নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনায় যথাযথ স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মেলায় যাবেন। কিন্তু নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন।
তিনি বলেন, বিলম্বে হলেও আমাদের এই প্রাণের মেলা অবশেষে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এটা আনন্দের ও স্বস্তির খবর। যদিও দেশে করোনার টিকা মানুষ উৎসবের মতো গ্রহণ করছে তবু আমার অনুরোধ থাকবে মেলার শেষ দিন পর্যন্ত যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে আমরা যেন নিজেরা নিরাপদ থাকি এবং সবাইকে নিরাপদ রাখি।
বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি এই কথা বলেন।
অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব বদরুল আরেফিন, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমদ প্রমুখ।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা মহামারির প্রকোপে জনগণের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অমর একুশে বইমেলা নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ১ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে ১৮ মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে।
সাঁইত্রিশতম বইমেলার এ উদ্বোধনী আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান ও সাবেক সিনিয়ন সচিব সাজ্জাদুল হাসান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য রিয়াজুল কবীর কাওসার, সাহাবুদ্দিন ফরাজি, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহ, সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুসহ বইপ্রেমী মানুষেরা উপস্থিত ছিলেন।
করোনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, করোনাভাইরাস অনেক ক্ষতি করেছে। জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে গেছে। এটি কাটিয়ে উঠতে আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। প্রণোদনা ঘোষণা করেছি, প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকেও সহযোগিতা করেছি।
করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ শুরু হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, টিকা দিয়েই নিজেকে সুরক্ষিত মনে করবেন না। মাস্ক পরবেন, হাত ধোবেন ও শারীরিক দূরত্ব রক্ষার মাধ্যমে নিজেকে ও অন্যকে সুরক্ষিত রাখবেন। বইমেলায় যাবেন, বই স্পর্শ করবেন। কিন্তু নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন।
নতুন প্রজন্মকে বই পড়ার অভ্যাস বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছোটদের বইয়ের প্রতি ঝোঁক বাড়ানো দরকার। আমাদের সময় বাচ্চাদের বই পড়ে শোনানো হতো। এখনও আমরা তা করি। সব সময় ঘরে একটা ছোট লাইব্রেরি করে রাখি। বইয়ের প্রতি ঝোঁক বাড়াতে হবে। পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আমাদের বক্তৃতা বিবৃতিতে মানুষের কাছে যত দ্রুত পৌঁছা যায়, সাহিত্যে আরও আগে পৌঁছা যায়। কারণ সাহিত্য রস অত্যন্ত শক্তিশালী।
শেখ হাসিনা বলেন, এখন তো মোবাইল ডিভাইসেও পড়ার সুযোগ আছে। তবে বই হাতে নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টে পড়ার আনন্দই আলাদা। বইয়ের আবেদন মুছে যাবে না। প্রকাশকদের ধন্যবাদ, মহামারির সময়েও অনেক কষ্ট করেছেন।তিনি বলেন, ‘সরকারে থাকি আর বিরোধীদলে থাকি একদিনের জন্য হলেও বইমেলায় যাই। এখন করোনার কারণে যেতে পারছি না। কারণ আমি গেলে এক হাজার লোকের সম্পৃক্ততা হয়। তাদেরও সবার সংক্রমণের কথা চিন্তা করে আমি যাচ্ছি না। তবে আমার মনটা পড়ে আছে সেখানে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা তার যাত্রা শুরুর পর প্রায় চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এখন বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী বইয়ের মেলার স্বীকৃতি পেয়েছে। এই বইমেলা এখন আর শুধু বই কেনাবেচার কেন্দ্র নয়, একই সঙ্গে তা আমাদের প্রাণের মেলা।পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধন করেছিলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। পঞ্চাশ বছর পর আজ স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আমরা একুশে বইমেলা আয়োজন করছি এ আমাদের পরম পাওয়া।
বইমেলা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এবারের বইমেলার মূল উপজীব্য ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও আমাদের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’। মার্চ ২০২০ থেকে উদযাপিত হচ্ছে মুজিববর্ষ। আর এক সপ্তাহ পরে আমরা উদযাপন করব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ও লাখো শহিদের রক্তে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংগ্রাম, সমৃদ্ধি ও অর্জনের ৫০ বছর পূর্তি। আমি আনন্দিত এ কারণে যে, বাংলা একাডেমি একুশে বইমেলা ২০২১-এর মাসব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনার ব্যবস্থা করেছে।
কল্যাণ তহবিল থেকে সহায়তা করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর বলেন, করোনায় সমগ্র বাংলাদেশে ৭ হাজার ৫০০ শিল্পিকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছি। তাছাড়া অন্যান্য শ্রেণি-পেশার লোকদেরও সহযোগিতা করেছি। এই কাজটিতে আমার ছোট বোন শেখ রেহানা অত্যন্ত সহায়তা করে। কোথায় কোন মানুষ অসহায় অবস্থায় আছে তা খোঁজে বের করে তাদের সহায়তার জন্য রেহানা আমাকে বলে।
এ সময় ভাষা দিবস ও ভাষা আন্দোলনের নানা ইতিহাস তুলে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার ইতিহাস অনেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছে। অনেকে আবার বলেছে বঙ্গবন্ধু তো সেসময় জেলে ছিলেন। সেখানে থেকে তিনি আবার কীভাবে যুদ্ধ করেছেন। তারা এটা বলেনা বঙ্গবন্ধু কেনো জেলে গেলেন, কাদের জন্য জেলে গেলেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, সিক্রেট ডক্যুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইতে আমরা দেখতে পাই ৪ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটির পক্ষে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সংবলিত এক লিফলেটে স্বাক্ষর করছেন। ১১ই মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সচিবালয়ের সামনে ছাত্র বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় তাকেসহ আরও কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়।
পৃথিবীর কোনো রাজনীতিক বা রাষ্ট্রপ্রধানের গোয়েন্দা রিপোর্ট নিয়ে বই হয়েছে বলে আমার জানা নেই’ যোগ করেন তিনি। বইমেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়া চীন’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে বইটিসবাইকে পড়ে দেখার অনুরোধ জানান তিনি। আমরা বাংলা ভাষার সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাকে যেমন প্রণোদনা দিয়ে আসছি, তেমনি অনুবাদ সাহিত্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছি। ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি ১৩টি ভাষায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনূদিত হয়েছে। অবাংলা একাডেমি আমাদের ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুবাদ কার্যক্রম শুরু করেছে। এ কাজ ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারিত হবে বলে আশা করি, যার মাধ্যমে বিশ্ববাসী বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অসামান্য সব কীর্তির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের চলমান কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলা একাডেমি বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবের ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ ‘নিউ চায়না ১৯৫২’ প্রকাশ করেছে। এই অনুবাদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ রচনাকর্ম ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’- এর মত বিশ্বপাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে ‘বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার ২০২১’ দেয়া হয় ১০ সাহিত্যিককে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মতিক্রমে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে এই পুরস্কার তুলে দেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
এবার বাংলা একাডেমি প্রাপ্তরা হলেন, কবিতায় কবি মুহাম্মদ সামাদ, কথাসাহিত্যে ইমতিয়াজ শামীম, প্রবন্ধ সাহিত্যে বেগম আখতার কামাল, অনুবাদে সুরেশ রঞ্জন বসাক, নাটকে রবিউল আলম, শিশু সাহিত্যে আনজীর লিটন, মুক্তিযুদ্ধ সাহিদা বেগম, বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞান অপরেশ বন্দোপাধ্যায়, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ও ভ্রমণকাহিনী বিভাগে ফেরদৌসী মজুমদার এবং ফোকলোর বিভাগে হাবিবুল্লাহ পাঠান।
এর আগে ছায়ানটের শিল্পীদের সমবেত পরিবেশনায় জাতীয় সংগীত ও একশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। পরে সকল ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন স্বরূপ দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
সান নিউজ/আরআই