শিল্প ও সাহিত্য
জাপানের গল্প - ৯

শিখার লিভ টুগেদার        

পি আর প্ল্যাসিড

মিতুল টোকিওতে এক বাংলাদেশি মসলার দোকানে ঘুরতে গেলে কতিপয় লোক মিতুলকে টিস করে, তার সম্প্রদায়ের এক মেয়ে জাপানে একা থাকে এটাকে খারাপ বলে। তাদের বক্তব্য, মেয়েটি এখানে একা থেকে যতো অসামাজিক কাজ করছে। বাঙালি মেয়েদের এভাবে একা দেশের বাইরে যাওয়া ঠিক নয়। তাদের কথা শুনে মিতুলের মনে হয়, মেয়েটির এমন করে বিদেশে থাকাটাই যেন অপরাধ। তা ছাড়া মেয়েটির একা থাকার জন্য দোষ যেন সব মিতুলের বা দায়-দায়িত্বও যেন মিতুলেরই।

মিতুল এতোদিনে জাপানে নানা মন-মানসিকতার মানুষের সাথে মেলামেশা করে অনেকটাই যেন তাদের রগ চিনে যায়। তাই কেউ কিছু বললার পর সে চেষ্টা করে সাথে সাথে কথা বলার জন্য। তার যুক্তি হচ্ছে, কেউ মানুক আর না-ই মানুক। কাউকে মিতুল কোনো কিছুতে ছাড় দিয়ে কথা বলতে নারাজ। মিতুল ওদের সেই মেয়েটি সম্পর্কে এতোটাই উপযাজক হয়ে কথা বলে যে, নিজের সম্প্রদায়ের লোককে বিদেশের মাটিতে শেল্টার দিতে পারলে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারবে বা এক ধরনের পূণ্যের কাজ করার মতো বললো, আমি বুঝলাম মেয়েটি খারাপ। বিদেশে একা থেকে নানা ধরনের অসামাজিক কাজ করছে। যদিও আমি তাকে চিনি না বা তার সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা কোনো কিছুই এখন পর্যন্ত আমি জানি না, তারপরও এটুকু অন্তত বলতে পারি, মেয়েটি কোনো জাপানির ঘরে যায় না বা কোনো জাপানি পুরুষ তার ঘরে আসে না। আপনাদের কথাতেই বুঝতে পারলাম আপনাদের মতোই বিদেশের মাটিতে একজন অসহায় বোনের সম্ভ্রম রক্ষায় অতি চিন্তিত ভাইয়েরাই আসা-যাওয়া করে। দোষ কেনো তাহলে সেই বোনটিকে একা দিচ্ছেন?

মিতুলের কথায় ওরা পেরে না উঠায় তার সাথে একমত প্রকাশ করে বললো,- আসলে মেয়েটি বিদেশে এতো কষ্ট করছে শুধু তার পরিবারের অন্যদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। সবাইকে স্বচ্ছল করে গড়ে তোলার জন্য। এটা একজন ছেলে করতে পারলে মেয়ে কেনো পারবে না। মিতুল তো ঠিকই বলছে, আমরা কোথায় তার পাশে দাঁড়াবো, তা না করে মেয়েটি সম্পর্কে বাজে অপবাদ দিচ্ছি। এটা আসলেই খুব অন্যায় হচ্ছে।

মিতুল মনে মনে মেয়েটিকে কোনোভাবে হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে কিনা সেটা নিয়ে ভাবে। এরপর মেয়েটির জন্য জাপান থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকার কয়েকটা পুরাতন সংখ্যা তাদের হাতে দিয়ে পৌঁছে দেবার অনুরোধ করে বলে তাকে যেন বলে মিতুলের সাথে যোগাযোগ করতে।

সেদিনের পর থেকে মিতুল প্রতিদিন সকাল দুপুর অপেক্ষা করে কবে কখন সেই বাঙালি মেয়েটির কাছ থেকে তার ফোন আসে, কবে ফোন করে বলে তার সাথে দেখা করার কথা। এতোটাই অস্থির হয় মিতুল যে তার যেন অনেকটা ঘুম নষ্ট হয়ে যায়। এরপর মাঝে মধ্যে মিতুল সেই দোকানে গিয়ে লোকগুলোর বিষয় জানতে চায়। খোঁজ-খবর নেয় এর মধ্যে ওরা আর এসেছিলো কিনা বা আবার কবে আসতে পারে।

