ের কাছে শুনেছি তোমার নাকি ভিসার মেয়াদ কেটে গেছে। জাপানে এখন তার চলাফেরায় কোনো ধরনের সমস্যা হয় কিনা, প্রশ্ন করলেন ফাদার খ্রিস্টিয়ায়েন।

মিতুল জানায়, চলাফেরায় কোনো সমস্যা হয় না। তবে ইমিগ্রেশনের হাতে ধরা পড়লে এমনও হতে পারে তাকে দেশে পাঠিয়েও দিতে পারে, হয়তো। তার ঠিক নেই।
মিতুলের কথা শোনার পর ফাদার বললেন, - তুমি এক কাজ করো, তোমার ছুটির দিনে আমার ওখানে চলে এসো। আমি তোমাকে একজন টিচার রেখে দেবো ভাষা শিখার জন্য। এর মধ্যে যদি সম্ভব হয় ভালো কোনো মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দেবো। এছাড়া তো তোমার আর জাপানে বৈধভাবে থাকার কোনো সুযোগই নেই।

ফাদার বললেন, - তোমার ভাই আমাকে অনুরোধ করে বলেছেন, তোমার ভালো কোনো ব্যবস্থা করে দিতে। এই সময় তুমি দেশে গেলে কোনো ভালো কিছু করতে পারবে না। এখানে থেকে কিছু করতে চাইলে করতে পারো। তা ছাড়া আমি নিজেও এই দেশে যেহেতু একজন বিদেশি সুতরাং জাপানে বিদেশিদের জন্য আমার জানা মতে ভালো কোনো আইন নেই। সারাজীবন থাকলেও তোমাকে এখানে ওরা নাগরিকত্ব দিবে না। বিদেশিদের জন্য ওদের আইন খুব কড়া। তবে একমাত্র কোনো জাপানি মেয়েকে বিয়ে করলেই স্থায়ীভাবে থাকার একটা সুযোগ পেতে পারো।

মিতুল বললো, - ফাদার এখানে থেকে কি করবো। নিজে ভালো থেকে দেশে আত্মীয়-পরিজনকে খারাপ রেখে কি চলা যায়। এটা তো স্বার্থপরের জীবন হয়ে গেলো।
- চাইলে দেশে তোমার পরিবারের জন্য কিছু করবে। তারা তো তোমার কাছে অনেক কিছু চায় বলে মনে হয় না।

ফাদার মিতুলকে আবার বললেন, - আমি প্রতি সপ্তাহে একদিন জাপানের বিভিন্ন হাসপাতালে যাই রোগী দেখতে। মাসে দুইদিন যাই টোকিও ইমিগ্রেশনে। সেখানে অনেক বিদেশি রয়েছে যারা জাপানে ভিসা ছাড়া থাকার অপরাধে কেবল বন্দী আছে। তাদের সাথে দেখা করে তাদের জন্য প্রার্থনা করি। চাইলে তুমিও আমার সাথে যেতে পারো।
- আমার তো ভিসা নেই। সমস্যা হবে না?
- আমার সাথে গেলে কোনো সমস্যা হবে না। অনেক ইমিগ্রেশন অফিসারের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক আছে। তাদের তোমার সম্পর্কে বলেই নিয়ে যাবো। দেখবে ওখানে বিভিন্ন বিদেশি কত অসহায়ভাবে জীবন কাটাচ্ছে। শুনেছি তুমি নিজেও দেশে একসময় সাংবাদিকতা করতে। ওখানে এসব দেখে ওদের নিয়ে তুমি লেখালেখি করতে পারবে।

ফাদারের এমন কথা শোনার পর নিজেকে অন্যরকম মানুষ ভাবতে শুরু করে মিতুল। ফাদারের সাথে এখানে জেলে বন্দী বিদেশিদের দেখতে যাবে, হাসপাতালে যাবে রোগী দেখতে। এ যে সাক্ষাৎ মাদার তেরেজার মতোই মানুষের সেবাদানের কাজ। এ কাজে মানুসিক যে শান্তি আর তৃপ্তি পাওয়া যায় এটা কখনো কোটি টাকার বিনিময়েও পাওয়া যায় না। তাই বিষয়টি ভাবতেই তার ভিতর যেন স্বর্গীয় সুখ কাজ করে।

তখন মিতুল ফাদারকে বললো, - ফাদার আমি প্রতি সপ্তাহে সোমবার আপনার চার্চে আসবো। সেখানে আপনি টিচার রেখে জাপানি ভাষা শেখার ব্যবস্থা করে দিলে আমি আপনার সাথে এই সমাজসেবার কাজগুলোর সাথে জড়িত হতে চাই। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করবেন আমি যেন মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করতে পারি।

এরপর সেদিন ফাদার চলে যাবার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনগুলো টোকিওর সেতাগায়া চার্চে গিয়ে সময় কাটায় মিতুল। সেখানে তার জন্য একজন বয়স্ক শিক্ষিকা ঠিক করেন, যিনি প্রতি সপ্তাহে মিতুলকে জাপানি ভাষা শিখান। পুরোটাই ছিলো তার ভলেন্টিয়ার হিসেবে ভাষা শেখার পর ফাদারের সাথে মানুষের কল্যাণে তার কাজে সহযোগিতা করার জন্য। মাঝে মধ্যে ফাদার তাকে সাথে করে মটরসাইকেলের পিছনে বসিয়ে নিয়ে যান বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের সাথে দেখা করতে। সেখানে গিয়ে যে সকল রোগীর কেউ নেই, অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে হাসপাতালের বিছানায় সেসকল রোগীর সাথে কথা বলে তাদের মন ভালো রাখার চেষ্টা করেন। এ থেকে মিতুলও হয়ে উঠে অনেকটা মানবিক আর সামাজিক।

(চলবে)

লেখক, জাপান প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক।

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

নলছিটিতে ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু

ঝালকাঠি প্রতিনিধি: ঝালকাঠির নলছিটিতে শুরু হয়েছে ভূট্টো স্মৃত...

সবজির বাজারে স্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে কমেছে পেঁয়াজ, সবজি...

স্বামীকে মৃত দেখিয়ে মামলা, নারী আটক

জেলা প্রতিনিধি : সাভারের আশুলিয়ায় জীবিত স্বামীকে বৈষম্যবিরোধ...

বৈষম‌বিরোধী আন্দোলনে বেঁচে ফেরার আশা করেনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন আন্দোল&zwnj...

বড় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলেন পূজা 

বিনোদন ডেস্ক: ঢাকাই চিত্রনায়িকা ও মডেল পূজা চেরি ডজনখানেক ছব...

সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি

নিজস্ব প্রতিবেদক : বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছ...

ফের বাড়ল সোনার দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বাজারে ফের সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা...

ফের হারলো সাকিবের দল

স্পোর্টস ডেস্ক : আবুধাবির টি-টেন টুর্নামেন্টে ফের হারের মুখ...

নোয়াখালীতে দুই গৃহবধূর লাশ উদ্ধার

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীতে পৃথক স্থান থেকে দুই গৃহবধূর...

ঢাকাবাসীকে নিরাপদ রাখতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকাবাসীকে যেকোনো উপায়ে নিরাপদ রাখতে হবে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা