শিল্প ও সাহিত্য
জাপানের গল্প - ১০

মাসাকো সানের প্রস্তাব  

পি আর প্ল্যাসিড

কোনো এক শনিবার। দুপুরের পরপর কয়েকজন মহিলা হাসপাতালে এসে মিতুলের সাথে দেখা করতে চাইলে তাদেরকে ভিজিটরস রুমে বসিয়ে রেখে কর্তৃপক্ষ মিতুলের কেবিনে এসে জানতে চায় তাকে দেখতে আসা মহিলাদের ভিতরে আসার অনুমোদন দিবে কিনা। মিতুল একসাথে এতো জন জাপানি মহিলার আগমনে অনেকটাই ভয় পেয়ে বললো, আমি আমার কর্তৃপক্ষের সাথে আগে কথা বলি। কর্তৃপক্ষ কি বলেন তা জেনে তোমাদের জানাচ্ছি। তার আগে তোমরা তাদের ভিতরে আসার অনুমতি দিও না। বলেই সে হাসপাতালের যেখানে পাবলিক টেলিফোন বুথ রয়েছে সেখানে গিয়ে ফোন করে তার কর্মস্থলে।

ফোন করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে সেখান থেকে তাকে জানায়, এই মহিলা কয়েকজন কিছুদিন আগে তার কর্মস্থলে এসেছিলেন মিতুলের সাথে দেখা করতে। তারা তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেই মিতুলের হাসপাতালে ভর্তি থাকার কথা জানিয়ে দেখা করতে বলে।

কর্মস্থলে ফোন করে বিষয়টি পরিষ্কার হলে পর মিতুল আবার নার্স সেন্টারে যায়। গিয়ে দায়িত্বে থাকা নার্সকে ডেকে তার সাথে দেখা করতে আসা মহিলাদের দেখা করার অনুমোদন দিতে বলেই সে সামনে যেখানে রোগীরা তাদের দর্শনার্থী বা সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাথে দেখা করে কুশল বিনিময় করে সেখানে গিয়ে বসলে কয়েকজন মহিলা তার সামনে এসে শুভেচ্ছা দিয়ে নিজেদের পরিচয় দেন। তাদের একজনের নাম মাসাকো।

মিতুলের বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বয়স্ক এই মহিলা ভালো ইংরেজি বলতে পারেন। সেই তুলনায় মিতুলের ইংরেজি অনেক দুর্বল। ইংরেজিতে কথা চালাতে পারে ঠিক, কিন্তু কথা বলতে মুখ তো বাঁকা হয়ই, পুরো শরীরও আঁকা-বাঁকা করে ফেলে মিতুল। মাত্র কয়েক মাস হয় মিতুল জাপানে এসেছে। এখনও দিকপাশ ভালো করে কোনো কিছু চিনে না সে। মিতুল জাপান এসেছিলো আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে। এসে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিছুদিন না যেতেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় মিতুলকে শরীর খারাপ করায়।

কাজ করার সময় হঠাৎ একদিন অবস্থার অবনতি হলে কর্মক্ষেত্র থেকেই তাকে এ্যাম্বুল্যান্সে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেই থেকে প্রায় একমাস হয়ে গেলো মিতুল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালে থাকায় দেশে কারো সাথে তার যোগাযোগ হয় না। পুরো পরিবেশ মিতুলের কাছে বন্দীজীবনের মতো মনে হয়। যেদিন এই মহিলা কয়জন হাসপাতালে তাকে দেখতে আসেন, তার ঠিক এক সপ্তাহ পরেই মিতুল জাপানে অবৈধ হয়ে যাবে। সে জানে এই মূহুর্তে তার ভিসা এক্সটেনশন করার আর কোনো উপায় নেই। এজন্য কর্মক্ষেত্র থেকে তাকে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে, অপরিচিত কেউ তাকে হাসপাতালে দেখা করতে আসলে কারো সাথেই যেন দেখা করার অনুমোদন দেয়া না হয়। তাই মিস মাসাকোর সাথে আসা দলের সাথে দেখা করতে আপত্তি ছিলো তার।

মিস মাসাকো বুঝতে পারলেন মিতুল যে তার সাথে কথা বলতে কিছুটা হলেও ভয় পাচ্ছে। তাই শুরুতেই তার নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন,- আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। সেখানে তোমার এক জ্যাঠামনির সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। উনি আমাকে চিঠি লিখে তোমার সম্পর্কে জানিয়েছেন। লিখেছেন তুমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছো। আমি যেন তোমাকে হাসপাতালে এসে দেখা করি, তাই দেখা করতে এলাম। তুমি তো ঠিক মতো গির্জায়ও যেতে পারছো না মনে হয়, আমি তোমার বিষয়টি আমাদের গির্জায় ফাদারকে বলে দেবো। ফাদার তোমাকে দেখতে আসার পর তুমি চাইলে ফাদারের সাথে তোমার সমস্ত কিছু খুলে বলতে পারো। সব কিছু খুলে বললে দেখবে তোমাকে উনি জাপানে থাকার জন্য অনেক সহযোগিতা করতে পারবেন।

জাপানি ভাষা খুব ভালো বলতে না পারার কারণে তাদের সাথে বাড়তি কোনো কথাই মিতুল বলে না। থেকে থেকে সে মিস মাসাকো আর তার সাথে আসা অন্যদের দিকে তাকিয়ে কেবল হাসে। এক সময় মিস মাসাকো তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, তার শরীরের কন্ডিশন কি তারা আসার আগে কিছুই জানতেন না। তাই মিতুল কি খায় আর কি করতে পছন্দ করে, জানা না থাকায় তার জন্য ইংরেজিতে লেখা কিছু ধর্মীয় বই আর নগদ টাকা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। এই টাকা তার কোনো কাজে আসলে তাদের কষ্ট করে আসাটা সার্থক হবে বলে জানালেন।

এরপর মিস মাসাকো বেশ আস্তে ধীরে মিতুলের কাছে তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। জাপানে সে কি করতে চায়? এখানে থাকলে যে তার জন্য কোনো ভালো কিছু হবে না। তার জ্যাঠামনি নাকি লিখেছেন, সে যেন দেশে ফিরে যায়, দেশে গেলে কিছু একটা করে চলতে পারবে। তাই মিতুল সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে বললেন,- তুমি একটা কাজ করতে পারো।

মিতুল তাদের দিকে তাকায়। এ সময় একজন নার্স এসে সবার সামনে মিতুলকে তার শরীরের তাপমাত্রা মাপার জন্য একটা থার্মোমিটার ধরিয়ে দিয়ে বললো, বেশি সময় তোমার বাইরে থাকা ঠিক হবে না। বিছানায় গেলেই তাকে স্যালাইন দেয়া হবে। নার্সের কথা শুনে মিস মাসাকো এবং তার সঙ্গে আসা সবাই নার্সকে বললেন, তারা বেশি আর দেরি করবেন না। প্রয়োজনে অন্য আরেকদিন আবার আসবেন দেখা করতে। বলেই অনুরোধ করে বললেন, আর অল্প কিছু সময় যেন তাদের দেয়া হয়। বলার পর নার্স মিতুলের কাছ থেকে থার্মোমিটার ফিরিয়ে নিয়ে তাপমাত্রা দেখে নোট করে কোনো কিছু না বলে ফিরে চলে যান।

মিস মাসাকো মিতুলের হাতে ধর্মীয় বই কয়টা দিয়ে অনুরোধ করে বললেন, সময় সুযোগ করে যেন ঈশ্বরকে সে স্মরণ করে। এরপর একটা সাদা খাম তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে কিছু জাপানি মুদ্রা রয়েছে। ভালো-মন্দ কোনো কিছু খেতে মন চাইলে এ দিয়ে যেন কিনে খায়। বলার পর আবার বললেন,- আমাদের গির্জায় ব্যবসায়ীদের একটা সংগঠন আছে। বাংলাদেশে গরীব এলাকায় আমরা সাহায্য করি। তুমি চাইলে আমরা তোমাকে কিছু মূলধন দিয়ে সাহায্য করতে পারি। যদি দেশে গিয়ে ছোট খাটো কোনো ব্যবসা করতে চাও তা দিয়ে তুমি করতে পারবে। আমরা শুনেছি জাপানের ইমিগ্রেশন আইন আগের চেয়ে দিনদিন অনেক কঠিন হচ্ছে। ভিসাবিহীন কোনো বিদেশিদেরই জাপানে আর থাকতে দেয়া হবে না। তাই এখানে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলখাটার চেয়ে দেশে ফিরে যাওয়া মঙ্গলজনক হবে। আবার বললেন, - তা ছাড়া তোমার পরিবার মনে হয় তা-ই চান।

মিতুল তাদের কথা শুনে বললো, - আমি চাই এখানে থেকে আমি নিজেই আমার ভাগ্য বদলাতে। আপাতত ফিরে যাবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তোমরা আমাকে যে সুন্দর এবং লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছে আমি তা রাখতে পারছি না। জাপান এমন একটা দেশ, যে দেশে থেকে কাজ করলে আমাদের দেশে গিয়ে যে কোনো সময় ভালো কিছু করা সম্ভব। যদি সুস্থ থাকা যায়। ঈশ্বরকে আমি হাজারবার ধন্যবাদ দেই তিনি আমাকে জাপানের মতো এতো উন্নত দেশে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন। তোমরা আমার জন্য একটু প্রার্থনা করলেই চলবে। বাকিটা আমার ভাগ্য। ঈশ্বরই ভালো জানেন, তিনি আমার ভাগ্যে কী লিখে রেখেছেন। তার ইচ্ছার বাইরে আমার কোনো কিছুই করা হবে না। তাই আমার জীবনের সবটাই তার উপর আমি সমর্পণ করে রেখেছি। বলেই মিতুল তাদের শুনিয়ে বললো, থ্যাংকস গড। বলার পর মিস মাসাকো বললেন, প্রেইজ দ্য লর্ড। আমেন।

পুরো হাসপাতালে সন্ধ্যার মিউজিক বাজছে। এই মিউজিক বাজিয়ে রোগী যারা এখনো নিজেদের কেবিন বা বিছানায় ফিরে যায়নি তাদের ফিরে যাবার সংকেত দিচ্ছে। আশেপাশের লাইটের আলো দেয়া হয়েছে কমিয়ে। এক সময় মিউজিক থামে। কয়েক মিনিট পর আবার মিউজিক বেজে উঠে। এবারের মিউজিক একটু ভিন্ন প্যাটার্নের। এই মিউজিক বাজানো মানে বাইরের কোনো দর্শণার্থী রোগীদের সাথে কথা বলতে থাকলে তারা যেন সত্বর হসপিটাল ত্যাগ করেন এবং রোগীরাও যেন নিজেদের নির্ধারিত সিটে ফিরে যান। এবারে চূড়ান্ত সতর্ক বার্তা জানানো হয় এই ভিন্ন ধরনের মিউজিক বাজিয়ে।

হাসপাতালে বেশ ক'দিন অতিক্রম হয়ে যাওয়াতে মিতুল নিয়ম-কানুন অনেকটা বুঝতে পারে। তাই মুখে সে কিছু না বললেও মিস মাসাকোকে বললো,- আমি আপাতত দেশে ফিরে যাবো না। আমাদের দেশের বর্তমান সার্বিক অবস্থা খুব ভালো না। বিশেষ করে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীল। নতুন কোনো ব্যবসা করার মতো উদ্যোক্তাদের অনুকূলে নয়। আপাতত জাপানে কাজ করে টাকা রোজগার করি। যদি কখনো মনে হয় দেশে ফিরে গিয়ে কিছু করা সম্ভব, তবেই না হয় ফিরে যাবো।

