গলির এক কোণে বসে, ছোট-ছোট মেয়েদের সঙ্গে খেলা করছিল ও। বস্তির মধ্যে, ওর মা ওকে খুঁজে-খুঁজে হন্যে হয়ে যাচ্ছিল। ওদিকে, কিশোরি তাদের ঘরটাতে, অপেক্ষা করছিল, আর, তার জন্য কে যেন চা আনতে গেছিল তখন।
বস্তির তিনটে তলার আনাচে কানাচে খুঁজছিল সরিতার মা। মরতে কোথায় যে ঢুকে বসে আছে মেয়েটা! বাথরুমে নয় তো? ‘সরিতা—সরিতা’, সেখানেও একবার ডাক পেড়ে এল সে। তারপর, বুঝতে পারল, ও বস্তিতেই নেই!
সরিতা তখন গলির কোণটাতে ডাঁই-করা আবর্জনার স্তুপের পাশে, বাচ্চা মেয়েগুলোর সঙ্গে মেতে উঠেছে খেলায়।
ওর মা তখন আতঙ্কে। ঘরে বসে অপেক্ষা করছে কিশোরি। কথা মতো, দু-জন লোককেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, যাদের বেশ টাকাকড়ি আছে বলে মনে হয়, বড় বাজারটার মুখে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ওদের, ওরা অপেক্ষা করছে সেখানে। কোথায় উধাও হল সরিতা? সিরসিরে এক আতঙ্ক ছেয়ে ফেলে সরিতার মাকে।
পেটখারাপের অজুহাত আর কতবার দেবে! তাছাড়া, সে এখন সেরেও গেছে। গাড়ি চেপে মানুষজন তো আর রোজ-রোজ আসবে না ওদের কাছে! স্রেফ, কিশোরির বদান্যতা যে মাসে একবার কী দু-বার বাড়ি বয়ে এমন খদ্দের নিয়ে আসে। কিশোরির নিজেরই অস্বস্তি লাগে এখানে ঢুকতে।
উঠোনে পানের পিক, বিড়ির টুকরো, যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বড় লোকেরা এ-সব জায়গায় পা রাখতে পারে? তবে কিনা ও বেশ চালাকচতুর বলে, বস্তিতে লোক নিয়ে আসে না বটে, বদলে, সরিতাকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে, সাজিয়েগুছিয়ে নিয়ে যায় তাদের কাছে।
বলে, এ-সময়টাই এমন, পুলিশ আর খোচড়দের ভিড়ভাট্টা লেগেই আছে বস্তিতে। সেদিন প্রায় একশজন লাইনের মেয়েকে ধরে নিয়ে গেল ওরা। এই তো, আমার মাথাতেই কেস ঝুলছে একখানা, যা দিনকাল, সবসময় চোখকান খোলা রেখে ধান্দায় নামতে হয়।
এতক্ষণে বেদম খেপে উঠেছে সরিতার মা। সে যখন হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছিল, তলার ধাপে বসে রোজকার মতোই বিড়ির পাতা কুচোচ্ছে রামদি। ওকে দেখে গজগজ করে উঠল সরিতার মা, ‘সরিতাকে দেখেছ?
কোন চুলোয় যে সেঁধিয়ে বসে আছে! ওহ! আজ-ই এমনটা হল। একবার খুঁজে পাই, হাড় গুঁড়িয়ে দেবো। বুড়োধাড়ি মেয়ে, সারাদিন শুধু হাঁটুর বয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে ধেই ধেই করে নেচেকুঁদে বেড়াচ্ছে। |
রামদি, চুপচাপ, বিড়ির পাতা কেটে যেতে লাগল। তাছাড়া, সরিতার মা তো আর ওকে সত্যি-সত্যি শোনাতে চায়নি কথাগুলো। রাগ করে ছুটোছুটির সময় যাকে সামনে পায় তাকেই এসব কথাগুলো উগড়ে দিয়ে চলে যায় ও।
কিছুদিন পরপরই রামদিকেও শুনতে হয় এই গজগজানি! সরিতার মা বস্তির মেয়েদের বলেই রেখেছে, তার সরিতাকে সে চাকরি-করা ভদ্রলোকের সঙ্গে বিয়ে দেবে। আর, সেইজন্যই তো ওকে লেখাপড়া শেখানোর তোড়জোড় এত।
মিউনিসিপ্যালিটি সদ্য একটা স্কুল খুলেছে এখানে, সরিতার মার বাসনা, মেয়েকে সেখানে ভর্তি করাবে। সে বলে, ‘তোমরা তো জান, দিদি, ওর বাবা সবসময় চাইত, ও লেখাপড়া শিখুক’! এই অবধি বলে ফোৎ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরিতার মা, তারপর তার মৃত স্বামীর গল্প শোনাতে বসে সকলকে।
শুনে-শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে ওদের। যে-কেউ যদি, রামদিকে একবার শুধু জিগ্যেস করে, ‘আচ্ছা, সরিতার বাবা তো রেলে কাজ করত, তা বড়সাহেব যখন ওকে অপমান করল, তারপর কী হল বল তো?', অমনি রামদি গড়গড় করে বলে যাবে, ‘তারপর তো সরিতার বাবা রাগে ফেটে পড়ে আর কী!
তখনই সাহেবকে বলল, “আমি তোমার চাকর নই, আমি সরকারের চাকরি করি। আমাকে যখন-তখন মেজাজ দেখানোর কোনও এক্তিয়ার নেই তোমার। আর শোন, আবার যদি যা-তা কথা বলেছ আমাকে, একটানে তোমায় চোয়াল উপড়ে নিয়ে গলার নাচে ঢুকিয়ে দেব, হ্যা?”
তারপর আর কী, যা হবার তা-ই হল! সাহেব আবার চটেমটে লাল হয়ে সরিতার বাবাকে অপমান করতে লাগল, সরিতার বাবা ধাঁই করে কষে একটা ঘুসি মারল বড়সাহেবের মুখে, তখন, সাহেবের মাথা থেকে টুপিটা ছিটকে মাটিতে পড়ে দশটুকরো হয়ে গেল আর সাহেব দিনের আলোতেও চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে লাগল।
তবে কী না, সাহেব তো আর ফেলনা লোক নয়! তার পায়ে ছিল আর্মিদের বুটজুতো, সপাটে সরিতার বাবার পেছনে এমন একটা লাথি মারল, মাটিতে পড়ে গিয়ে, পিলে ফেটে, ওই রেললাইনের ধারেই বেঘোরে মরে গেল লোকটা।
তা, সরকার অবশ্য কেস করেছিল সাহেবের বিরুদ্ধে, কড়কড়ে পাঁচশোটা টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেয়েও ছিল সরিতার মা। কিন্তু, এমন কপাল! লটারি খেলার সর্বনাশা নেশায় ধরল তাকে, আর পাঁচ মাসের মধ্যেই সব গুলো টাকা উড়ে গেল!
সরিতার মার মুখে এই গল্পটা লেগেই থাকে। যদিও, এটা আদৌ সত্যি না মিথ্যে, তা কেউ জানে না। তাছাড়া, বস্তিতে আলাদা করে ওকে দরদ দেখাবে কে, যেখানে এদের প্রত্যেকের জন্যই দরকার একটু সহানুভূতি।
কেউ কারো বন্ধু নয় এখানে। পুরুষেরা, বেশিরভাগ-ই, দিনে পড়ে-পড়ে ঘুমোয়, রাতে জাগে। কাছের কারখানায় রাতের শিফটে কাজ করে ওরা। একসঙ্গে থাকে বটে সবাই, কিন্তু কেউ-ই কাউকে নিয়ে ভাবে না।
বস্তির সবাই, মোটামুটি, জেনে গেছে, যে, সরিতার মা তার কচি মেয়েটাকে বেশ্যাগিরি করতে পাঠায়। কিন্তু এরা কেউ-ই কারো ভালমন্দে নাক গলায় না, তাই, সরিতার মা যখন আগ বাড়িয়ে বলতে আসে, ‘আমার মেয়ে ধোয়া-তুলসিপাতা’, তখনও এরা মুখ বুজে থাকে, প্রতিবাদ করে না কোনও।
একদিন সকালবেলা তুকারাম সরিতার জন্য কিছু আগাম টাকা দিতে এসেছে যখন, সরিতার মা গলা ছেড়ে আর্তনাদ শুরু করে দিল, ‘ওমা কী হবে গো, এই জঘন্য লম্পট লোকটার কিছু একটা ব্যবস্থা কর তোমরা। আমার কুমারী মেয়েটাকে নোংরা চোখে চাটছে।
হে ভগবান! ওর দুচোখ অন্ধ করে দাও। আর, হ্যা গো, শুনতে পাচ্ছ তুমি, আমি কিন্তু একদিন এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব। তোমার পীরিতের বরের মাথা আমি জুতোর হিল মেরে ফাটিয়ে দেব। বাইরে যা খুশি করে বেড়াক গে, এখানে তো সভ্যভব্য হয়ে থাকতে হবে, না কি?’
চেঁচামেচি শুনে, তুকারামের টেরা বউ তার ধুতির গিট বাঁধতে বাঁধতে, ঝগড়ায় নামতে এগিয়ে এল এবার, ‘তুই ডাইনি মাগি, আর একটা কথা বলে দেখ! তোর কুমারি মেয়ে যখন হোটেলের ছোঁড়াগুলোকে চোখ মেরে বেড়ায়, আমরা কিছু দেখতে পাই না, না?
তোর বাড়িতে যেসব বাবুরা আসে, তাও আমরা জানি না, ভাবিস? ও রোজ সেজেগুজে বাইরে যায় কেন, শুনি? এরপরও, তুই বলেই এখানে তোর মানসম্মান নিয়ে থাকতে আসিস, যা না, অন্য পাড়ায় উঠে যা না তোরা!’
তুকারামের টেরা বউকে নিয়েও তো রসালো গল্পের অন্ত নেই। কেরোসিন তেলের ডিলার যখন কেরোসিন নিয়ে বস্তিতে আসে, ও তাকে ওদের কামরায় ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়, একথা কে না জানে! সরিতার মা বরাবরই এই ব্যাপারটা চাউর করে বেড়াতে চায়।
আজ সুযোগ পেয়ে ঘেন্না-মাখানো গলায় আবার চিল-চিৎকার জুড়ল, ‘আর, তোর নাগর, ওই যে কেরোসিনের ডিলার, ঘরে কম করে দু'ঘন্টা খিল এঁটে যে দুজনে বসে থাকিস, করিসটা কী? নাক ডুবিয়ে কেরোসিনের গন্ধ নিস বুঝি, আঁ?’
সরিতার মা আর তুকারামের বউয়ের মধ্যে এই থুতু-ছোঁড়াছুঁড়ি অবশ্য বেশিদিন জমেনি। তার আগেই, একদিন সরিতার মা দেখতে পেয়ে গেছিল ওর প্রতিবেশিনী নিকষ অন্ধকারে কার সঙ্গে যেন কী একটা লেনদেন করছে!
আর, ঠিক পরদিন-ই তুকারামের বউ দেখতে পেল, সরিতা সেজেগুজে একজন পুরুষের সঙ্গে মোটরগাড়ি চেপে চলেছে। ফলে, দুই মহিলার মধ্যে একটা চুক্তি হয়ে গেল, নিঃশব্দে। তাই, আজ যখন সরিতার মা তুকারামের বউকে জিগ্যেস করল, ‘মেয়েটাকে দেখেছ নাকি?’
টেরা চোখ একটু সরু করে, তুকারামের বউ গলির ও-প্রান্তে তাকিয়ে বলল, ‘ওই তো, ময়লার গাদার পাশে, ম্যানেজারের মেয়েগুলোর সঙ্গে খেলছে বসে’ বলেই, গলাটা একটু খাদে নামিয়ে ফের বলল, ‘কিশোরিকে এইমাত্র ওপরে যেতে দেখলাম যেন, তুমি দেখনি?’
সরিতার মা চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিচু গলায় জবাব দিল, সে তো ঘরের মধ্যেই বসে আছে, কিন্তু এখন সরিতাকে পাই কোথায় ? মেয়েটা একটুও কিছু ভাবে,বোঝেও না, সারাদিন শুধু খেলে বেড়াচ্ছে।’ বলতে-বলতে সরিতার মা ততক্ষণে ময়লার গাদার দিকে এগিয়ে গেছে।
সিমেন্টের পেচ্ছাপখানাটার পাশ দিয়ে মাকে আসতে দেখেই সরিতা লাফিয়ে উঠল। ওর মুখচোখের হাসি নিভে গেছে ততক্ষণে। মা খপ করে হাতটা টেনে ধরল ওর, ‘বাড়ি চল, তোকে আজ মেরেই ফেলব! এইসব ছাইপাঁশ নিয়ে খেলা করার চেয়ে ভাল কিছু খুঁজে পাস না তুই?'
তারপর যেতে যেতে একটু সুর নরম করে বলল, ‘কিশোরি এসেছে, সেই কখন থেকে বসে আছে। সঙ্গের মোটরগাড়িতে লোকজনও আছে। যা, তুই চটপট ওপরে গিয়ে সেজেগুজে নে। নীল জর্জেট শাড়িটা পরিস কিন্তু। আর শোন, চুলটা তো পুরো কাকের বাসা হয়ে আছে। তুই আগে জামা বদলে নে, আমি চুল বেঁধে দেব’খন।’
বড়লোকেরা গাড়ি চেপে এসেছে শুনলেই আহ্লাদে মন নেচে ওঠে সরিতার। আসলে, গাড়ির চালকের চেয়ে গাড়ির প্রতিই ওর টান বেশি। গাড়ি চাপতে ভারি ভালবাসে ও।
রাস্তার খোলা হাওয়ায় মোটরগাড়ি যখন গর্জন করতে করতে ছুটে চলে, আর বাতাসের ঝাপটা এসে ওর মুখে আছড়ে পড়ে, সবকিছুই যেন ঘূর্ণি হয়ে যায় তখন। মনে হয় ঝড় এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নির্জন রাস্তায়।
সরিতার বয়স পনেরো হতে চলল, কিন্তু তেরো বছরের বালিকার মতোই ওর হাবভাব। বড়দের সঙ্গে একটুও সময় কাটাতে ভাল লাগে না, বরং ছোটদের সঙ্গে বোকা-বোকা সব খেলাধুলোতেই ওর আনন্দ। কালো পিচের রাস্তায় চক দিয়ে আঁকিবুকি কাটতে খুব মজা পায় ওরা।
আর, ঘন্টার পর ঘন্টা, এই খেলাতে এমনই মশগুল হয়ে থাকে, যে কেউ দেখলে ভেবে নিতে পারে, পথের ট্রাফিক বুঝি ওদের এই আঁকাবাঁকা রেখার নিয়মেই নিয়ন্ত্রিত হয়!
সরিতা কখনও কখনও বাড়ি থেকে পুরনো বস্তার ফালি নিয়ে আসে, ও আর ওর কচিকাচার দল সারাদিন ধরে, একটুও ক্লান্ত না হয়ে টুকরোগুলোর ধুলোবালি সাফ করে, ফুটপাথে বসার জন্য পেতে রাখে তারপর।
সরিতা দেখতে কিছু আহামরি সুন্দরী নয়। ওর চামড়া, একটু ময়লা-হয়ে-আসা গমরঙের, কিন্তু মসৃণ, আর বম্বের জোলো আবহাওয়ার কারণেই বোধহয় বেশ চকচকে। তার পাতলা ঠোঁটদুটো কালচে, তিরতির করে কাঁপতে থাকে, ওপরের ঠোঁটে কুচি-কুচি ঘামের দানাগুলোও কেঁপে ওঠে তখন।
দারিদ্র্যে থাকলেও, ও শীর্ণ নয়। ছোটখাটো, মিষ্টি আর সুগঠিত শরীর। দেখে মনে হয়, যা কিছু দুর্দশা, ওর ঝকঝকে চেহারার কাছে এসে থমকে থেমে গেছে। ওর মলিন স্কার্ট যখন হাওয়ায় উড়ে যায়, পথচলতি লোকজন একবার আড়চোখে দেখে নেয়।
সরিতার কী সুশ্রী পায়ের গোছ, পালিশকরা কাঠের মতো চেকনাই! রোমবিহীন, ছোট ছোট রোমকূপ, দেখলে কমলালেবুর কথা মনে হয় , একটু চাপ দিলেই রস ফেটে পড়বে!
হাতগুলোও সুন্দর। গোল-গোল ছাঁদের। শস্তার সেলাই-করা ঝলঝলে ব্লাউজ ঝোলে সেখানে। ঘন লম্বা চুলে নারকেল তেলের চিটচিটে গন্ধ। বেতের মতো চ্যাটালো একটা বিনুনি হয়ে আছড়ে পড়ে পিঠের ওপর। সরিতার কিন্তু এই লম্বা চুল নিয়ে বিরক্তির শেষ নেই। খেলাধুলোর সময় চুল নিয়ে নানাভাবে বিব্রত হয়ে পড়ে ও।
সরিতার জীবনে না আছে কোনও উদ্বেগ, না আছে দুশ্চিন্তা। দুবেলা পেটপুরে খেতে পায় ও। ঘরের কাজকর্ম সব মা-ই সামলায়। শুধু, সকালবেলা বালতি ভর্তি করে জল এনে দিতে হয় ওকে, আর, সন্ধেবেলা, একপয়সার তেল কিনে, সেই তেল ভরে বাতি জ্বালতে হয়।
অভ্যেস মতো, আপনা আপনি-ই ওর হাত চলে যায় খুচরো পয়সার কাপে। তারপর ও ল্যাম্প নিয়ে নীচে নামতে থাকে।
সত্যি বলতে কী, কিশোরির ঠিক করে দেয়া ধনী লোকেদের সঙ্গে হোটেলে কিংবা আলো-আঁধারি জায়গাগুলোতে মাসের মধ্যে চার-পাঁচবার যে তাকে যেতে হয়, নিছক বেড়ানো ছাড়া এটাকে আর কিছুই ভাবতে শেখেনি সরিতা। অন্য কোনও চিন্তা মাথায় খেলেও না তার।
ও হয়তো ভাবে, কিশোরি সব মেয়েদেরই বাড়ি বাড়ি ঘুরে, বড়লোকদের সঙ্গে ঘুরতে পাঠায় তাদের। ওরলির ঠাণ্ডা কনকনে কিংবা জুহুর ভিজে স্যাঁৎসেঁতে বেঞ্চিগুলোর ওপর যা কিছু ঘটে যেতে থাকে, ওর মনে হয়, সব মেয়েদের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে।
একবার তো সরিতা মাকে জিগ্যেস করেছিল, ‘মা, শান্তা তো এখন দিব্যি বড় হয়ে গেছে, ওকে আমার সঙ্গে পাঠাও না কেন? লোকেরা আমাকে অনেক ডিম খেতে দেয়, আর, শান্তা ডিম খেতে এত ভালবাসে।’
সরিতার মা কোনওমতে উত্তর দিয়েছিল, ‘বেশ তো, ও না হয় একবার তোর সঙ্গে যাবে। ওর মা পুনে থেকে ফিরুক আগে!’ সুখবরটা শান্তাকে শোনাবার জন্য তর সইছিল সরিতার, পরদিন ও যখন বাথরুম থেকে বেরোচ্ছে সরিতা ছুটে গিয়ে ওকে জানাল।
‘সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, তোর মা পুনে থেকে ফিরলেই তুইও আমার সঙ্গে ওরলি যাবি।’ যেন খুব সুন্দর একটা স্বপ্নের বিবরণ দিচ্ছে, এভাবে, শান্তাকে একটু একটু করে রাতের ঘটনাগুলি বলতে থাকে সরিতা, আর, শান্তার মনে হয় সারা শরীর জুড়ে ছোট-ছোট ঘন্টা বেজে উঠছে।
শুনতে-শুনতে, অস্থির হয়ে ওঠে শান্তা, যেন কিছু শোনা বাকি রয়ে গেল তখনও, এমনভাবে ওর কাঁধ খামচে ধরে বলে, চল, নীচে বসে-বসে বাকিটা শুনব। সেখানে, পেচ্ছাপখানার ঠিক পাশে, গিরিধারী, ব্যবসাদার, নারকেলের ময়লা ছোবড়াগুলোকে চটের বস্তার ওপর শুকোতে দিয়েছে যেখানে, অনেক রাত অবধি সরিতা, শান্তা গল্প করে চলে। উত্তেজনায় গায়ে কাঁটা দেয় ওদের।
এখন, ঝটপট, একটা কাপড় ঝুলিয়ে বানানো পর্দার পেছনে দাঁড়িয়ে নীল জর্জেট পরে নিল সরিতা। গায়ে সুড়সুড়ি লাগছিল বটে, কিন্তু ডানা-মেলা পাখির মতো মন উড়ে বসছিল গাড়িতে চাপার ভাবনায়।
লোকগুলো কেন এ-ধরনের ব্যবহার করে এর সঙ্গে, কোথায়-ই বা নিয়ে যায় ওরা ওকে, এ-সব ভাবনা আদৌ জাগে না সরিতার মনে, খালি একটাই চিন্তা, গাড়িতে ওঠা থেকে ওর হোটেলের দরজায় নামা পর্যন্ত কতটুকু-ই বা সময়।
হোটেলের ঘরে, চার দেয়ালের মধ্যে বিশ্রী লাগে ওর। ঘরগুলোতে দুটো করে লোহার খাট পাতা থাকে। যেগুলোর একটাও ওর ঘুমোনোর জন্য নয়।
জর্জেট শাড়ি পরে, কুচির ভাঁজ গুছিয়ে নিয়ে একপলকের জন্য কিশোরির সামনে থামল ও ‘কিশোরি, দেখ দেখ, পেছন থেকে ঠিকঠাক লাগছে তো আমাকে?’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই এগিয়ে গিয়ে ভাঙা স্যুটকেশটা খুলে ফেলল।
ওর মধ্যে, জাপানি পাউডার আর রুজ রাখা থাকে। একটা ধুলোমাখা আয়না বের করে জানলার শিকে ঝুলিয়ে দেয় ও। একটু ঝুঁকে, গালে রুজ আর পাউডারের মিশ্রণ বুলিয়ে নেয়। সেজেগুজে, মুচকি হেসে, প্রশংসা পাওয়ার জন্য কিশোরির দিকে ফিরে তাকায় ।
ওর ঝলমলে নীল শাড়ি, যেমন তেমনভাবে ঠোঁটে লেপে-দেয়া লিপস্টিক, পেঁয়াজি রঙের পাউডার-ঘষা কালো গাল, সব মিলিয়ে ওকে এখন দেখাচ্ছে, দেওয়ালির দিন খেলনার দোকানে যেসব রঙচঙে মাটির পুতুলগুলো সাজানো থাকে, তাদেরই কোনও একটার মতো।
সরিতার মা ঘরে ঢুকল। মেয়ের চুল দ্রুত হাতে আঁচড়ে দিতে দিতে বলল, ‘শোন মা, ওদের সঙ্গে ভালভাবে কথা বলবি, যা-যা করতে বলবে, করবি, কেমন? মোটরগাড়ি চেপে এসেছে যখন, নিশ্চয়ই হাতে অনেক টাকাকড়ি আছে।‘
কিশোরিকে বলে সে, 'তাড়াতাড়ি পৌঁছে দাও, ওকে। বেচারিদের যে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে—’
বড় বাজারটার প্রায় মুখে, লম্বা একটা কারখানার দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে হলুদ রঙের গাড়িটা। সামনেই একটা ছোট বোর্ড লাগানো আছে, সেখানে লেখা : এখানে প্রস্রাব করা নিষিদ্ধ। গাড়ির মধ্যে তিনজন হায়দ্রাবাদি নাকে রুমাল চেপে কিশোরির জন্য অপেক্ষা করছে।
ওরা চেয়েছিল অন্য কোথাও গাড়ি রাখতে, কিন্তু দেয়ালটা যে বিরাট লম্বা, শুধু তা-ই নয়, তার সর্বত্র জুড়ে রয়েছে পেচ্ছাপের গন্ধ। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসেছিল যে, সে-ই সবার আগে দেখতে পেয়ে বন্ধুদের বলল, ‘ওই তো কিশোরি আসছে।
কিন্তু, সঙ্গে ...', রাস্তার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ও আবার বলল, ‘আরে! এ তো দেখছি একটা বাচ্চা মেয়ে, তোরা দেখ, ওই যে নীল শাড়ি-পরা!'
কিশোরি আর সরিতা গাড়ির সামনে এলে, পেছনে বসে-থাকা ছোকরা দু-জন তাদের টুপি খুলে নিল, তারপর সরিতাকে নিজেদের মাঝখানে বসার জন্য জায়গা করে দিল। কিশোরি এগিয়ে গিয়ে, দ্রুত, পেছনে ধাক্কা মেরে সরিতাকে ঠেলে পাঠাল গাড়ির মধ্যে।
তারপর দরজা বন্ধ করে, স্টিয়ারিং-এ বসে-থাকা ছেলেটিকে বলল, ‘মাপ করবেন, আসলে ও ওর এক বন্ধুর বাড়ি গেছিল, তাই একটু দেরি হয়ে গেল...যাকগে, দেখে নিন বাবু, সব ঠিক আছে তো?’
যুবকটি ঘাড় ঘুরিয়ে সরিতাকে দেখে নিয়ে, কিশোরিকে বলল, ‘চলবে!’ তারপর সিটের পাশে হেলে গিয়ে অন্য জানলা থেকে ফিসফিস করে কিশোরিকে জিগ্যেস করল, ‘মেয়েটা কোনও ঝামেলা পাকাবে না তো?’
কিশোরি বুকে হাত রেখে জবাব দিল, ‘আজ্ঞে না স্যার, আমি আছি তো!' ছেলেটা এবার পকেট থেকে একটা দু-টাকার নোট বার করে ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘ফুর্তি মারাও গে যাও!'
কিশোরি হাত নেড়ে চলে যেতেই কাফায়ত গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করল।
পাঁচটা বাজে। মোটরগাড়ি, বাস, ট্রাম আর পথচলতি লোকের ভিড়ে বম্বের বাজার একদম গমগম করছে। দুটো জোয়ান লোকের মাঝখানে প্রায় মিশে গিয়ে তার উরুদুটো চেপে রেখে, তার ওপর টানটান করে হাত মেলে সরিতা কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল।
কিন্তু মাঝপথেই থেমে গেল। আসলে, গাড়িচালক যুবককে ও বলতে চাইছিল, 'ভগবানের দোহাই, আরও জোরে গাড়ি ছোটাও, দম আটকে আসছে আমার।’
অনেকক্ষণ ধরে কেউ কোনও কথা বলছিল না। গাড়ি চালাচ্ছে যে, সে চালিয়েই যেতে লাগল। আর, পেছনের সিটে বসে-থাকা বাকি দু-জন হায়দ্রাবাদি ঘাবড়ে গিয়ে, ক্রমাগত লম্বা কালো কোটের আড়ালে ঘামতে থাকল, জীবনে প্রথম কোনও অল্পবয়সী মেয়ের গায়ে লেপ্টে বসে আছে ওরা! এই মেয়েটা ওদের একেবারে নিজস্ব, কোনও ভয় বা উদ্বেগ ছাড়াই ছুঁয়ে দেখতে পারবে ওকে।
স্টিয়ারিং-এ বসে-থাকা ছেলেটি, গত দু বছর হল, বম্বেতে। দিনের আলোয় কিংবা রাতের অন্ধকারে সরিতার মতো বহু মেয়ে দেখেছে সে। তাই, ততটা ঘাবড়াচ্ছে না। ওর এই হলুদ গাড়িতে চড়ে নানা ধরনের মেয়েরাই ঘুরে বেড়িয়েছে এর আগে।
হায়দরাবাদ থেকে ওর যে-দুই বন্ধু এসেছে, তার মধ্যে শহাব বম্বে পুরো ঘুরে দেখতে চায়। কাফায়ত বন্ধুর আমোদ আহ্লাদের জন্যই কিশোরিকে একজন মেয়েছেলে যোগাড় করার কথা বলেছিল।
তারপর, আনোয়ারকেও কাফায়ত জিগ্যেস করেছিল, ‘কি রে, তোরও একটাকে চাই নাকি?' লজ্জা ঝেড়ে ফেলে, আনোয়ার কিছুতেই মুখ ফুটে বলে উঠতে পারেনি, ‘হ্যাঁ, চাই?’
কাফায়ত আগে দেখেনি সরিতাকে। আসলে, কিশোরি বেশ কিছুদিন পর একটা নতুন মেয়ে নিয়ে এল। তাছাড়া কাফায়ত এমনিও ওর দিকে কোনও মনোযোগ দিচ্ছে না, কারণ, পুরুষমানুষ একসময়ে শুধুমাত্র একটাই কাজ করতে পারে!
ও যদি এখন মেয়েটার দিকে ঘন-ঘন তাকায়, তাহলে গাড়ি চালাবে কী করে? শহর ছেড়ে গাড়ি যখন শহরতলির রাস্তা ধরল, সরিতা প্রায় লাফিয়ে উঠল!
কোনও মতে দম চেপে বসেছিল এতক্ষণ, আচমকা গাড়ির গতি বেড়ে যাওয়ায়, হু-হু করে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা নামে মুখে এসে পড়ায় এবার তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন! হাত পা নেচে উঠল, আঙুলগুলো তিরতির করে কাঁপছে! এক মনে পেছনে ছুটে-যাওয়া গাছগুলোকে দেখতে লাগল সে।
আনোয়ার আর শহাবেরও আড়ষ্টভাব কেটে গেছে অনেকটা। শহাব ভাবল, মেয়েটার ওপর ওর-ই তো প্রথম দাবি, তাই আস্তে করে সরিতার পেছনে হাত ছোঁয়াল সে। সুড়সুড়ি লেগেছে বলে সরিতা ধপাস করে গিয়ে পড়ল আনোয়ারের কোলের ওপর।
হলুদ গাড়িটার জানলা ছাপিয়ে দূরে, অনেকদূরে ভেসে গেল ওর হাসির শব্দ। আবার শহাব হাত বাড়ানোর চেষ্টা করতেই, ঝুঁকে পড়ে, আরও জোর হাসিতে ভেঙে পড়ল সরিতা। আনোয়ার, জড়োসড়ো হয়ে শুকনো মুখে গাড়ির এককোণে, চুপচাপ সিঁটিয়ে বসে আছে তখন।
শহাবের মন নেচে উঠল খুশিতে। ও কাফায়তকে বলল, ‘এটা তো একটা খুদে বিচ্ছু, দেখছি!' বলতে-বলতেই দ্বিগুণ উৎসাহে সরিতার উরুতে চিমটি কেটে বসল শহাব। আর, আনোয়ারকেই হাতের নাগালে পেয়ে সরিতা ওর কান মলে দিল। হাসিতে ফুলে ফেঁপে উঠল মোটরগাড়ি।
যদিও সামনের আয়নায় সবই ফুটে উঠছে, তবু কাফায়ত বারবার পেছনে তাকিয়ে দেখছিল। মজায়, খুশিতে গাড়ির গতি বাড়িয়েই চলছিল সে।
সরিতার হঠাৎ ইচ্ছে হল, গাড়ির বনেটের ওপর, যেখানে একটা লোহার পরি রাখা আছে, সেখানে এবার চেপে বসবে সে। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়তে, শহাব তাকে টান দিল পেছন থেকে। কিন্তু সরিতা ততক্ষণে কাফায়তের গলা জড়িয়ে ধরেছে।
অকারণেই, কাফায়ত চুমু খেল ওর বাহুতে, সরিতার সারা শরীর কেঁপে উঠল, একলাফে গিয়ে বসল গাড়ির সামনের সিটটাতে। বসেই, কাফায়তের টাই নিয়ে খেলা করতে করতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘এই, তোমার নাম কী গো?’
‘আমার নাম? উমম, আমার নাম কাফায়ত।’ বলে, ও হাত বাড়িয়ে একটা দশ টাকার নোট গুঁজে দিল সরিতার হাতে। ওর নাম নিয়ে আর একটুও মাথা না ঘামিয়ে, নোটটা কুঁচকে-মুচকে সরিতা সটান চালান করে দিল ব্লাউজের মধ্যে। ছেলেমানুষের মতো খুশিতে ঝলমল মুখে ও বলল, ‘তুমি না খুব ভাল লোক। তোমার টাইটাও বেশ দেখতে।'
এই ঘটনার পর, সরিতার সবকিছুই ভাল লাগতে শুরু করে দিল। মনে হল, যা কিছু কালো, সেগুলোও সব আলো হয়ে উঠবে এখনই! আর এমনটাই ঘটছে তখন...মোটরগাড়ি বেদম জোরে ছুটছে...ঘূর্ণির মতে ঘুরপাক খাচ্ছে চারিপাশ।
হঠাৎ, গানও গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হল ওর, খুব। কাফায়তের টাই নিয়ে খেলা করা থামিয়ে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল ও, ‘তুমি ভালবাসা শিখিয়েছ আমাকে, ঘুমিয়ে-পড়া এই মনটাকে জাগিয়ে তুলেছ!’
কিছুক্ষণ, এই সিনেমার গান চলল। তারপর, পিছন ফিরে ও ছায়ার মতো চুপ করে বসে-থাকে। আনোয়ারকে নিয়ে পড়ল এবার। ‘আরে! তুমি একটাও কথা বলছ না কেন? গল্প কর, গান কর আমাদের সঙ্গে!’
