পি আর প্ল্যাসিড
কাজের জন্য মিতুল বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জনের কাছে ধন্যা দিচ্ছিল। একদিন সে বুঝে গেছে দালাল ছাড়া এখানে কাজের কোনো ব্যবস্থা তাকে দিয়ে সম্ভব নয়। এদিকে দালালদের যে কাউকে সে কাজের জন্য অগ্রিম টাকা দিবে, সেই অবস্থাও তার এখন আর নেই। কাজ না থাকলে আয় নেই, উল্টো ব্যয় হয় প্রতিদিন। ঘর থেকে বাইরে কোথাও গেলেই ট্রেন ভাড়া আর জুস বা কফি খাওয়া তো লাগেই।
যে এলাকায় সে থাকে সেই এলাকাতেই একদিন এক মার্কেটের সামনে দিয়ে হাঁটছিল। মনে হচ্ছে রাস্তার ধারে বিশাল এক বিল্ডিংয়ে কিছু একটা হচ্ছে যেন। বিল্ডিংয়ের প্রবেশ পথে রঙিন আলো জ্বলছিল। কিছুটা আবার গ্যাস দিয়ে বেলুন ফুলিয়ে বেলুনগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে পথচারীদের আকৃষ্ট করছে।
দূর থেকে বাইরের দিকটা দৃষ্টি নন্দন। কাছে যেতেই শোনে বিকট শব্দ হচ্ছে বিল্ডিংয়ের ভিতর। আরো কাছে গিয়ে দেখে ভিতরে লোকজন বসে আছে এক ধরনের মেশিনের দিকে তাকিয়ে। এক হাত তাদের মেশিনের উপর রাখা আরেক হাতে কেউ সিগারেট ফুঁকছে। মাঝে মাঝে কিছু অল্প বয়সি মেয়ে তাদের সামনে দিয়ে হাঁটা চলা করছে। মেয়ে গুলোর অর্ধ নগ্ন পোশাক দেখে মিতুল আরো বেশি আকৃষ্ট হয়।
এক পা দুই পা' করে এগিয়ে যায় মিতুল ভিতরের দিকে। যেতেই দু'জন মেয়ে এগিয়ে এসে তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, - রেশ্যায় মাছে-এ। বলেই এমন ভাবে ওরা মিতুলের কাছে এসে গায়ের সাথে ঘেঁষে দাঁড়ায় যে, মিতুল এতে কিছুটা অস্বস্থি বোধ করে। কিন্তু মেয়ে দু'জন তাকে এমন করে আপ্যায়ন করতে থাকে যে কারণে মিতুল তাৎক্ষণিকভাবে তার সব আবেগ ভুলে যায়। তাদের প্রতি মিতুলের আগ্রহ দেখে মেয়ে দু'জন বুঝতে পারে মিতুল যে সেখানে আগত প্রথম অতিথি।
তাই তাকে প্রশ্ন করে, - হাজিমেতে দেসকা ?
এতোদিনে মিতুল অনেকটা জাপানি ভাষা বুঝতে এবং বলতে শিখেছে। জাপানি ভাষায় উত্তর করে -হাই। সো দেস।
-ইয়াত্তে মিতাই দেসকা? খিয়ো ওয়া লাকি দেসইয়ো। পাশ থেকে আরেকজন মিতুলকে ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করে, - ইউ লাকি, ইউ লাকি বলে।
মিতুল ওদের কথা বোঝার চেষ্টা করে বলল, - আই আন্ডারস্টেন্ড ইয়োর জাপানি ল্যাঙ্গুয়েজ, হোয়াই ডু ইউ স্পিক ইন ইংলিশ?
এরপর সে একটা মেশিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মেয়ে দু'জন তাকে সুন্দর করে একটা বসার সিট টেনে বসিয়ে বলল, - ওচা কা কহি নমিমাছেন কা?
- নো থ্যাংক ইউ। বলেই সে মেশিনে হাত দিয়ে পাশের লোকদের দিকে তাকায়। প্রত্যেকের পাশেই অনেকগুলো ঝুঁড়ি। একটার উপর আরেকটা রাখা। ঝুঁড়িতে ছোট ছোট স্টিলেরগুটি। সে তাকানো মাত্রই পাশের জন তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠে।
মেয়ে দু'জন এতো সুন্দর আন্তরিকতার সাথে মিতুলকে সেবা করছে ভেবে সে বাধ্য হয়ে মানিব্যাগ টেনে নিজের সামনে এনে একটা সবুজ এক হাজার ইয়েনের নোট বের করে ওদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, একটু শিখিয়ে দিতে, কি ভাবে খেলতে হয়। তাড়াহুড়ো করে ওদের একজন ইয়েনের নোটটা নিয়ে যেখানে বসেছে তার পাশেই মেশিনের এক জায়গাতে নোটটি রাখে।
মিতুল দেখে বুঝতে পারেনি সেখানে যে ইয়েনের নোট ঢুকানোর প্রবেশ পথ আছে। নোটটি রাখতেই ভিতরে ঢুকে যায়। পুরো বিল্ডিংয়ের ভিতর তখন ভীষণ রকমের এক শব্দ হতে থাকে। প্রথম দিকে তার কান ঝালাপালা করলেও কিছুক্ষণ বসার পর শব্দটা অনেক সহনীয় হয়ে যায় মিতুলের কাছে।
মিতুল তখন বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকে ইয়েনের নোটটা মেশিনের ভিতর ঢোকার পর কি প্রতিক্রিয়া হয়। সে দেখে, ঝরঝর করে সেই স্টিলেরগুটির কিছু তার সামনে বেরিয়ে আসে। এরপর মেয়েদের একজন বলল, মিতুলকে তার নিজের একটি হাত সেই মেশিনের উপর রেখে মেশিনের হাতল আস্তে আস্তে ঘুরাতে।
মিতুল তার ডান এবং বাম পাশের লোককে খেয়াল করে দেখে, তারা কিভাবে কি করছে। এরপর হাতলটি সামান্য ঘুরাতেই অনেকগুলো গুটি খুব দ্রুত বের হয়ে আবার ভিতরে মূহুর্তের মধ্যে কোথায় যেন ঢুকে যায়। এতে করে দ্রুত গুটিগুলো সামনে থেকে শেষ হয়ে যেতে থাকলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি দ্রুত মিতুলের হাতের উপর হাত দিয়ে সেটার গতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এমন ভাবে সে হাত বাড়ায় যে তার কাঁধের উপর বুকের স্পর্শ লাগে।
অনেকটা যেন ইচ্ছে করেই কাজটি সে করে এমন মনে হয় মিতুলের কাছে। পুরো লেপ্টে যায়। তার হাতও শক্ত করে ধরে। এতে সে আর মেশিন ঘুরাবে কি। মন চলে যায় তার মেয়েটির শরীরের সাথে শরীর লেগে থাকার দিকে।
নজর কাড়তে মিতুলকে বলল,
- ইউক্করি, ইউক্করি মাউয়াস্তে খোদাসাই।
মেয়েটি ইচ্ছে করেই আবার অনেকটা মিতুলের শরীরের সাথে গা ঘেঁষে তাকে মেশিন চালাতে শিখাতে থাকে। এ সময় সাথের অন্য মেয়েটি তাদের থেকে দূরে চলে যায়। মেশিন নিজের ইচ্ছেতে ঘুরানোর চেষ্টা করতেই তার গুটি বের হওয়া বন্ধ। তার মানে তার এক হাজার ইয়েন শেষ হয়ে যায়। মেয়েটি তার উপর থেকে আর সরে না। প্রশ্ন করে, - তুমি কি আরো একবার খেলতে চাও?