মিতুলের কোনো সঠিক উত্তর দোকানদার দিতে পারে না। কারণ, এখানে অধিকাংশ লোক থাকে ভিসাবিহীনভাবে। চাইলেই রাস্তাঘাটে তারা ইচ্ছে মতো স্বাধীনভাবে চলা ফেরা করতে পারে না। টোকিও আসলে ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে অনেকেই দূর এলাকা থেকে সহজে টোকিও আসে না। সেই লোকগুলোও তাই হবে মনে করে দোকানদার মিতুলকে পরামর্শ দেন মাসের শেষ রোববার আসার জন্য। তখন অনেকে বেতন পায়। বেতন পেয়ে দোকানে আসে দেশি খাবার, মসলা বা হালাল খাবার কেনার জন্য। তা ছাড়া দোকানে আসে ওরা দেশে হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করতে।

এরপর ঠিকই মিতুল টোকিওতে একদিন বাংলাদেশি মসলার দোকানে ঘুরতে যায়।
সেই দোকানে মিতুল তার পূর্ব পরিচিতদের সাথে দেখা করে অন্যান্য দিনের মতো করে জাপানের সেই বাংলা পত্রিকার কপি দিতে যায়। পত্রিকা দিতে গেলে সেখানে পরিচিতদের সাথে নতুন এবং মিতুলের অপরিচিত কয়েকজন বাংলাদেশি মিতুলকে মিছাতো সিটিতে বসবাসকারী সেই বাংলাদেশি মেয়েটি প্রসঙ্গে কথা বলে জানতে চায় তার কোন আত্মীয় হয় কিনা মেয়েটি?

এ সময় তার সাথে আগে এই দোকানেই কথা হওয়া একজন মিতুলকে বললো, - মেয়েটিকে আপনার কথা বলেছি। সে বলল আপনার সাথে শিপ্রা দেখা করতে চায়।
মিতুল সেই ছেলের মুখে শিপ্রা নাম শুনে বুঝতে পারে তার নাম যে শিপ্রা। শুনে মেয়েটির নাম নিয়ে আর কোন কথা বলে না। চুপ করে তার বাকি কথা শোনার চেষ্টা করে। -শিপ্রা আপনার ফোন নাম্বার চেয়েছে। ছেলেটি বললে মিতুল সেই মেয়ের ফোন নাম্বার চাওয়ার উত্তরে বললো, - আমার নাম্বার তো গোপন করার মতো না। আমি যেহেতু পাবলিক ফাংশান করি সুতরাং যে কাউকে আমার নাম্বার দিতে পারো। বলেই আবার বললো, সে আমার নাম্বার চেয়েছে, তা না হয় বুঝলাম কিন্তু সেও তো তার নাম্বার তোমার মাধ্যমে আমাকে দিতে পারতো, নাকি? পরে না হয় আমি একসময় তাকে ফোন করে কথা বলতে পারি।

ওদের একজন মিতুলকে মিথ্যে বললো,- মেয়ের মনে হয় বাসায় ফোন নাই। আপনার নাম্বার দিলে সে তার কোম্পানি থেকে ফোন করতে পারে। এরপর মিতুল মেয়েটির নাম এবং বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে বললো, ওর বাড়ি সম্ভবত খুলনা। আর নাম শিপ্রা। তবে পাসপোর্টের নাম ভিন্ন। সে তার আসল নাম কাউকে বলে না। একটু থেমে আবার বলে, মনে হয় ওর আসল নাম শিখা রয়। আমাকে কখনো বলেনি তবে ওর একটা চিঠির উপর এই নাম দেখেছি।
মিতুল মনে মনে বলে তার আসল নকল সব নামই জানো দেখছি। সে আর শিপ্রা সম্পর্কে কি কি জানে কে জানে? দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এদের সাথে পরে কফি খেয়ে সবাইকে পত্রিকা ধরিয়ে দিয়ে মিতুল বললো, তোমাদের ওখানে আশেপাশে বাঙালিদের কোন অনুষ্ঠান হলে আমাকে আগে থেকে বলো। বললে পর আমি তোমাদের সেই অনুষ্ঠানে যেতে পারবো। যাওয়া মানে সবার ছবি তোলা যাবে। দেখা গেলো সবার সেই ছবি আমি পত্রিকাতে সংবাদ হিসাবে ছাপাতে পারবো। এই যেমন ধরো পিকনিক, ঈদের অনুষ্ঠান বা যেকোনো অনুষ্ঠান হলেই আমাকে জানাবে।

মিতুলের কথায় ওরা সবাই খুশি হয়। মিতুল যখন সবাইকে টোকিও থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্রিকার কপি দেয় এতে তারা আরো বেশি খুশি হয়। এরপর তাদের সকলকে উক্ত পত্রিকার নিয়মিত প্রাহক করা হয় যেন প্রতিমাসে তাদের ঠিকানায় পত্রিকা প্রকাশ হলেই পাঠানো যায়। সকলেই তখন তাদের গ্রাহক চাঁদা অগ্রিম দিয়ে যে যার নাম ঠিকানা লিখে জমা দেয় মিতুলের কাছে। পরে ওরা যখন বিদায় নিয়ে চলে যায় তখন ওদের একজন মিতুলের কাছে দৌড়ে এসে চুপি চুপি যেই ছেলেটি শিপ্রার ম্যাসেজ মিতুলের কাছে পৌঁছায় তার সম্পর্কে বলে, মেয়েটি আসলে তাদের সাথে আসা সেই ছেলেটির সাথেই এক সাথে থাকে। ওরা দু'জন চাকরিও করে একই ফ্যাক্টরিতে।

এরপর মিতুল সেই ছেলেটির দিকে একবার তাকিয়ে দেখে। দেখে মনে হয় না সে জাপানের মতো দেশে একটি অবিবাহিত বাংলাদেশি তাও আবার ভিন্ন এক সম্প্রদায়ের মেয়ে নিয়ে থাকে। মিতুল ভাবে, এর মধ্যে অন্য কোন রহস্য থাকতে পারে। ডেকে এখন বিষয়টি জানতে চাইলে কেমন হয়। নাকি পরে শিপ্রা তাকে টেলিফোন করলে কোথাও ডেকে তার সাথে দেখা করে কথা বলবে? তখনই না হয় বিস্তারিত জানা যাবে। বিষয়টি জানার পরে আরো যেন তার অস্বস্থি বেড়ে যায়। এটা যেন তার বড় শখ। বিষয়টি শোনার পর তার মাথায় বিদ্যুৎ চমকানোর মতো করে চিন্তার ধলক মারে। এতে তার ভিতর অনেকটা খারাপ লাগা কাজ করতে শুরু করে।

একবার ভাবে মেয়েটি তো তার পরিচিত কেউ নয়। বলতে গেলে তার কোনো আত্মীয়ও নয়। তারপরেও এমন খারাপ লাগছে কেনো তার ভিতর। নিজে নিজে সে তার এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজে মনে মনে। এরপর সেকথা ভাবতে ভাবতে মিতুল এগিয়ে যায় সেই ছেলেটির দিকে। ছেলেটি মনে হয় মিতুলকে তার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে কিছুটা ভয় পায়। ভয় তার চোখে মুখে প্রকাশ পায়। সামনে গিয়ে প্রশ্ন করে, এই তোমার নাম কি?
- জ্যাকি।
- বাড়ি কোথায়?
- বিক্রমপুর, লৌহজং থানায়।
- জাপানে কি তুমি অনেকদিন হয় থাকো?
- পাঁচ বছর হয়।
- শিপ্রা বা শিখাকে তুমি চিনো কতোদিন ধরে বা কিভাবে?
- তার সাথে আমার এক ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে প্রথম দেখা হয়। এরপর আমার বাসায় এসেছিল বেড়াতে। তখন সে এখানে কোন এক প্রতিষ্ঠানে এসেছিল কোর্সে অংশ গ্রহণ করতে। কোর্স শেষ হলে সে জাপান থেকে দেশে ফিরে যাবার চিন্তা করলে আমি তাকে মানা করেছিলাম। সে তখন অবৈধভাবে জাপানে থেকে গিয়ে কাজ করার চিন্তা করে। তখনও তার থাকার কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। তাই আমার সাথে থাকার কথা কইলো। আমি আর না করি নাই। কোর্স শেষ হইলে আমার বাসায় আইসা উঠে। কারণ তখন তো এখানে তার পরিচিত আর কেউ ছিল না। পরে মালিককে বলে কয়ে আমার সাথে একই ফ্যাক্টরিতে কাজ নিয়ে দিলাম। তখন থেকেই আমরা একই বাসায় থাকি। তবে তার রুম আলাদা।

