হাসনাত শাহীন: চলছে আপামর মানুষের প্রাণের মেলা ‘অমর একুশে বইমেলা’। বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের অনিঃশেষ পরিবর্তনশীল ঋদ্ধতার প্রতীক এই বইমেলাটি বুদ্ধিবৃত্তিক চৈতন্যের উৎসবই শুধু নয়, এ মেলাটি বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী সমাজ নির্মাণের অনন্য উৎস।
অথচ, এমনই এক উৎসের জায়গায় দেশের দুই প্রকাশনা সমিতির অনুরোধের ভিত্তিতে ৭টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল পরিবর্তন করেছে বাংলা একাডেমি, যা বইমেলার নীতিমালার সঙ্গে একেবারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। স্থান পরিবর্তন করা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- নূর কাশেম পাবলিশার্স, পারিজাত প্রকাশনী, একুশে বাংলা প্রকাশন, উত্তরণ, বর্ষা দুপুর, হাওলাদার প্রকাশনী ও শব্দশৈলী। এ বিষয়টিকে এধরনের স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে দেখছেন মেলায় স্থান পাওয়া অন্যান্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সত্তাধিকারীরা বলছেন, এই সাতটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের এ স্বেচ্ছাচারী আচরণের কারণে লটারির মাধ্যমে প্রকাশনাগুলোর আশে-পাশে অন্য যেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্টল পেয়েছে তারা এখন আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এর মধ্য দিয়ে মেলার নীতিমালা ভঙ্গের পাশাপাশি আমাদের এই প্রাণের মেলাটিতেও লেগে গেল একটা কলঙ্কের ছাপ। যা কখনোই কারো কাম্য হতে পারে না।
বিষয়টি নিয়ে সান নিউজ অনুসন্ধান করলে এর সত্যতা বেরিয়ে আসে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, নীতিমালায় না থাকলেও নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি এবং জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি স্টল পরিবর্তনের জন্য বাংলা একাডেমিকে লিখিত অনুরোধ জানায়। সেই প্রেক্ষিতে বাংলা একাডেমি তাদেরকে নতুন জায়গায় স্টল বরাদ্দ দেয়। অথচ, অমর একুশে বইমেলার ‘১৩.৫.ক’ নীতিমালায় বলা হয়েছে, “লটারির ফলই স্টল বরাদ্দের জন্য চূড়ান্ত বলে বিবেচত হবে। লটারিতে প্রাপ্ত স্থানে বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই স্টল নির্মাণ করতে হবে। বরাদ্দপ্রাপ্ত স্থানে স্টল নির্মাণ না- করলে বরাদ্দ বাতিল-সহ পরিচালনা কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত শাস্তি প্রাপ্য হবে।”
এ বিষয়ে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমেদ বলেন, ‘লটারিতে যেসব প্রতিষ্ঠান স্টল পেয়েছিল তাদের স্টলগুলোর মুখ বাইরের দিকে ছিল। মূল মেলা থেকে স্টলগুলো বিচ্ছিন্ন এমন যুক্তিতে তারা অন্যত্র স্টল চেয়েছিল। আমরা দিতে চাইনি, কিন্তু পরবর্তীতে প্রকাশকদের দুই সমিতির অনুরোধের ভিত্তিতে মেলার দক্ষিণ দিকে বিভিন্ন মিডিয়ার জন্য বরাদ্দকৃত স্থানে তাদের স্টলগুলো পরিবর্তন করে আনা হয়েছে। পরিবর্তিত স্থানে সাতটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ইউনিটের ১৭টি স্টল নির্মাণ করেছে।’
পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির রাজধানী শাখার সভাপতি মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যেক বছর বইমেলায় নকশার লে-আউট মেলা পরিচালনা কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে কমিটির সদস্যরা সেই লে-আউটটি পর্যালোচনা করেন এবং মতামত দেন। সর্বসম্মতিক্রমে যে লে-আউটটি চূড়ান্ত করা হয় তার ভিত্তিতেই স্টল বিন্যাস করা হয়। এবার সেই লে-আউটটি দেখার সুযোগ হয়নি।’
নীতিমালা ভঙ্গ করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে বাংলা একাডেমিকে অনুরোধ জানানোর বিষয়ে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘তারা নীতিমাল ভঙ্গ করেছে কিনা আমার জানা নেই। অমর একুশে বইমেলার ‘১৩.৫.ক’ নীতিমালার বিষয়টি তাকে অবহিত করা হলে তিনি সুকৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, নাগরিক হিসেবে যে কেউ আবেদন করতে পারে। আমরা আবেদন করে কোন ভুল করিনি।’
একই স্থানে আরো বেশ কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল রয়েছে। তারাওতো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা কী দোষ করেছে? ক্ষতিগ্রস্ত সকল প্রকাশকদের পক্ষ না নিয়ে শুধু সাতটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ কেন নিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘সাতটি প্রতিষ্ঠান তাদের সমস্যার কথা আমাদের জানিয়েছে। সেজন্য তাদের পক্ষে আবেদন করেছি।’
বাংলা একাডেমিকে দেয়া দুই প্রকাশক সমিতির আবেদনে বলা হয়, এবছর মেলার জায়গা বৃদ্ধি এবং নতুন ধরনের স্টলবিন্যাস করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই নতুন বিন্যাসে ৭টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ১৭টি স্টল মেলার শেষ সারিতে পড়েছে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই স্টলগুলো বইমেলার বাইরের দিকে মুখ করে করা হয়েছে। যে কারণে এই স্টলগুলো ক্রেতা-দর্শনার্থী থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত থাকবে। করোনাকালীন সময়ে নিঃস্ব হতে বসা এই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে এই প্রতিষ্ঠাগুলোর স্টল মিডিয়ার জন্য নির্ধারিত স্টলগুলোতে পরিবর্তন করে এই স্টলগুলোতে মিডিয়ার স্টল বরাদ্ধ করতে আপনাকে (বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক) অনুরোধ জানাচ্ছি। লেখক বলছি মঞ্চের সামনে মিডিয়ার স্টল থাকাটাই যৌক্তিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে। কারণ ঐ স্থানে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল থাকলে পুরো বইমেলায় ঐসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কোন বিক্রির সুবিধা পাবেন না।...”
করোনাকালীন সময় বিবেচনায় ২৫৩ থেকে ২৬৯ নম্বর ইউনিটগুলো পরিবর্তন করে নতুন স্থানে বরাদ্দ দেয়ার জন্য দুই প্রকাশক সমিতি অনুরোধ জানায়। এসব স্থানে লটারির মাধ্যমে সাতটি প্রকাশনা সংস্থা স্টলগুলো পেয়েছিল। প্রকাশনা সংস্থাগুলো হলো- নূর কাশেম পাবলিশার্স (২৬১); পরিবর্তিত স্টল নম্বর ৫৭০, পারিজাত প্রকাশনী (২৫৩-২৫৪ নম্বর স্টল); পরিবর্তিত স্টল ৫৭০(ন-ত), একুশে বাংলা প্রকাশন (২৫৯-২৬০); পরিবর্তিত স্টল ৫৭০(ঝ-ঞ), উত্তরণ(২৬৫-২৬৬); পরিবর্তিত স্টল ৫৭০(ঘ-ঙ), বর্ষা দুপুর (২৬২-২৬৪); পরিবর্তিত স্টল ৫৭০ (চ-ছ-জ), হাওলাদার প্রকাশনী (২৬৭-২৬৯) পরিবর্তিত স্টল ৫৭০ ( ক-খ-গ), শব্দশৈলী (২৫৫-২৫৮) পরিবর্তিত স্টল ৫৭০ (ট-ঠ-ড-ঢ) নাম্বার।
অভিযুক্ত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পারিজাত প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারি শওকত হোসেন লিটু বলেন, লটারিতে আমাদের স্টলগুলো মেলা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন জায়গায় পড়েছিল। যার কারণে আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতির আশংকায় ছিলাম। বিষয়টি বইমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান ও আমাদের দুই সমিতিকে জানাই। সুবিধাজনকস্থানে আমাদের স্টলগুলো বরাদ্দ দেয়ার জন্য তারা বাংলা একাডেমি বরাবর লিখিত অনুরোধ জানায়।
এদিকে, খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে- সাতটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের লটারির মাধ্যমে বরাদ্দকৃত স্থানের আশে-পাশে যেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বইমেলার নীতিমালা অনুসরণ করে স্টল দিয়ে বসেছে, তাদের একেবারেই বেচা-বিক্রি হচ্ছে না। তারা বলছে, যোগসাজশের ভিত্তিতে যেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অন্যত্র স্টল নির্মাণের সুযোগ নিয়ে চলে গিয়েছে, তারা এখানে থাকলে আমাদের কিছু বেচা-বিক্রি হতো। আমরা এমন স্বেচ্ছাচারিতামূলক মেলা এর আগে দেখিনি এবং ভবিষ্যতে এমন প্রাণের মেলায় এমন স্বেচ্ছাচারিতামূলক ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না। এবং এবারের মেলায় এই ঘটনার সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে নীতিমালা ভঙ্গের দায়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা চাই।
সার্বিক এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েজন লেখক-গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সান নিউজকে বলেন, বই- আধুনিক সভ্যতার জ্ঞান আহরণের অন্যতম প্রধান উপকরণ। যা, মানুষের চিন্তাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট পৌঁছে দেয়। শুধু তাই নয়, মানুষ তার মনের ভাব, অনুভূতি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার বিবরণ বইয়ের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে। একটা দেশ বা জাতির সংস্কৃতি, সভ্যতা ও যোগাযোগের অন্যতম বাহন নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় আমাদের প্রাণের মেলা- অমর একুশে বইমেলা। আর এই বইমেলায় যদি এমন সেচ্ছাচারিতা চলে তাহলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কী শিখবে, কী জানবে?
সান নিউজ/আরআই