হাসনাত শাহীন: কর্মব্যস্ত দিনের তুলনায় ছুটির দিনে বইমেলা জমে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। শনিবার (২০ মার্চ) ছুটির দিনেও মেলা জমে উঠেছিল লেখক-পাঠক ও বইপ্রেমীদের পাদচারণায়। সকাল ১১টায় মেলার প্রবেশদ্বার উন্মোচন হওয়ার পর অলস সময় কাটাতে থাকেন প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীরা। তবে বিকেলের পর সন্ধ্যার দিকে সেই চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।
শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী দর্শনার্থীদের পাদচারণায় সন্ধ্যার দিকে ঝলমলে হয়ে উঠে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণ। সপরিবারে ও দলবেঁধে এসে মেলাপ্রাঙ্গণে সৌন্দর্য্যর দ্যুতি ছড়ালেও বিক্রি ছিল হতাশাজনক। বলা যায় শনিবার মেলার তৃতীয় দিনে পাঠকের চেয়ে দর্শনার্থীদের আধিক্যই লক্ষনীয় ছিল। সেলফি তোলার মধ্যেই নিজেদের ব্যস্ত রেখেছিল এদিনের মেলায় আগতরা।
তবে আশার কথা শোনালেন অন্বেষার স্বত্তাধিকারি শাহাদাৎ হোসেন। তিনি বলেন, মেলায় দর্শনার্থীদের আগমন বৃদ্ধি পেলে ধীরে ধীরে বিক্রিও বাড়বে। মাত্রতো মেলা শুরু হলো, আগে মানুষ আসুক। বিক্রি একসময় বাড়বেই। এত তাড়াতাড়ি হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এদিকে দর্শনার্থীদের আগমনের আধিক্য করোনাকালীন মেলার পরিবেশকে ছন্দময় করে তুললেও ধূলোর ধূসরতা ছন্দপতন ঘটিয়েছে অমর একুশে বইমেলায়। বাতাসের সাথে উড়ন্ত ধূলোর উড়াউড়িতে বিরক্তি প্রকাশ করেছে মেলায় আগতরা।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে আগত সানজিদা রোজ বলেন, অন্যদিন খুব একটা সময় পাইনা বলে ছুটির দিনে মেলায় আসলাম। কিন্তু এসে মনে হয় ভুল করলাম। অতিরিক্ত ধূলার কারণে নতুন শাড়িটাই মনে হয় পুরনো হয়ে গেল। এত বড় আয়োজন করলো কিন্তু পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করলো না। দায়িত্বহীনতার একটা সীমা থাকা উচিৎ। ধূলোর বিরক্তি নিয়ে এই তরুনীর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে।
বইপ্রেমীদেরকে ধূলোর যন্ত্রনা থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিদিন মেলা প্রাঙ্গণে পানি ছিটানো হবে এমন প্রতিশ্রুতি মেলা শুরুর আগে দিলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনা বাংলা একাডেমি। যার কারণে প্রতি বছরই বাংলা একাডেমির দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মেলায় আগতরা। অন্যদিকে, মেলা শুরুর আগেই স্টল ও প্যাভিলিয়নের নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা অমর একুশে বইমেলার নীতিমালায় উল্লেখ থাকলেও খোদ বাংলা একাডেমিই নীতিমালার লঙ্ঘন করেছে।
মেলার তৃতীয়দিনেও বাংলা একাডেমি তাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণের একটি প্যাভিলিয়নের নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি। এছাড়া নামাজের ঘরের নির্মাণ শেষ করতে না পারার পাশাপাশি এখন পর্যন্ত অতি জরুরি প্রয়োজনীয় টয়লেট ব্যবস্থাও চালু করতে পারেনি একাডেমি কর্তৃপক্ষ। আর আশ্রয় ছাউনিগুলো এখনও ব্যবহারের উপযোগি হয়নি। বলা চলে, অমর একুশে বইমেলা ২০২১ এ বাংলা একাডেমির উদাসিনতার চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জুড়ে।
স্বাস্থ্যবিধি মানছে না পুলিশ
করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কড়া নির্দেশনা থাকলেও খোদ পুলিশ সদস্যরাই এসব নিয়মের কোন তোয়াক্কা করছেন না। শনিবার মেলার তৃতীয় দিনে মাস্কবিহীন অবস্থায় পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। আইনের রক্ষকরাই যখন আইন মানছেন না তখন সাধারণ মানুষ কিভাবে আইন মানবে সেই প্রশ্ন মেলায় আগত দর্শনার্থীদের পাশাপাশি অনেক প্রকাশকেরই। মাস্ক পরার বিষয়ে পুলিশের উদাসিনতা আইনের প্রতি চপেটাঘাত করা হয়েছে বরেও মনে করেন মেলায় আগত বেশ কয়েকজন। ক্ষোভ প্রকাশ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দর্শনার্থী বলেন, পুলিশ যেভাবে মাস্ক না পরেই মেলায় ঘুরছেন এবং আড্ডা দিচ্ছেন তাতে করে আইনের প্রতি পুলিশের বেপরোয়াভাবই ফুটে উঠেছে। পুলিশের উর্ধবতন কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে নজর দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তারা।
নতুন বই :
বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপ-বিভাগের তথ্যমতে, শনিবার (২০ মার্চ) মেলার তৃতীয় দিনে নতুন বই এসেছে ১০৪টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো-আগামী প্রকাশনী প্রকাশিত আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘হাসিনা ও রেহানা অ-রূপকথার দুই বোন’ মোনায়ের সরকারের ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকের ভূমিকা’, মোহাম্মদ আখতারুজ্জামানের ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু’, বিমল গুহের কাব্যগ্রন্থ ‘শেখ মুজিবের তর্জনী’, কথাপ্রকাশ এনেছে আহমদ রফিকের স্মৃতিকথা ‘স্মরণীয় বরণীয় আপন বৈশিষ্ট্যে’, হাসান আজিজুল হকের কাব্যগ্রন্থ ‘সুগন্ধি সমুদ্র পার হয়ে’, অন্যপ্রকাশ এনেছে শাইখ সিরাজের ‘করোনাকালে বহতা জীবন’, পাঠক সমাবেশ এনেছে ড. সুনীল কান্তি দে’র ‘বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত’ ইত্যাদি।
মেলার মূলমঞ্চের আয়োজন : শনিবার বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী : স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ শীর্ষক আলোচনা। অনুষ্ঠানে আবুল মোমেন লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলা একাডেমির সহ-পরিচালক সাহেদ মন্তাজ। আলোচনায় অংশ নেন আবুল কাশেম এবং ফওজুল আজিম।
সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক খুরশীদা বেগম।
আলোচকবৃন্দ বলেন, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এক ও অভিন্ন। বাংলা ও বাঙালির নেতা হিসেবে বস্তুত তিনিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার সংরক্ষণ করতেন এবং তার ঘোষণাতেই স্বাধীনতার সংগ্রাম আনুষ্ঠানিক রূপ পায়। এ সম্পর্কিত ইতিহাসকে রাষ্ট্রীয় প্রভাব খাটিয়ে বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
তারা আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু এদেশের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বাধীনতার রূপকল্প একাত্তরের বহু আগেই তৈরি করে রেখেছিলেন। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ তার ঐতিহাসিক বক্তৃতার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সূত্রগুলো এদেশের জনগণের কাছে উপস্থিত করে, তাদের আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি করে ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্মাণ-কল্পনা প্রকাশ করেন, যা যুগ যুগ ধরে স্বাধীনতা সংহত করার প্রেরণা দিয়ে যাবে।
সান নিউজ/এইচএস/এসএস