মিতুল ছেলেটির সহজ-সরল মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি কি তাকে বিয়ে করবে? নাকি এমনিতেই এক সাথে থাকবে?
ছেলেটি অনেকটাই অপ্রস্তুত হয়ে বললো,- আমি আসলে এখন কাজী ডাইকা আমগো ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী বিয়া করছি। আগে আলাদাই থাকতো। এখন একসাথে থাকি।
শিপ্রা এখন তার মানে তোমার বৈধ স্ত্রী, এই তো?
- হুম, স্ত্রী মানে লিভ টুগেদার করি যেহেতু সুতরাং স্ত্রী বলতে পারেন। কাজী ডেকে বিয়ে না করলে তো আর এক সাথে থাকা যাবে না, তাই।
মিতুল একটু হাসি দিয়ে বললো,- আমরা অবশ্য লিভ টুগেদার এর অর্থ ভিন্ন বুঝি। তুমি যেহেতু কাজী ডেকে বিয়ে পড়িয়ে নিয়েছ সুতরাং সে এখন তোমার স্ত্রী। তাকে আর অন্য কারো কাছে যেতে দেয়া তোমার ঠিক হবে না। কথাটাকে তুমি আর কখনো কারো কাছে বলার সময় লিভ টুগেদারও বলো না। তার মানে শিপ্রা কি মুসলমান হয়েছে?
- কবুল বলছে।
কবুল বলার পরেই বিয়ে করেছি। তবে সে এখন তার ধর্ম পালন করে আমি আমার ধর্ম পালন করি।
এরপর জ্যাকিকে তার নাম্বার দিয়ে বলল ঠিক আছে তুমি শিপ্রাকে বলো আমাকে তার সময় সুযোগ করে কল দিতে আর একদিন তোমরা এসো আমার বাসায় বেড়াতে।
মিতুলের কথা শুনে জ্যাকি এবার নিজেকে শিপ্রা বা শিখা রয়ের স্বামী স্বামী ভাব করে চলে যায়। যাবার সময় মিতুল জ্যাকির দিকে তাকিয়ে দেখে। এবার তাকে দেখতে একদম একজন প্রাপ্ত বয়ষ্ক পুরুষের মতো লাগছে।

(চলবে)

লেখকঃ জাপান প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক।

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

নলছিটিতে ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু

ঝালকাঠি প্রতিনিধি: ঝালকাঠির নলছিটিতে শুরু হয়েছে ভূট্টো স্মৃত...

সবজির বাজারে স্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে কমেছে পেঁয়াজ, সবজি...

স্বামীকে মৃত দেখিয়ে মামলা, নারী আটক

জেলা প্রতিনিধি : সাভারের আশুলিয়ায় জীবিত স্বামীকে বৈষম্যবিরোধ...

বৈষম‌বিরোধী আন্দোলনে বেঁচে ফেরার আশা করেনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন আন্দোল&zwnj...

বড় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলেন পূজা 

বিনোদন ডেস্ক: ঢাকাই চিত্রনায়িকা ও মডেল পূজা চেরি ডজনখানেক ছব...

সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি

নিজস্ব প্রতিবেদক : বঙ্গোপসাগর এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছ...

ফের বাড়ল সোনার দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বাজারে ফের সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা...

ফের হারলো সাকিবের দল

স্পোর্টস ডেস্ক : আবুধাবির টি-টেন টুর্নামেন্টে ফের হারের মুখ...

নোয়াখালীতে দুই গৃহবধূর লাশ উদ্ধার

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীতে পৃথক স্থান থেকে দুই গৃহবধূর...

ঢাকাবাসীকে নিরাপদ রাখতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকাবাসীকে যেকোনো উপায়ে নিরাপদ রাখতে হবে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা