পি আর প্ল্যাসিড
টোকিওতে অনেকগুলো বড় এবং বিখ্যাত পার্কের মধ্যে উয়েনো পার্ক উল্লেখযোগ্য। ছুটির দিনগুলোতে এই পার্কে জাপানিদের পাশাপাশি বিদেশিদের আনা-গোনা চোখে পড়ার মতো। শুধু জাপানে বসবাসকারীই নয়, বাইরের দেশ থেকে আগত পর্যটক প্রায় প্রতিদিনই এখানে ঘুরতে আসে। এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে চিহ্নিত।
মিতুল এই পার্কের সন্ধান পাবার পর থেকে নিয়মিত যায় এই পার্কে। এখানে রয়েছে বিশালাকারে পুকুর, পুকুর ভরা পানি, পানিতে দেখা যায় মাছের খেলা, পানকৌড়িদের উড়াউড়ি আবার এখানে পদ্ম ফুলের ছড়াছড়ি। রয়েছে চিড়িয়াখানা, পানির ঝর্ণা, এছাড়া নানা ধরনের গাছ আর সেই গাছজুড়ে সবুজের ছড়াছড়ি। পার্কের একটি অংশে রয়েছে হাজারটিরও বেশি জাপানের জাতীয় ফুল সাকুরা বা চেরি গাছ। এখানে এমন এক দৃষ্টি জুড়ানোর মতো পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে যেখানে গেলে নানা কারণে মিতুলের মন সবসময় উৎফুল্ল থাকে।
মিতুল জাপান আসার কয়েক বছর আগে থেকেই জাপানে বিভিন্ন দেশের নাগরিক দলে দলে প্রবেশ করতে শুরু করে। রাস্তা ঘাট, মিতুল যেখানে যায় সর্বত্রই দেখে বিদেশিদের আনা-গোনা। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া আর ইরানের নাগরিকই বেশি দেখা যায়। এদের অনেকেরই কাজ বা বাসস্থান নেই। যে কারণে উয়েনো পার্কে এসে দিনরাত সময় কাটায় তারা। জাপানের পরিবেশ এরা এমন করে তুলেছে যে, দেশটাকে তারা নিজেদের দেশ মনে করে রাস্তা ঘাটের অবস্থা শুধুই নোংরা করছে এমন নয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্রাইম করে ক্রাইমের স্বর্গরাজ্য করে তুলেছে ক্রমেই।
মিতুল এসব বিদেশিদের দেখে জাপানের ভবিষ্যৎ পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভাবে। পার্কে যাবার পর কখনো তাকে ইন্দোনেশিয়ান মনে করে অন্য ইন্দোনেশিয়ানরা ডেকে তাদের ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। যখনই বলে সে তাদের ভাষা বোঝে না তখনই ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করে ওরা। কেউ কেউ মিতুলের কাছে চাকরি এবং বাসার ব্যবস্থা করে দেবার অনুরোধ করে।
যখন বিদেশিদের সংখ্যা বেশি রকম এই পার্কে বেড়ে যায় মিতুল তখন এখানে আসা কমিয়ে দেয়। এর মধ্যে ইংরেজি পত্রিকা এবং টিভি সংবাদে সে দেখে উয়েনো পার্কে বেশ কিছু অবৈধ ভাবে জাপানে থাকা বিদেশিকে ইমিগ্রেশন পুলিশ রেড দিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে হাজতে বন্দি করেছে। এদের সাময়িকভাবে হাজতে বন্দি রাখা হলেও পরবর্তীতে সবাইকে তাদের নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হবে। কেউ এই সংবাদ দেখে জাপানের বিভিন্ন শহরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে যারা এর মধ্যেই ক্রাইমের সাথে জড়িয়ে গেছে তারা এখন পলাতক। এসব দেখে মিতুল উয়েনো পার্কে গেলেও সেসব বিদেশি যেখানে বেশি ভিড় করে সেদিকে আর পা বাড়ায় না।
একদিন সে সন্ধ্যার দিকে উয়েনো পার্কের ভিতর পুকুর পাড়ে বসে একা একা পানিতে মাছের খেলা আর পাখির উড়াউড়ি দেখছিল। এসময় একজন কম বয়সি সুন্দরী মেয়ে তার পাশে এসে বেঞ্চে বসে। মেয়েটিকে এভাবে তার কাছে এসে বসার ভাব দেখে কিছুটা সন্দেহ হয়। দেশে ছাত্র জীবনে তার আশে পাশে নানা বেশে গোয়েন্দা পুলিশের আনা গোনা করার বিষয়টি মনে করে। এভাবে কোনো সুন্দরী খুব কম বয়সি মেয়েদের তার কাছে এসে বসার অভিজ্ঞতা নেই। থাকলেও এর সংখ্যা খুব কম ছিল যাদের সাথে তার গায়ে পড়ে ভাব জমানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। যে কারণে মেয়েটিকে তার সাথে কথা বলার ধরনে মিতুলের সন্দেহ হতে থাকে। দেশে তার সেই মেয়েদের সাথে পরিচয় হবার পর সম্পর্ক বেশি দূর এগোতে দেয়নি। কারণ মিতুল বুঝতে পেরেছিল, মেয়েদের উদ্দেশ্য যে বন্ধুত্ব বা ভালোবাসা করা নয়। উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন।
উয়েনো পার্কে সেই মেয়েটিকে তার কাছে এসে বসার পর মিতুল খেয়াল করে যে, তার আশে পাশে আরও বেশ কয়েকজন লোক দূর থেকে তাদের দুজনকে খেয়াল করছে। এতে আরো বেশি তার সন্দেহ হয়। কিছুটা ভয়ও পেতে থাকে মিতুল।
সচরাচর সুন্দরী কোনো মেয়েকে দেখার পর ছেলেরা দূর থেকে শিস দেয় বা টিস করে কিংবা কিছু বলার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু মেয়েরা এগিয়ে এসে কথা বলে এমনটি মিতুল আগে আর কখনো এভাবে দেখেনি। মেয়েটি যখন একদম তার পাশে এসে গা ঘেঁষে বসে তখনই সে মনে করে মেয়েটি সাধারণ কোনো মেয়ে হবে না। বসেই মিতুলের উদ্দেশে ‘হাই’ বলে বলছে, - তোমাকে একা বসে থাকতে দেখে মনে হচ্ছিল তুমি খুব লনলি ফিল করছো, তাই তোমার সাথে কথা বলার জন্য এসে বসলাম। বসাতে তোমার কোনো সমস্যা হয়নি তো আবার?
মিতুল বলতে না চেয়েও আবার বলল, - না, সমস্যা নেই বসো।
- কেউ আসবে না তো আবার তোমার? মেয়েটির প্রশ্ন।
- না, আমার আসার মতো কেউ নেই এখানে।
- তুমি খুব সুন্দর শুদ্ধভাবে জাপানি ভাষায় কথা বলতে পারো দেখছি। পড়াশোনা করো বুঝি?
- আমি পড়াশোনা করতাম আগে। এখন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি খুঁজছি।
- থাকো কোথায়?
- আমার বাসা এখান থেকে কাছেই। বলেই মিতুল আবার মেয়েটিকে প্রশ্ন করে, - তুমি কি করো? থাকো কোথায়?
মেয়েটি উত্তর না দিয়ে বলল, - তোমার নাম কিন্তু জানা হলো না। বলেই বলল, - আমার নাম ইউমি।
- ও! বেশ সুন্দর নাম, আমার নাম মিতুল। নাইস টু মিট ইউ।
- তুমি এখানে কি প্রায়ই আসো নাকি?
- বলতে পারো, প্রায়ই আসি। কেনো বলো তো?
- তোমাকে দূরে দাঁড়িয়ে খেয়াল করছিলাম। তুমি এখানে বসে একা একা সুন্দর করে মাছের খেলা দেখছো। মাছ গুলোকে তুমি আবার থেকে থেকে তোমার খাবার থেকে কিছুটা ছুড়ে দিচ্ছো আবার পাখিদেরও খাবার ছিটিয়ে দিচ্ছো। ওরা তোমার খাবার পেয়ে কতো আনন্দ করছে, তাই দেখছিলাম। তুমি প্রকৃতি খুব পছন্দ করো নিশ্চয়?
