উম্মে সামিরা:
আমার শ্রদ্ধার ঢেঁকি পরম পূজনীয় বাবা-মা নিঃসন্তান ছিলেন দীর্ঘদিন।
কত তপস্যা, কত মানত, কত উপোস! অবশেষে অনেক তর্জমা-গর্জমা করিয়া, ঢাক-ঢোল পিটাইয়া জন্মিলাম আমি।
পরিবার হিসেবে বিধাতা নির্ধারণ করিয়া দিলেন এক সম্ভ্রান্ত বনেদী গুষ্ঠিকে।
ঐশ্বর্য আর প্রতিপত্তিতে সর্বেসর্বা, বহদ্দারবাড়ী বলিলেই আগুনের ঝলক উঠিতে চাহে যেনো!
সেই ঝলক দেড় যূগ পর এখনো টিকিয়া আছে সেকালের মতই।
আঠারোতে পদার্পণ করিলাম সদ্যই,
তবু শৈশবের কিছু স্মৃতি আজও মোর অন্তরাত্মাকে নাড়া দিয়া বেড়ায়,
সেই পাড়ি দিয়া আসা শিশুসুলভ পুলকিত সিন্ধুতে আবারও সাঁতরাইতে মন চাহে! শৈশবে ঘটিয়া যাওয়া একখান কাণ্ডের কথা মনে পড়িলেই হাস্য-রসাত্মকভাবে ফাটিয়া পড়ি।
বয়স সাত কী আট ছিলো মোর তখন।
বাড়ির বড় উঠোনের এক কোণে অল্প জায়গা পাড়িয়া গড়িয়া উঠিয়াছিলো মোর দাদা-পরদাদার আমলের একখানা আটচালা গুদাম।
যদিওবা সেই আমলে যেকোনো বাড়ির জন্যই ইহা অপরিহার্যতো বটেই,ঢের প্রয়োজনীয়ও ছিলো।
কেননা কতোক খড়, পাতা, বাঁশসহ লাকড়ি হিসেবে উনুন জ্বালাইবার জন্য যাহা লাগিতো,
কিংবা রন্ধন শিল্পে যেই সমস্ত উপদানের ব্যবহার অনস্বীকার্য ছিলো,
তাহার সবখানি এই ঘরটাই নীরবে হজম করিয়া লইতো কিংবা আশ্রয় করিয়া দিতো।
বোতাম চাপিলেই বাতি জ্বলিবে;
এই তত্ত্বের বাহক হইয়া পল্লীগ্রামে বিদ্যুতের আগমনের প্রারম্ভিক কাল হইলেও অর্থবিত্তের যে সিন্দুক বানাইয়াছিল আমার পিতামহ এবং প্রপিতামহ, তাহার সুফল পাওয়া গেলো গাঁয়ের সকলকে পিছনে ফেলিয়া প্রথম বাড়ি হিসেবে বৈদ্যুতিক সুবিধাভোগে।
বলি, ইহাইতো পুরো রামায়ণ কাহিনীর মূল মন্ত্রটা পাড়িয়াছিলো সেদিন!
বসন্তের কোনো এক হালকা রৌদ্রময় সকালে এক দূরসম্পর্কের ভগ্নি ঠিক ঐ আটচালা গুদাম ঘরের সম্মুখে বসিয়া বেগুন কাটিতেছিলো, আর বিড়বিড় করিয়া রবীন্দ্র সংগীত গাইতেছিলো। যদিও ঐ গৃহে প্রবেশাধিকার ছিলো একদমই সংরক্ষিত, তবু …
আমি তাহা গায়ে না মাখিয়া খানিকটা উপেক্ষার সহিত কী যেনো অমূল্য-রতন অনুসন্ধান করিতে করিতে গুদামঘরে প্রবেশ করিয়াছিলাম।
চৌকাঠ পাড় হইয়া প্রথম কদম ফেলিবা মাত্রই সব দামী আসবাবপত্র চোখে পড়িলো আমার।
অধিকাংশ আসবাবই আমার চেনাজানার মধ্যে থাকিলেও অচেনা ছিলো শুধু একখানা লম্বা, অর্ধ-ইঞ্চি পরিমাণ মোটা প্লাস্টিকের সুতোর ন্যায় ঝুলন্ত বস্তু, যাহা জানালার পাশেই জায়গা দখল করিয়াছিলো।
তাহার সুন্দর নাম যে বৈদ্যুতিক তার, ইহা বোধ আসিবার পর বুঝিয়াছি আমি।
ঐ তারটির সহিত একখানা ধবধবে সাদা খেলনার জিনিসের ন্যায় কি যেনো আঁটানো ছিলো!
আমার প্রবেশে সকল আসবাব আমার দিকেই ফেলফেল করিয়া চাহিয়া রহিয়াছে, এমন কিছুই অনুভব হইতেছিল তখন;
কিন্তু ঐ সাদা বস্তুটা অহংকার করিয়াই বোধহয় একবারের জন্যেও তাকাইলোনা আমার পানে।
এই অবজ্ঞার কারণ খুঁজিতে গিয়া সেটিতে হাত দিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া দেখিতে লাগিলাম রহস্য অনুসন্ধানের নিমিত্তে। হঠাৎ আমার খর্বকায় দেহে অজানা এক শিহরন বইয়া গেলো যেনো!