আমি নিজের সাথে নিজে চ্যালেঞ্জ করতে খুব পছন্দ করি। আপাতত নিজে কিছু করার চেষ্টা করবো। যখন মনে হবে কিছু করতে অপারগ তখন মিতুল তাদের এই সহযোগিতার জন্য স্মরণ করবে। বলেই বললো, আমার বিপদে তোমরা আমার পাশে তখন থাকলেই হবে, এখন নয়।

কথা বলে মিস মাসাকো তার সাথে আসা অন্যান্য মহিলাদের নিয়ে ফিরে যাবার জন্য বিদায় নেন। যাবার সময় মিস মাসাকো শুধু মিতুলকে বললেন,- সাবধানে থেকো। সময় পেলেই প্রার্থনা করো। সব কিছুর ভালো সমাধান আমাদের সৃষ্টিকর্তাই দিতে পারেন। তিনি ছাড়া বা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদের এই পৃথিবীতে কোনো কিছু করা যে সম্ভব নয়। বলেই সামনের দিকে হাঁটতে থাকেন মিস মাসাকো।

মিতুল কিছুদূর পর্যন্ত তাদের সাথে হাঁটে। এ সময় মিস মাসাকোই মিতুলকে বললেন,- তুমি এবার তোমার রুমে চলে যাও। এর বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। ডাক্তার শেষে তোমার সাথে রাগ করতে পারেন। বলে সবাই আবার বিদায় জানিয়ে গেইটের বাইরে চলে যান।

মিতুল তাদের দূর পর্যন্ত চলে যেতে তাকিয়ে দেখে। মিস মাসাকোদের সবাই যখন দৃষ্টির আড়াল হন তখন সে তার কেবিনে ফিরে আসে। এসে মাসাকোদের আসা এবং এতো সুন্দর এক প্রস্তাব দেবার কথা ভেবে উল্লাসিত হয়। কিন্তু তার চেয়ে বেশি আনন্দ পায় সে তাদের কাছে লোভ সংবরণ করতে পারায়। এরপর মনে মনে ভাবে, জীবনে বেঁচে থাকলে এবং সুস্থতার সাথে জাপান থাকতে পারলে এরচেয়ে আরো বড় কিছু করতে পারবে হয় তো সে এ জীবনে। ভাবতে ভাবতে নিজের বিছানায় গিয়ে সে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে।

আস্তে আস্তে রাত বাড়তে থাকে। এ সময় একজন নার্স এসে তার হাতে স্যালাইন পুশ করে দিয়ে যায়। যাবার সময় একে একে কেবিনের সবগুলো লাইট অফ করে দিয়ে দরজা টেনে ভেজিয়ে রেখে নার্স কেবিনের বাইরে চলে যান।

(চলবে)

লেখকঃ জাপান প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

নলছিটিতে ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু

ঝালকাঠি প্রতিনিধি: ঝালকাঠির নলছিটিতে শুরু হয়েছে ভূট্টো স্মৃত...

সবজির বাজারে স্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে কমেছে পেঁয়াজ, সবজি...

স্বামীকে মৃত দেখিয়ে মামলা, নারী আটক

জেলা প্রতিনিধি : সাভারের আশুলিয়ায় জীবিত স্বামীকে বৈষম্যবিরোধ...

বৈষম‌বিরোধী আন্দোলনে বেঁচে ফেরার আশা করেনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন আন্দোল&zwnj...

বড় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলেন পূজা 

বিনোদন ডেস্ক: ঢাকাই চিত্রনায়িকা ও মডেল পূজা চেরি ডজনখানেক ছব...

সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি

নিজস্ব প্রতিবেদক : বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছ...

ফের বাড়ল সোনার দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বাজারে ফের সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা...

ফের হারলো সাকিবের দল

স্পোর্টস ডেস্ক : আবুধাবির টি-টেন টুর্নামেন্টে ফের হারের মুখ...

নোয়াখালীতে দুই গৃহবধূর লাশ উদ্ধার

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীতে পৃথক স্থান থেকে দুই গৃহবধূর...

ঢাকাবাসীকে নিরাপদ রাখতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকাবাসীকে যেকোনো উপায়ে নিরাপদ রাখতে হবে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা