হাসনাত শাহীন: আসছেন দর্শনার্থীরা। বিক্রি হচ্ছে বই। করোনাকে উপেক্ষা করেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে অমর একুশে বইমেলায় আসছেন বইপ্রেমীরা। ছুটির দিন আর উৎসব উপলক্ষ ছাড়া কর্মব্যস্ত দিনে মেলায় মানুষ আসে না। সাধারণ মানুষের এমন ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করেছে মঙ্গলবার (২৩ মার্চ) ষষ্ঠদিনে মেলায় আগত বইপ্রেমীরা।
যতই দিন যাচ্ছে মানুষের আগ্রহ বইমেলার প্রতি ততই বাড়ছে। চলমান করোনা পরিস্থিতিতে এবারের মেলার ষষ্ঠদিনে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রকাশনা সংস্থায় কর্মরতরা।
সপ্তাহের প্রতি কর্ম দিবসের জন্য মেলার নীতিমালা অনুসারে বিকেল ৩টায় প্রবেশদ্বার উন্মোচনের পর মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে বইপ্রেমীদের ভিড় বাড়তে থাকে। সন্ধ্যার দিকে মেলার লোকসমাগম এবারের মেলাকে প্রথম সপ্তাহ শেষ না হতেই সফলতার দিকে একধাপ এগিয়ে রাখে বইপ্রেমীরা।
লোকজনের আগমন আর স্টল ও প্যাভিলিয়ন ঘুরে ঘুরে বইকেনা এদিনের মেলার পরিবেশে নান্দনিকতার চিহ্ন ফুটিয়ে তুলেছে। সারাদেশে করোনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে থাকলেও বইমেলা যেন অন্য এক জগতে নিয়ে গেছে বইপ্রেমীদের।
মেলায় লোকজন কেমন আসছে এবং এবারের মেলায় করোনা কোন প্রভাব ফেলছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে কথাপ্রকাশের ব্যবস্থাপক ইউনুস আলী বলেন, আমিতো মনে করি বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবারের মেলায় লোকজন বেশি আসছে। গতবছর মেলার পরিসর ছিল সাড়ে ৮ লাখ বর্গফুট আর এবারের মেলার পরিসর ১৫ লাখ বর্গফুট। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে এবার মেলার পরিসর দ্বিগুন। গতবারের পরিমানও যদি লোকজন আসে তাহলেও এবারের মেলায় তা কম মনে হবে। কারণ এত বড় পরিসরে যত মানুষই আসুক কমই মনে হবে। অন্যদের কথা বলতে পারবো না এবারের মেলার সফলতা নিয়ে আমি ভীষণরকমের আশাবাদি।
এদিকে, বিগত পাঁচদিনের তুলনায় মঙ্গলবার প্রায় সবাই স্বাস্থবিধি মেনে মেলায় প্রবেশ করেছে। আগত ও প্রকাশনা সংস্থায় কর্মরতদের মুখেও মাস্ক ছিল। তবে, মাত্রাতিরিক্ত ভিড়ে কারণে প্রকাশনা সংস্থা তাম্রলিপি'র প্যাভিলিয়নের অনেক বইপ্রেমী স্বাস্থবিধি মেনে চলতে পারছেন না।
আয়মান সাদিকের বই প্রকাশ করার কারণে এবং প্রকাশনা সংস্থাটির সামনে বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলকে বসার জায়গা করে দেওয়ার কারণে এই প্রকাশনা সংস্থাটির সামনে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই স্বাস্থবিধি না মেনে সেলফি তোলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে তরুণ-তরুণীরা লেখকের সঙ্গে প্রতিদিন সেলফি তুলছে। তবে, এই প্রকাশনা সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্টরা যথাযথ স্বাস্থবিধি মানছেন।
আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন কিন্তু, ক্রেতারা অনেকে মানছেন না। আপনারা এবিষয়ে তাদের সচেতন করছেন না কেন?— এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলছেন, দর্শনার্থীরা যদি না মানে তাহলে আমরা কি করবো? আর বইমেলায় পুরোপুরি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভবও না। তারপরও যতটুকু সম্ভব মেনে চলার বিষয়ে আমরা দর্শনার্থীদের বোঝাচ্ছি। কিন্তু কে কখন সেলফি তুলছে সেটা এতকিছু আমরা খেয়ালও করতে পারছিনা।
মেলার নতুন বই
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের তথ্যমতে, ষষ্ঠ দিনে মেলার নতুন বই এসেছে ১১৮টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো- আগামী প্রকাশনী এনেছে হায়দার মোহাম্মদ জিতু বঙ্গবন্ধু থেকে দেশরত্ন, সময় প্রকাশন এনেছে মো. মাহবুবর রহমানের আওয়ামী লীগের শাসনকাল ১৯৭২-১৯৭৫, অনন্যা এনেছে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর উপন্যাস ‘পরাজয়, ইত্যাদি।
মেলার মূলমঞ্চের আয়োজন
মেলার এ ৬ষ্ঠ দিনে বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী : মুক্তিযুদ্ধ ও নারী’ শীর্ষক আলোচনা। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মনিরুজ্জামান শাহীন। আলোচনায় অংশ নেন মোহাম্মদ জাকীর হোসেন এবং একেএম জসীমউদ্দীন।সভাপতিত্ব করেন সেলিনা হোসেন।
প্রাবন্ধিক বলেন, সাধারণত মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকাকে দেখা হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হিসেবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশে নারীসমাজের রয়েছে অসাধারণ ভূমিকা। দেশমাতৃকার টানে জীবন বাজি রেখে তাদের অনেকে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ ও রণাঙ্গণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সংগঠকের দায়িত্ব পালন, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দান, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে থাকা, শত্রুশিবিরের তথ্য সংগ্রহ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রাখা-সহ বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেন। নারীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ সহজ ছিল না।
আলোচকরা বলেন, বাংলার আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে নারীর প্রতিবাদী, বিদ্রোহী ও যোদ্ধা-রূপ নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যায় বাঙালি জাতিকে। লড়াইয়ে অংশগ্রহণের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি পর্যায়ে নারীর ভূমিকা ছিল অনন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা ছাড়াও দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন গড়ে তোলায় নারীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অসীম সাহসিকতা ও বহুমাত্রিক ভূমিকার কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে সেলিনা হোসেন বলেন, নারী-পুরুষের যৌথ শক্তিতেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সফলতা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নারীরা যে অসীম সাহস ও বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছাড়াও নারীরা সমাজের নেপথ্য-শক্তি হিসেবে সমাজ-কাঠামো ধরে রেখেছিল বলেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশ পুনর্গঠন সম্ভব হয়েছিল।
আগামীকাল বুধবার (২৪ মার্চ) মেলার দ্বার উন্মোচন হবে বিকেল ৩টায় আর বন্ধ হবে যথারীতি রাত ৯টায়। এসময় থেকে বইপ্রেমীরা সন্ধ্যা সাড়ে ৮টা পর্যন্ত মেলায় করেনাকালীন স্বাস্থ্য বিধি মেনে (মাস্ক পরে) প্রবেশ করতে পারবে। মাস্ক ছাড়া কেউ মেলায় প্রবেশ করতে পারবে না।
সান নিউজ/এইচএস/আরআই