হাসনাত শাহীন, বইমেলা থেকে : দেশের ক্রমবর্ধমান করোনা পরিস্থিতির কারণে বইমেলার সময়সূচিতে পরিবর্তন এনেছে মেলার আয়োজক কতৃপক্ষ বাংলা একাডেমি।
বুধবার (৩১ মার্চ) থেকে কার্যকর হয়েছে এই পরিবর্তিত সময়সূচি। পরিবর্তিত এই সময়সূচির অনুসারে এখন থেকে প্রতি কর্মদিবসের দিন বইমেলা শুরু হবে বেলা ৩টায় এবং শেষ হবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। আর, ছুটির দিনগুলোতে মেলা শুরু হবে বেলা ১১টায় এবং বন্ধু হবে সাড়ে ৬টায়।
এ নিয়ে মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির উপরে ভীষণ ক্ষুব্ধ মেলায় অংশগ্রহন করা বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশকরা। কোন ধরণের আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ ছাড়া হঠাৎ বাংলা একাডেমির এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রকাশকরা।
ক্ষুব্ধ প্রকাশকরা বলছেন, একেবারে একতরফাভাবে অমর একুশে বইমেলার সময় আড়াই ঘন্টা কমিয়েছে মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। বইমেলার প্রাণ বইয়ের প্রকাশকদের সঙ্গে কোন প্রকার আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ ছাড়ায় হঠাৎ করে রাত নয়টার পরিবর্তে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত মেলার সময় বেঁধে দিয়েছে বাংলা একাডেমি। এটা একেবারে অযৌক্তিক এবং অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।
এ বিষয়ে মেলার মূল প্রাঙ্গণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বেশিরভাগ প্রকাশকদের সঙ্গে কথা হয় সান নিউজের। এসময় প্রকাশকরা সান নিউজকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই যথাযথভাবেই এবারের মেলা পরিচালিত হচ্ছিল। হঠাৎ করে কি এমন হলো যে, প্রকাশকদের সঙ্গে কোন প্রকার আলাপ-আলোচনা ছাড়ায় মেলার সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করা হলো? সারাদেশে সব মার্কেট ও বিপণীবিতানগুলো সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক যেখানে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা রাখা হচ্ছে সেখানে কেন বইমেলা সাড়ে ৬টায় বন্ধ করা হবে?- এটা আমরা ভেবে পাচ্ছি না।
তারা আরও বলেন, এমনিতেই চৈত্রের প্রখর রোদের দুপুর তিনটার দিকে মেলা শুরুর পর থেকে প্রায় ৬টা পর্যন্ত অলস সময় কাটায় প্রকাশক ও তাদের স্টল ও প্যাভিলিয়নে কর্মরতরা। সন্ধ্যা ৬টার পর মেলা জমে ওঠে। আর ওই সময়টাতে মেলার প্রবেশদ্বার বন্ধের ঘোষণা দিয়ে প্রকাশকদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে বাংলা একাডেমি।
করোনার সংক্রমণ যেহেতু বাড়ছে সেহেতু মেলা শুরুর সময়টা পিছিয়ে দিয়ে বন্ধের সময়টাও বাড়িয়ে দেওয়া হোক। তিনঘণ্টা মেলা যদি করতেই হয় তাহলে বিকেল ৫টা থেকেই মেলা শুরু করা উচিত। কারণ এর আগে ৩টার পর ৫টা পর্যন্ত মেলা প্রাঙ্গণ জনশুণ্য থাকে। যেই সময় মেলায় বিক্রি শুরু হয় সেই সময়ে মেলা বন্ধের এমন সিদ্ধান্তে প্রকাশকরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বলেও জানান তারা। মেলা ঠিক যে সময়ে জমে উঠছে ঠিক সেই সময়ে মেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত না নিয়ে প্রকাশকদের ক্ষতির মুখে ফেলে ও প্রকাশনাশিল্পকে হুমকির মুখে ফেলার জন্য বাংলা একাডেমি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করছে বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন প্রকাশক।
রাত ৯টার পরিবর্তে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অমর একুশে বইমেলা বন্ধে বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে মেলার ১৪তম দিন বুধবার (৩১ মার্চ) বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে প্রতিবাদি পদযাত্রা করেছে প্রকাশকরা। প্রতিবাদি এই পদযাত্রায় অংশ নেন সময় প্রকাশনীর কর্ণধার ও জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ, কাকলীর নাসির আহমেদ সেলিম, অনুপমের মিলন নাথ, অন্বেষার শাহাদাত হোসেন, পার্ল এর হাসান জায়েদী তুহিন, নালন্দার রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল, তা¤্রলিপির এ কে এম তরিকুল ইসলাম রনি, পলল এর খান মাহবুব, মুক্তচিন্তার শিহাব বাহাদুর প্রমুখ।
প্রতিবাদি এই পদযাত্রায় চলতে চলতে ফরিদ আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী যেখানে বলেছেন, দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে হবে এবং সেই লক্ষ্যেই একটা নির্দেশনা মেনে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হচ্ছে। তাছাড়া দেশের প্রায় সব মার্কেট এবং দোকানপাট রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকছে। কিন্তু যেকোন জায়গা থেকে স্বাস্থবিধি মেনে অনুষ্ঠিত বইমেলা অনেক বেশি নিরাপদ হওয়া স্বত্তেও বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ আমাদের সকল প্রকাশকদের অগ্রাহ্য করে এবং কোন ধরণের আলোচনা ও পরামর্শ না করে হঠাৎ করে মেলা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত চালু রাখার সময় বেঁধে দিয়েছে। এটা একেবারে অযৌক্তিক এবং অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।