দেহের জোরালো কাঁপুনিতে হৃৎপিণ্ডের শব্দও অনুভব করিতে লাগিলাম আমি।
মনে হইতেছিলো যেনো পুনর্জন্ম লইতেছি! তিন-চার সেকেন্ডের মধ্যেই এক অদ্ভুত শক্তি হাত দশেক দূরে ছুড়িয়া ফেলিলো আমায় একেবারে
অর্ধ অচেতন করিয়া!
তখন আমার মাথায় খেয়াল হইলো,
"এমন ক্ষমতা থাকিলে কার না অহংকার জন্মায়?"
আছাড় খাইয়া আমার মুখ হইতে যে চিৎকার বাহির হইয়াছিলো, তাহার শব্দে পুরো বাড়িসুদ্ধ লোক আসিয়া হাজির।
তুমুল তর্জন-গর্জনের সহিত সকলে ধরিয়া আমায় উঠোনের মাঝখানে লইয়া গেলো। হাতের আঙ্গুলে কী যেনো সাদা চিহ্ন দেখিয়া লোকে যখন আমায় জিজ্ঞেস করিলো কি হইয়াছে বাছা?
আমি "সাদা সুইচ হইতে শুরু করিয়া পরবর্তী বিবরণ টানিবার নিমিত্তে সবে মুখ খুলিয়া " সা... বলিয়াছি, তাহার সাথে সাথেই আমার মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া লোকেরা কহিতে শুরু করিলো "সাপে কাটিয়াছে, সাপে কাটিয়াছে।"
লোকেদের কথায় পরিবারের সকলের মধ্যে কান্নার রোল পড়িয়া গেলো মুহুর্তেই।
আমিও গায়ের কাঁপুনিতে পূর্ণ হুশ খুইয়া বসিয়াছি তখনই।
হুশ ফিরিবার পর দেখি,
পাড়ার সকলেই ব্যস্ত আমায় লইয়া।
হঠাৎ এতো মূল্যবান হইয়া ওঠার কারণটা তখনো বুঝিয়া পাইলাম না বটে।
যাহোক, বনেদি ঘরের বড় মেয়ে বলে কথা!
মোরে লইয়া এক প্রকারের দজ্ঞযজ্ঞ চলিতে লাগিলো।
ডাক্তার হইতে শুরু করিয়া হুজুর, কবিরাজ কোনো কিছুইতো বাদ পড়িলোনা।
শুরুতেই ডান হস্তের যে জায়গাটাতে আঘাতপ্রাপ্ত হইয়াছি, সেথায় একখানা রেশমের সুতো বাধিয়া দিয়াছিলো কে যেনো!
আমায় ঘিরিয়া নানা লোক নানান অদ্ভুত কর্মকাণ্ড করিতে লাগিলো।
কেউ আসিয়া জড়াইয়া ধরে, তো কেউ হাত দেখিয়া চলিয়া যায়।
সবশেষ অনেক অশ্রু বিসর্জনের পর গাঁয়ের হাসপাতালে গিয়া মোর হাত হইতে বাধা অংশের জমাট বাধা সমস্ত রক্ত ধারালো ব্লেড দিয়া ঝরাইয়া ফেলিলো কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো কমলার ন্যায় গোলগাল চশমাওয়ালা ডাক্তার মশাই।
ইহাতেই সকলের সন্দেহ মিটিলো, বুঝি আর কোন বিপদ নেই!
তবে কে জানিতো যে, তাহাদের এসব কার্যকলাপ একেবারেই অবাঞ্ছনীয়, অর্থহীন।
তাহার আফসোস আজও আমি কোনোভাবেই মিটাইতে পারি না।
সকল চিকিৎসার সাথে কিছু সাতপাঁচ বুজ দিয়া ডাক্তারবাবু যখন বাড়ির লোকদের আমার সুস্থতার বিষয়ে আশ্বস্ত করিতে সক্ষম হইলো, তখন আমার মণি কাকা আমায় কোলে করিয়া বাড়িতে লইয়া আসিলো।
যখন আমি মুখ খুলিয়া সর্পের বদলে বৈদ্যুতিক ধাক্কা খাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করিলাম, সাথে সাথেই বাড়িসুদ্ধ মানুষের মাঝে হাসির রোল পড়িয়া গেলো।
এই ঘটনা কেন্দ্র করিয়া পুরো সিকদার পাড়ায় একটা তুমুল হর্ষ-ধ্বণির সহিত খ্যাতি রটিয়া গেলো আমার।
আজও শৈশবের সেই অবাক করা স্মৃতি গুলা হৃদয় বাতায়নে দোলা দেয়, আমিও মস্তিষ্কে তাহাদের জায়গা করিয়া দেই খানিক সময়ের জন্য।
প্রায়শই বর্তমান দুনিয়ার সহিত আমার শৈশবের এই রসালো ঘটনার মিল খুঁজিয়া পাইয়া নিজের অজান্তে মুখে মুখে এই কথাখানি আওড়াইয়া বেড়াই বারবার;
"কেনো ক-তে কলিকাতা বুঝি আমরা?"
লেখকঃ উম্মে সামিরা
বারো আউলিয়া ডিগ্রি কলেজ,
লোহাগড়া, চট্টগ্রাম।