আবার সরিতা লাফ মেরে পেছনের সিটে ফিরে এল। শহাবের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, ‘এখন আমরা সবাই মিলে গান গাইব, ওই যে, দেবিকারানি যে গানটা গাইত, ‘’হৃদয়ের জঙ্গলে আমি যে একটি চড়ুই, ছোট্ট ছোট্ট গান গাই...” ঈশশ, দেবিকারানি কী সুন্দর, তাই না?’
সরিতা এবার উরুর নীচে হাতদুটো চেপে রেখে, চোখ পিটপিট করে বলল, ‘অশোককুমার আর দেবিকারানি, দুজনে খুব কাছে কাছে দাঁড়িয়ে, দেবিকারানি বলছে, “বনের মধ্যে আমি, একটি চড়ুই, ছোট্ট ছোট্ট গান গাই”, অশোককুমার তখন বলছে কী, “তবে গাও।”’
সরিতা গানটা গেয়ে উঠল। '
ও থামতে, শহাব কর্কশ গলায় গান জুড়ল, ‘আমিও বনের পাখি হব, বনে-বনে গান গেয়ে যাব।’
দ্বৈতসংগীত শুরু হয়ে গেল ওদের, হঠাৎই। সঙ্গত করার ধরনে কাফায়ত মাঝে মাঝেই হর্ন বাজাচ্ছিল। সরিতা হাততালি দিচ্ছিল। আর তখন, তার সরু গলার সোপ্রানো, শহাবের হেঁড়ে গলার গান, হর্নের প্যাক-প্যাক, হাওয়ার তুমুল শব্দ ও ইঞ্জিনের গর্জন, সব মিলেমিশে অর্কেস্ট্রা বেজে উঠল যেন!
সরিতা, শহাব, কাফায়ত, সবাই খুশি। ওদের খুশি-খুশি ভাব দেখে, আনোয়ারও খুশি হতে চাইছিল। আগেকার বাঁধো-বাঁধো হাবভাবের জন্য নিজেই অনুতাপ করছিল মনে মনে। ওর ঘুমিয়ে-পড়া মন, জেগে উঠে, এই উল্লাসের শরিক হতে চাইছে এখন।
গান গাইতে গাইতে, আনোয়ারের টুপিটা খুলে মাথায় পরে নিল সরিতা। সামনের সিটে লাফ দিয়ে চলে গিয়ে পুঁচকে আয়নার তাকিয়ে দেখতে লাগল, কেমন মানিয়েছে ওকে। আনোয়ার ভাবছিল, ‘এই টুপিটাই কি আমি পরেছিলাম, এতক্ষণ?’
কাফায়তের পুরুষ্ট ঊরুতে একটা চাপড় মেরে সরিতা বলল, ‘আচ্ছা শোনো, তোমার শার্ট-প্যান্ট, আর, ওই টাইটা যদি আমি পরে নিই, আমাকে একদম ভদ্রলোকদের মতো দেখাবে তাই না?’
এ-সব শুনতে-শুনতে, কী করবে কিছুই ভেবে না পেয়ে, আনোয়ারের কাঁধ খামচে ধরে শহাব বলল, ‘তুই একটা আস্ত গাধা!’ একমুহুর্তের জন্য আনোয়ার নিজেও মনে-মনে বলল, ‘ঠিক কথা।’
কাফায়ত তখন সরিতাকে জিগ্যেস করছে, ‘তোমার নাম কী?’ টুপির ফিতেটা চিবুকে গলিয়ে নিতে নিতে সরিতা উত্তর দিল, ‘আমার নাম? আমার নাম তো সরিতা।’
শহাব পেছনের সিট থেকে বলে উঠল, ‘তুমি তো মেয়ে নও সরিতা, জ্যান্ত একটা ইলেকট্রিক তার!’
আনোয়ারও কিছু একটা বলতে চাইছিল, তো, তার আগেই সরিতা চেঁচিয়ে গান ধরল, ‘প্রেমনগরীতে আমি ভাবি বাসা বাঁধি... চুলোয় যাক এ পৃথিবীঈঈঈ।'
পৃথিবীর সেই টান, ওদের সকলকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছিল। সরিতার বিনুনি-বাঁধা চুল, খুলে গিয়ে, অবাধ, উদ্দাম, কালো ধোঁয়ার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। সরিতা আজ বেজায় খুশি।
সবাই খুশি। আনোয়ারও মেতে উঠেছে এখন। গান থেমে যাবার পরও তার রেশ থেকে গেছিল গাড়ির মধ্যে, আর, ওরা সকলেই ভাবছিল, যেন খুব জোর বৃষ্টিপাত, থমকে থেমে গেছে হঠাৎ!
‘আর কোনও গান?’’ কাফায়ত জানতে চাইল সরিতার কাছে।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আরেকটা। ওরকম একটা সিনেমার গান, যা লোকজনের মুখে-মুখে চলে।’ পেছন থেকে জবাব দিল শহাব।
সরিতা আবার শুরু করল, ‘বাড়িতে এসেছে আজ বসন্ত। আমি পথ হাঁটছি, মাতাল!’
