হাসনাত শাহীন: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিন। লাল-সবুজের রঙে রাঙানো রাজধানী ঢাকা। উৎসবমুখর গোটা জাতি। উৎসবের সেই ঢেউ আছড়ে পড়েছে অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণে।
একেতো স্বাধীনতা দিবস। তার উপর সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার। লোকে লোকারণ্য ছিল স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। জনতার সেই ঢেউয়ের স্রোত প্রবাহমান ছিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেও।
শুক্রবার (২৬ মার্চ) স্বাধীনতা দিবসের মেলার প্রবেশদ্বার উন্মোচন করা হয় সকাল ১১টায়। প্রবেশদ্বার খোলার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত মেলাজুড়ে ছিল সুনসান নীরবতা। বিকেল ৫টার পরে আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে উঠে বইমেলা। এসময় থেকে মেলায় আসতে থাকে বইপ্রেমী ও দর্শনার্থীরা। সন্ধ্যার আগেই জমে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। আর, বইপ্রেমী ও দর্শনার্থীদের দ্বীপ্ত পদচারণায় এসময় থেকে মেলাপ্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে ধুলির স্বর্গরাজ্য।
করোনার চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে মেলা প্রাঙ্গণে ভিড় জমায় শিশু থেকে বৃদ্ধসহ প্রায় সবশ্রেণীর মানুষ। এদিনের মেলায় শুধু দর্শনার্থীরাই আসেন নি, বইপ্রেমীরাও এসেছেন। হাতে হাতে বই, ব্যাগভর্তি বই স্বাধীনতা দিবসের মেলাকে শুধু সৌন্দর্যের পথেই ধাবিত করেনি, সফলতার দিকেও ধাবিত করেছে। শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এদিন প্রায় সকল সবধরণের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেই ছিল বইপ্রেমীদের উপচেপড়া ভিড়।
বর্ণমালা প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী নুসরাত জাহান মাতৃ খন্দকার বলেন, আগেই জানতাম স্বাধীনতা দিবসে মেলা জমে উঠবে। আমাদের অনুমান সত্যি হয়েছে। তবে, যতটা ভেবেছি তার চেয়েও অনেক বেশি মানুষ মেলায় এসেছে। আর প্রায় সকলেই বই কিনেছে। ঐতিহ্য প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজল বলেন, প্রত্যাশার চেয়েও স্বাধীনতা দিবসে বেশি ভিড় হয়েছে। আমি মনে করি প্রতিটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেই ভালো বিক্রি হয়েছে। এই কয়েকদিন যেসব প্রকাশনা স্টল বিক্রির খরায় ছিল স্বাধীনতার দিনে সেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের খরাও কেটে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে এবারের বইমেলা বিগত বছরের সফলতার সকল রেকর্ড ভঙ্গ করবে। শুক্রবার মেলার নবম দিনে নতুন বই এসেছে ২৭৬টি, আর এই পর্যন্ত মোট নতুন বই এসেছে ১ হাজার ৮৪টি।
মেলার নতুন বই
শুক্রবার বইমেলায় নতুন বই এসেছে ২৭৬টি। এর মধ্যে গল্প ৩৭টি, উপন্যাস ৪৭টি, প্রবন্ধ ১২টি, কবিতা ৯৫টি, গবেষণা ৭টি, ছড়া ৪টি, শিশুসাহিত্য ৩টি, জীবনী ৯টি, মুক্তিযুদ্ধ ১১টি, বিজ্ঞান ৪টি, ভ্রমণ ২টি, ইতিহাস ১টি, রাজনীতি ২টি, বঙ্গবন্ধু ৮টি, রম্য/ধাঁধা ৪০টি, ধর্মীয় ২টি, অনুবাদ ২টি, সায়েন্স ফিকশন ২টি এবং অন্যান্য ২৪টি। এর মধ্যে কথাপ্রকাশ এনেছে মো. আবদুল হামিদের ভূমিকায় ও মুস্তাফিজ শফি সম্পাদিত প্রবন্ধ ‘মুজিব কেন জরুরি’, সেলিনা হোসেনের শিশু কিশোরদের ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’, রামেন্দু মজুমদারের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু ও বিবিধ ভাবনা’, অনুপম এনেছে ধ্রুব এষের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস সমগ্র’, নালন্দা থেকে নওশাদ জামিলের উপন্যাস ‘প্রত্যাবর্তন’, আগামী থেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, মোনায়েম সরকার ও সৈয়দ জাহিদ হাসানের যৌথ সম্পাদনায় প্রবন্ধগ্রন্থ ‘একাত্তরের ঐতিহাসিক মার্চ শতপ্রবন্ধ’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর রাজনৈতিক কলাম ‘বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের রাজনীতি’, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে সঙ্গীতা ইমামের কিশোর উপন্যাস ‘স্বাধীনতা ও আত্মজার গল্প’, প্রহেলিকা প্রকাশন থেকে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাব্যগ্রন্থ ‘হাওয়া কলে জোড়া-গাড়ি’, সাহিত্যবিকাশ থেকে হাসান টুটুলের গল্পগ্রন্থ ‘যুদ্ধ জয়ের পর’, ‘ভৌতিক গল্প অদ্ভুতুড়ে’, ‘সায়েন্স ফিকশন ক্লোরোডা’, নির্মলেন্দু গুণের কাব্যগ্রন্থ ‘চুমুর নূপুর’, কাকলী এনেছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘শর্টকাট প্রোগ্রামিং’, সময় থেকে আনিসুল হকের উপন্যাস ‘সুবেদার ওহাব আব্বা আব্বা বলে কাঁদেন’, এডর্ণ এনেছে গুলতেকিন খানের কাব্যগ্রন্থ ‘আজ তবে উপনিবেশের কথা বলি’ অন্যতম।
মেলার মূলমঞ্চের আয়োজন
বইমেলার এদিনের বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী : স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনা। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মফিদুল হক। আলোচনায় অংশ নেন শাহরিয়ার কবির এবং মোহাম্মদ হান্নান। স্বাগত বক্তৃতা করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।
আলোচকরা বলেন, মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য বিশ্বের কোনো দেশই বাংলাদেশের মতো এত মূল্য দেয়নি। ভয়াবহ গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর বিশ্বের বুকে সে দেশ অনন্য বিস্ময় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্বে সাফল্য অর্জনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে উন্নয়নের রোল মডেল। তারা বলেন, রাজনীতি, শিক্ষানীতি, সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রে যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করতে পারি তাহলে একাত্তরের শহিদদের আত্মদান সফল হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর লগ্নে স্বাভাবিকভাবে আমাদের দৃষ্টিসীমায় ভেসে ওঠে পঞ্চাশ বছরের পথ-পরিক্রমণ। আমরা যারা ইতিহাসের সাক্ষী, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রক্তরঞ্জিত বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রত্যক্ষদর্শী, তারা পঞ্চাশ বছরের পরিক্রমণের সঙ্গে দেখতে পাই রক্তসমুদ্র পেরিয়ে নতুন অভিযাত্রার সূচনা। ফলে কেবল পথরেখা নয়, রক্তরেখাও আমরা দেখি।
এই রক্তদাগের সঙ্গে মেশে, স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের উপান্তে সপরিবার বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতির জনকের রক্ত মিশে যায় একাত্তরের রক্তধারার সঙ্গে। ফলে স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন আমাদের বিপুল মূল্য দিতে হয়েছিল তেমনি স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেও অর্জনগুলো বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে জাতির শরীর। তারপরও মুক্তিযুদ্ধের আত্মদান, ইতিহাসের শক্তি এবং বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছে, সূচনা করেছে নতুন অভিযাত্রা, প্রমাণ করেছে, ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছাড়খাড়, তবু মাথা নোয়বার নয়।’ বাঙালি যখনই ফিরেছে ইতিহাসে, মুক্তিযুদ্ধে, জাতিসত্তায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে সর্বজনের কল্যাণে, অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধ সংহত হয়ে, তখনই খুঁজে পেয়েছে পথ। ইতিহাস যেমন আমাদের প্রেরণা, তেমনি ইতিহাসের কাছে আমরা দায়বদ্ধ, রক্তের ঋণে আমরা আবদ্ধ।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি রূপা চক্রবর্তী ও রফিকুল ইসলাম। সংগীত পরিবেশন করেন মৌটুসী পার্থ, সন্দীপন দাশ এবং তানভীর আলম সজীব।
অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে সকাল ৮টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানস্থ শিখা চিরন্তনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বাংলা একাডেমি।
সান নিউজ/এইচএস/আরআই