মিতুল কোনো উত্তর না দিয়ে মুখে একটা হাসি টেনে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে। মানিব্যাগ থেকে আগের মতো আরেকটি নোট নিয়ে এবার সে নিজেই চেষ্টা করে খেলার জন্য।
ইয়েনের নোট মেশিনের ভিতর ঢুকিয়ে আগের মতো করে হ্যান্ডেলে হাত রাখে। মেয়েটি তখন ইশারায় আগের সেই মেয়েটিকে কিছু বলতে থাকে। মেয়েটি মিতুলের জন্য একটা কাগজের কাপে জাপানি গ্রীন-টি এনে পাশে রাখে। মিতুলের আর সেই গ্রীন টির দিকে নজর নেই।
চেষ্টা করে নিজে খেলতে। পাশের লোকটি একবার তার মেশিন বন্ধ করে মিতুলের দিকে তাকায়। মনে হয় পাশের লোকটি তাকে গুটি খেলার কৌশল শিখিয়ে দেবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
মেয়েটি পাশের লোকটিকে প্রশ্ন করলো, - ওকিয়াকসান, নাংকা হোইশি দেসকা?
লোকটি গলা বাড়িয়ে মিতুলের মেশিনের দিকে তাকিয়ে গুটি চালানোর গতি কমাতে বলেন। এরপর লোকটি কোনো কথা না বলে মিতুলের হাতের উপর হাত রেখে গুটির গতি নিয়ন্ত্রন করতে শিখানোর চেষ্টা করেন।
বেশ কিছু গুটি ভিতরে চলে যাবার পর হঠাৎ করেই মেশিনের চারিদিকে নানা রঙের বাতি জ্বলে উঠে আর পেঁ পুঁ করে শব্দ হতে শুরু করে। এতে লোকটি তার সিট টেনে মিতুলকে একটু সরিয়ে সে নিজে মিতুলের মেশিন চালাতে থাকেন। একটু পর পর অনেকগুলো গুটি ভিতর থেকে বের হয় আর শব্দ হতে থাকে। আলো জ্বলা দেখে মিতুলের বেশ আনন্দ হয়। তখনও সে জানে না এই গুটিতে তার কি হবে।
লোকটি এবার উঠে বাইরে যান। ফিরে এসে তার নিজের সিটে বসার আগে মিতুলের মেশিনের দিকে এগিয়ে এসে দেখেন মিতুলের গুটি সবই প্রায় শেষ হয়ে গেছে। যা পেয়েছিল তাও আবার শেষ। তাই লোকটি মিতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, - তুমি নতুন, তাই এই মেশিন তোমাকে আজকে গুটি দিবে। তুমি চাইলে আরো কিছু টাকা খরচ করে খেলতে পারো।
মিতুল বলল, - আমার জীবনে এটা প্রথম খেলছি। দেখি ভাগ্যে কি আছে।
মিতুলের কথা বলার স্টাইল এবং শুদ্ধ জাপানি ভাষার উচ্চারণ শুনে লোকটি জানতে চাইলেন,
- তুমি কি ছাত্র নাকি?
মিতুল বলল,
- আমি ছাত্র ছিলাম।
এখন চাকরি খুঁজছি।
লোকটি একবার মিতুলকে খেলা বন্ধ করতে বলে বললেন,
- তার সাথে গেলে তাকে কাজ দিতে পারবেন।
এ কথা শুনে মিতুল ভাবে, এ আবার জাপানি দালাল না তো?
যেহেতু তার ভিতর ঢুকে গেছে টাকা ছাড়া জাপানে কোনো কাজ পাওয়া যায় না। তাই এই লোক নিশ্চয় তার কাছে টাকা চাইবে।
এমনটাই ভাবে মিতুল।
লোকটির কথা শুনে মিতুল কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। মিতুলকে ইতস্তত করতে দেখে বললেন,
- তোমার কোনো ভয় নেই। আমার এখানেই তোমাকে কাজ দেবো। ফ্যাক্টরির কাছেই থাকার ব্যবস্থা আছে। যদি কাজ করো তাহলে তোমাকে কাজের বিনিময়ে প্রতি ঘন্টায় এক হাজার ইয়েন করে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে।
এই কথা শুনে মিতুল প্রশ্ন করে,
- তোমার কি নিজের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে?