গাড়িও প্রায় মাতাল, তখন। টাল খেতে-খেতে পথ চলছিল। রাস্তা যেখানে সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখানেই সমুদ্র। সূর্যাস্তের পর কনকনে হাওয়া বইছে এবার।
গাড়ি থেমে-যাওয়া মাত্র, সরিতা দরজা খুলল। লাফিয়ে নেমে পড়ে সমুদ্রের তীর বরাবর দৌড়তে শুরু করে দিল। কাফায়ত আর শহাবও ওর পেছন-পেছন ছুটতে লাগল।
খোলা হাওয়া, সামনেই মস্ত সমুদ্র, আর বালি ফুঁড়ে গজিয়ে-ওঠা বিশাল সব তালগাছ…সরিতা বুঝতে পারছিল না, আসলে, কী চাইছে সে! আকাশে মিলিয়ে যেতে? সমুদ্রে মিশে যেতে? কিংবা, এতটাই উঁচুতে উড়তে, যেখান থেকে তালগাছগুলোর মাথা দেখা যায়।
...আর তারপর, আবার সেই পাগল হাওয়া, ইঞ্জিনের গর্জন, গাড়ির তুমুল গতি, হর্নের আওয়াজ...আহ! সবকিছু আজ তার কাছে আনন্দের।
তখন, তিন হায়দ্রাবাদি যুবক ভিজে বালিতে বসে-বসে বিয়ারের বোতল খুলছে। কাফায়তের হাত থেকে বোতল ছিনিয়ে নিল সরিতা, ‘দাঁড়াও! দাঁড়াও! আমি ঢেলে দিচ্ছি।’
গেলাস উপচোল ফেনায়। ফেনা দেখে উত্তেজনা জেগে উঠল সরিতার, বাদামি ফেনায় আঙুল ডুবিয়ে সে জিভে ঠেকাল বটে, কিন্তু পরক্ষণেই তিতকুটে স্বাদে মুখ কুঁচকে উঠল ওর। হো-হো করে হেসে উঠল কাফায়ত, শহাব। হাসতে হাসতেই আড়চোখে দেখে নিল কাফায়ত, আনোয়ারও হাসছে এখন।
পাক্কা ছ-বোতল বিয়ার খেল ওরা। কিছুটা পেটে ঢুকল, কিছুটা ফেনা হয়ে বালিতে পড়ল। সরিতা গান গাইছে তো গাইছেই! এক মুহুর্তের জন্য আনোয়ারের মনে হল, সরিতাও যেন বিয়ার দিয়ে বানানো!
সমুদ্রের জোলো হাওয়ায় ওর কালো চিবুক ভিজে গেছে। বেদম খুশি হয়েছে মেয়েটা। আনোয়ারও এতটাই খুশি, ও চাইছিল গোটা সমুদ্রটাই বিয়ারে ভরে যাক। সরিতাকে সঙ্গে নিয়ে ও তাতে সাঁতার কাটবে।
দুটো খালি বোতল ঠোকাঠুকি করে, জোরে, বাজাচ্ছিল সরিতা। শব্দে, মজা পাচ্ছিল সবাই, ওরা আবার হাসতে শুরু করে দিল সকলে মিলে। হাসাহাসির মধ্যেই সরিতা কাফায়তকে বলল, ‘চল, আমরা গাড়ি চালাব এবার।‘
সবাই উঠে পড়ল। ভিজে বালিতে বিয়ারের খালি বোতলগুলো গড়াগড়ি খাচ্ছে। ওরা ছুটতে ছুটতে গাড়িতে গিয়ে বসল। আবার, তুমুল হাওয়া, গাড়ির হর্ন, কালো ধোঁয়ার মতো, সরিতার, ভেসে-বেড়ানো-চুল! গান চলছে। হাওয়া কেটে এগিয়ে চলল মোটরগাড়ি।
সরিতা গান গাইতে লাগল। এবার সে পেছনের সিটে, আনোয়ার ও শহাবের মাঝখানে। আনোয়ারের মাথা এদিক থেকে ওদিকে টাল খাচ্ছিল। খুব দুষ্ট মেয়ের মতো সরিতা শহাবের চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল, আর, দেখতে-দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল শহাব।
সরিতা, আনোয়ারের দিকে তাকাল। সে-ও ঘুমে কাদা! সরিতা ওদের মাঝখান থেকে উঠে সামনের সিটে গিয়ে বসে পড়ল। | ফিসফিস করে বলল, ‘তোমার দু-বন্ধুকেই তো ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি, এবার তোমাকে দি?’
মুচকি হাসি হাসল কাফায়ত। ‘তাহলে গাড়ি চালাবে কে, শুনি?’ সরিতাও হাসল। ‘ও তো এমনি-এমনিই চলবে।’
অনেকক্ষণ, ওরা নিজেরা গল্পগুজব করল। বাজার এসে গেল এক সময়। তারপর যখন দেয়ালটা পার হচ্ছে ওরা, যেখানে বোর্ডে লেখা আছে, ‘এখানে প্রস্রাব করা নিষিদ্ধ', সরিতা বলল , ‘আমি এখানেই নেমে যাব।'
গাড়ি থামল। কাফায়ত কিছু বলার কিংবা করার আগেই সরিতা লাফ দিয়ে নেমে এল বাইরে। ওকে হাত নেড়ে, হাঁটতে শুরু করে দিল। স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে, চুপ করে বসেছিল কাফায়ত। সারাদিনের কথাই ভাবছিল বোধহয়।
সরিতা, থেমে, ঘুরে দাঁড়িয়ে, ফিরে এল আবার। ব্লাউজের মধ্যে থেকে দশ টাকার নোটটা বার করে, ওর পাশে রেখে দিল।
কাফায়ত ঠাট্টার সুরে বলল, ‘এটা আবার কী, সরিতা?'
‘এটা...মানে, এই টাকাটা আমি নেব-ই বা কেন?’ উত্তর দিয়েই ছুটে চলে গেল সে। কাফায়ত তখনও চেয়ে আছে নোটটার দিকে।
পিছনে ফিরে তাকাল কাফায়ত। এই দোমড়ানো-মোচড়ানো নোটটার মতোই, সেখানে, পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছ ওরা দু-জন, শহাব আর আনোয়ার।