এসময় তিনি আরও বলেন, এই সিদ্ধান্তটি বইমেলার নীতিমালারও পরিপন্থি। কেননা, মেলার সময়সীমা পরিবর্তন ও মেলা সংক্রান্ত যেকোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হলে প্রকাশকদের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শ করেই নিতে হবে। এ জন্য আমরা আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৩টায় জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি ও পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি সুরাহার জন্য যাবো। মেলা কতৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হলে তা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করবো। এ সংবাদ সম্মেলনে আমরা আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবো।
এদিকে, মেলা প্রাঙ্গণের বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে সান নিউজ। এসময়, ঐতিহ্য প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজল বলেন, সাড়ে ৬টায় মেলা বন্ধ করার বিষয়ে বাংলা একাডেমির একতরফা সিদ্ধান্তে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো চরমভাবে। তিনটার সময় মেলা শুরু হওয়ার পর মেলাপ্রাঙ্গণ পুরো খালি থাকে। ৫টার দিকে লোকজন আসা শুরু করে। ওই সময়টাতেই আমাদের বিক্রি বেশি হয়। সময় কমাতে হলে মেলা ৫টায় শুরু করুক আর রাত ৯টায় বন্ধ করুক। তাতে আমাদের ক্ষতি কিছুটা কম হবে।
প্রকাশনা সংস্থা ইন্তামিনের স্বত্তাধিকারি এ এস এম ইউনুছ বলেন, ৫টার পর্যন্ত অফিস-আদালত বন্ধ থাকে। অফিস শেষ করেই লোকজন মেলায় আসে। সাড়ে ৬টায় যদি বন্ধই করে দেয় তাহলে লোকজন মেলায় আসবে কিভাবে? এই প্রকাশক ক্ষোভ প্রকাশক করে বলেন, এবারের মেলায় ৫ লাখসহ আমি প্রায় ৩০ লাখ টাকা ইনভেস্ট করেছি। কিন্তু গত ১৩দিনে বিক্রি করেছি মাত্র ৫ হাজার টাকার মতো। এমনিতেই আমরা ক্ষতিগ্রস্থ , এর উপর বাংলা একাডেমির এমন সিদ্ধান্ত আমাদের ব্যবসা হুমকির মুখে ফেলবে।
পারিজাত প্রকাশনীর শাখাওয়াত হোসেন লিটু বলেন, সাড়ে ৬টায় বন্ধ না করে ৪টায় শুরু করে ৮টা পর্যন্ত মেলার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া উচিত। তিনটার সময় মেলা শুরু করে লাভ কি? কারণ ওই সময়টাতে মেলায় কেউই আসেনা।
বাংলা একাডেমির এমন সিদ্ধান্তকে একতরফা ও হাস্যকর উল্লেখ করে প্রকাশনা সংস্থা টাঙ্গণের সঙ্গীতা সরকার বলেন, তারা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত মেলার সময় বেঁধে দিয়েছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে করোনা কি সাড়ে ৬টার পরেই থাকে, এর আগে কি থাকেনা। আমি একতরফা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাই।
প্রকাশনা সংস্থার বর্ণমালার কর্ণধার মামুন-অর-রশিদ বলেন, বাংলা একাডেমির এই একতরফা সিদ্ধান্ত আমাদের প্রকাশনাশিল্পকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। অন্য সবার মতো আমরা সরকারকে ট্যাক্স ও ভ্যাট দিয়ে ব্যবসা করলেও সব সেক্টরে সরকার প্রণোদনা দিলেও আমাদের প্রকাশনা সেক্টরে কোন প্রণোদনা দেয়নি। গত এক বছর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাতে আমরা এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্থ। আর বাংলা একাডেমির এই সিদ্ধান্ত আমাদেরকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
জয়তী প্রকাশনীর পায়েল হাওলাদার বলেন, প্রকাশকদের প্রতিবাদের মুখে বাধ্য হয়ে বাংলা একাডেমি এবারের একুশের মেলার আয়োজন করেছে। ওই জিদ থেকেই প্রকাশকদেরকে ক্ষতিগ্রস্থ করার জন্য তথা পথে বসানোর জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবারের মেলা তারা চায়নি। তাই নানা বাহানায় প্রকাশকদের পথে বসানোর পাঁয়তারা শুরু করেছে।
চারুলিপির হুমায়ুন কবির বলেন, যখন মানুষ আসা শুরু করে তখন যদি মেলা শেষ হয়ে যায় তাহলে মেলায় মানুষ আসবেনা এটাই স্বাভাবিক। এতই যদি সময় কমানোর ইচ্ছা তাহলে তিনটার মেলা পাঁচটায় শুরু করুক আর নয়টায় বন্ধ করুক। আমি বাংলা একাডেমির এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাই।
প্রসঙ্গত, একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক অপরেশ কুমার ব্যানার্জীর গণমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে দেশের ক্রমবর্ধমান করোনা পরিস্থিতিতে ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২১’-এর সময়সূচি সম্পর্কে জানানো হয়।
সময়সূচির পরিবর্তনের এ বিষয়ে ‘অমর একুশে বইমেলা-২০২১’ পরিচালনা কমিটি সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমেদ সান নিউজকে বলেন, দেশে করোনা পরিস্থিতি ক্রমাগত বাড়ছে। এ কারণে মেলার সময়সূচিতে পরিবর্তন নিয়ে আসা হয়েছে। এ পরিবর্তিত সময়সূচি অনুসারে ছুটির দিনব্যাতিত অন্যান্য যে কোন কর্মদিবসের দিন মেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায় এবং শেষ হবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। আর, ছুটির দিনগুলোতে মেলা শুরু হবে সকাল ১১টায় এবং চলবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত।
সান নিউজ/এইচ এস/আরআই