মেয়েটি তাদের দু'জনের কথা শুনে কিছুটা আনন্দ পায়, আবার বিরক্তও বোধ করতে শুরু করে। মেয়েটির কাছে একজন বিদেশিকে তার অধীনে প্রথম এই গুটি খেলা শিখানোর আনন্দ আর পাশের লোকটি যে তার ব্যবসার ক্ষতি করছে এজন্য বিরক্ত হয়ে বলল,
- এখানে প্রতিদিন অনেক লোক আসে পাচিংকো খেলতে। তুমিও এসো, আসলে দেখবে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মালিকরা এখানে আসে খেলতে। তাদের সাথেও তোমার পরিচয় হবে।
মিতুল প্রথম জানে সে এখন যে খেলা খেলছে এ নাম যে পাচিংকো। মেয়েটি তার সাথে কথা বলে মিতুলকে পাচিংকো খেলার প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। এসময় সে আবার পকেট থেকে আরেকটি ইয়েনের নোট বের করে দু'জনের কথার মাঝেই খেলতে শুরু করে। অনেকটা নেশায় পেয়ে বসে যেন মিতুলকে। ইয়েনের নোট ঢুকিয়ে খেলতে শুরু করলেই বাজি লেগে যায়। এতে মিতুল লাফিয়ে উঠে। একবার লাগলে সে আর কারো দিকে তাকায় না। কথা বলা তার বন্ধ। দুই পা আনন্দে নাচায় আর গুটি বের হওয়া দেখে।
একসময় খেলা শেষ করে মিতুল। পাশের লোকটি একটা কাগজে তার নাম ঠিকানা এবং ফোন নম্বর লিখে মিতুলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বের হয়ে চলে যান। মিতুলের সাথে থাকা মেয়েটি তখন অন্য কোথাও আর ডিউটি না করে তার আশে পাশেই ঘুর ঘুর করতে শুরু করে। মেয়েটি তাকে খেলা বন্ধ করতে দেখে সামনে এসে তার জমানো গুটিগুলো নিজ হাতে বয়ে নিয়ে একটা বড় মেশিনে ঢেলে দেয়।
মেশিনে ঢেলে দিলে মিটারে গুটি গুলো গুনে তার সংখ্যা দ্রুত টিক টিক করে একটা ছোট স্ক্রিনে শো করতে থাকে। মেশিনে গুটি গণনা শেষ হলে গুটি গুলোর বিনিময়ে এক ধরনের কার্ড দেওয়া হয় তাকে। সেই কার্ড গুলো নিয়ে সামনেই রাস্তার ওপারে একটা ছোট ঘরে জমা দেয়। এতে এই কার্ডের বিনিময়ে হিসাব করে অনেক গুলো ইয়েনের নোট দেয় তাকে। সাথে তাকে খাবার জন্য কফির ক্যানও দেয়। সেই ইয়েনের নোটগুলো গুনে মিতুল মেয়েটিকে আবার আসার আশ্বাস দিয়ে আনন্দ করতে করতে চলে যায়।
যাওয়ার সময় পাচিংকো থেকে পাওয়া কফির ক্যান পকেটে রেখে একটা কফি শপে বসে কফি খেতে খেতে সে চিন্তা করে, যতোদিন তার চাকরি না হয় ততোদিন সে এখানে এসে দুই এক ঘণ্টা করে পাচিংকো খেলবে যাতে করে দুই একদিনের রোজগার এই পাচিংকো খেলা থেকেই উঠে আসে।
এরপর ভাবে, কাজ করলেও তার বেতনের বাইরে এই বাড়তি রোজগারের টাকা দিয়ে দেশে সে ভালো কোনো কিছু করতে পারবে যা থেকে যাবে আগামী দিনগুলোর জন্য।
(চলবে)
লেখক: জাপান প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক।
সান নিউজ/এমএম