- আসলে তোমাদের জাপানে দেখছি সব মানুষ কেমন যেন আর্টিফিসিয়াল। মানুষের মধ্যে যেন কোনো ধরনের ভালবাসা বা আন্তরিকতা নেই। তাই আমি এখানে এসে সময় পেলে মাছ আর পাখিদের সাথে খেলা করি। আমাদের দেশে এমন সুন্দর পরিবেশ আমি কোথাও পাইনি কখনো।
- তোমার দেশ কোথায়?
- বাংলাদেশ।
- সরি।
- সরি কেন?
- আমি ভেবেছিলাম তুমি শ্রীলংকান হবে বুঝি?
তাদের খুব কাছাকাছি তিন চারজন লোক এসে দুজনের কথা বলা তখন শুনছে। যেহেতু তারা কোনো গোপন কথা বলছে না তাই মিতুল লোকগুলোকে সেখান থেকে আর সরে যেতে বলেনা। ভাবে, যদি কোনো কিছু জানতেও চায় সরাসরি সে বলবে। এতে তার ভয় পাবার কিছু নেই। তাছাড়া, সে তো এখানে অন্যায় কোনো কিছু করছে না আর। আবার ভাবে, তাকে মেয়েটি শ্রীলংকান ভাবলো কেনো? ভেবেই প্রশ্ন করে, - আচ্ছা, তুমি আমাকে বিদেশি হিসেবে একদম শ্রীলংকান মনে করলে, এর কারণ কি জানতে পারি? কেনো তুমি আমাকে শ্রীলংকান মনে করলে?
ইউমি বলল, - এখানে একসময় একটি ছেলে প্রায় প্রতিদিন আসতো। আমার সাথে প্রায়ই এখানে ছেলেটির সাথে কথা হতো। ওর বাড়ি ছিল শ্রীলংকা। তোমাকে দেখতে ওর মতো মনে হয়েছে, তাই।
মিতুল ইউমির কথা বিশ্বাস করে। তাই সহজ সরল ভাবেই প্রশ্ন করে, - তারপর? তারপর ছেলেটির কি হলো?
অনেকদিন হয় এখানে আর আসে না। আমার সাথে ওর আর কোনো যোগাযোগও নেই। তার খোঁজ করতেই আমি প্রায়ই এখানে আসি।
- তুমি তাকে খুব ভালোবাসতে মনে হয়?
মেয়েটি উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, - তোমার কী কোনো বান্ধবী আছে জাপানে?
- না, নেই। তবে বান্ধবী থাকলে নাকি জাপানে অনেক টাকা খরচ করতে হয় বান্ধবীদের পেছনে। আমি শুনেছি ছেলেরা যা আয় রোজগার করে, তার সবটাই নাকি বান্ধবীদের পেছনে খরচ করতে হয়। তা নাহলে বান্ধবী বেশি দিন সম্পর্ক রাখে না।
- এই জন্য কী তুমি ভয় পাও বান্ধবী করতে? আসলে সব মেয়ে এক ধরনের হয় না।
- দেখো, আমি জাপানে এসেছি জাপান সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনে। এখানে এসে আমি যে জাপান সম্পর্কে কিছু জানবো সেই সুযোগও আমার নেই। ইচ্ছে হয় মাঝে মধ্যে ধারে কাছে কোনো লাইব্রেরি থাকলে লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়তে। আমার জাপান সম্পর্কে অনেক কিছু জানার ইচ্ছে।
- জাপান সম্পর্কে তো অনেক কিছু জানার আছে। তুমি কি নির্দিষ্ট কোন বিষয় জানতে চাও?
সন্ধ্যা নেমে আসলে চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে। এর মধ্যে দূরের বৈদ্যুতিক বাতিগুলো আকাশের তারার মতো জলজল করতে শুরু করছে। পানির ধারে ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগছে। পানির ধারে বসে ঠান্ডা বাতাস গায়ে জড়ালে বেশ মিষ্টি অনুভূতি লাগে তার। বসে কথা বলতে বলতে দু’জনই তাদের কথার ভান্ডার শেষ করে। এবার মনে মনে বিদায় নেবার প্রস্তুতি নেয় মিতুল। কিন্তু মেয়েটি তার আরো কাছাকাছি এসে গায়ের সাথে ঘেঁষতে থাকে। এতে মিতুল উঠে দাঁড়ায়। অনেকটা এক লাফে দূরে সরে গিয়ে বলে, - তুমি বসো আমি এবার আসি।
ইউমিও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, - শোন! ইউমি থামে। থেমে আবার বলল, - চলো হাঁটতে হাঁটতে আমরা উয়েনো স্টেশন পর্যন্ত যাই। সেখানে একটা কফি হাউজে বসে কফি খাই আর কথা বলি।
বলেই মিতুলের হাত ধরে বলে, - চলো যাই।
ইউমি যখন তার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে, আশে পাশের লোক গুলো তখন কেমন যেন একটু নড়ে চড়ে দাঁড়ায়। মিতুল বুঝতে পারে লোকগুলো যে তাদের ফলো করছে। এরপর মিতুল ইউমির কাছ থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটতে থাকে। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় এসে পৌঁছালে ওরা আবার পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটতে থাকে। একটা লোক তখন মিতুলদের খুব কাছে চলে আসে। ইচ্ছে করেই মিতুল একবার হঠাৎ করে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে পেছন দিকে তাকায়। পেছন ফিরে তাকাতেই পেছনে কাছাকাছি আসা লোকটিও হঠাৎ থেমে যায়। এরপর তার হাতে থাকা বড় কালো ব্যাগ মুখের উপর নিয়ে ব্যাগ দিয়ে তার মুখ ঢাকে। এটা করতে দেখে মিতুল দুই কদম পেছনে যায়। পেছনে গিয়ে ভাবে, লোকটিকে ধরে ধমক দিবে। যে-ই সে পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করে তখন লোকটি তার পেছন দিকে ঘুরে দৌড়ে চলে যায়।
বিষয়টি দেখে ইউমির চেহারাও কিছুটা বদলে যায়। এরপর দু’জন আবার সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। একসময় স্টেশনের কাছে গিয়ে ইউমি মিতুলকে কফি হাউজে ঢোকার অনুরোধ করে। মিতুল পুরো বিষয়ের কথা ভেবে কিছুটা ভয় পায়। মনে করে লোক গুলো ইমিগ্রেশন পুলিশও হতে পারে। সে জাপান আসার পর যেহেতু তার আমন্ত্রণকারীদের কাছ থেকে কোনো কিছু না বলে পালিয়েছিল, সেই জন্যও হতে পারে তাকে ধরার জন্য ফলো করছে। এটা ভাবতেই মিতুলের সারা শরীর শিহরিত হয়। যে কারণে তার অনুরোধ না রাখার উছিলা দিতে বলল, - তার আজ সময় নেই, অন্য আরেকদিন আসলে এখানে দেখা হবে। তখনই না হয় এক সাথে বসে কফি খাওয়া যাবে। বলে তাড়াতাড়ি তার কাছ থেকে বিদায় হবার চেষ্টা করে।
মিতুল ইউমিকে আবার ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, - আজ আর সে সময় দিতে পারছে না। চাইলে অন্য আরেকদিন দেখা করবে। বলেই অস্থিরতা দেখিয়ে দ্রুত সেখান থেকে মিতুল বিদায় নেয়। যাবার সময় ইউমি নিজে থেকে তার ডায়রির পাতায় নিজের নাম আর ফোন নম্বর লিখে ছিড়ে মিতুলকে দেয়।
মিতুল স্টেশনের কাছে গিয়ে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে যায়। পরে অন্য একদিন মিতুল তারই এক পরিচিত লোককে উয়েনো পার্কে দেখা হওয়া মেয়েটি সম্পর্কে বিস্তারিত সব ঘটনা খুলে বললে সে মিতুলকে জানায়, জাপানের পত্রিকায় এ নিয়ে কিছুদিন ধরে বেশ লেখালেখি হচ্ছে। উয়েনো পার্কের ভেতর সেই পুকুর পাড়েই নাকি এক শ্রীলংকান ছেলে জাপানি মেয়ের সাথে প্রেমের অভিনয় করে তার সব কিছু ছিনিয়ে নেয়। এজন্য মেয়েটি থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে নোটিশ করায় পুলিশ তাকে খুঁজছে। মিতুল তার পরিচিত লোকটির কথা শুনে মনে মনে ভাবে, তার ধারণাই তাহলে ঠিক হয়েছে। আসলেই যে মেয়েটি গোয়েন্দা ছিল তা মিতুল বুঝতে পারে।
(চলবে)
লেখক: জাপান প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক।
সাননিউজ/এমআর