হাসনাত শাহীন: শরতের শিউলিঘেরা পথ অপেক্ষা করে প্রিয়জনের ঘরে ফেরার। তারপর উৎসবের ঋতু হেমন্ত পেরিয়ে আসে শীত। এই শীত ঋতুর শেষে বসন্তের কোল ঘেঁষে প্রকৃতিতে নেমে আসে পাতাঝরার মর্মর ধ্বনি। বছর ঘুরে মৃদুমন্দ বাতাসের সঙ্গে পাতাঝরার ছন্দময় সেই ধ্বনিতে এখন মুখরিত গাছ-গাছালি সন্নিবেশিত বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণ। দীর্ঘ এক বছরের অপেক্ষা শেষে যে মুখরতার মাঝে ধ্বনিত হচ্ছে আপমর মানুষের প্রাণের মেলা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ শুরুর অপেক্ষা।
কারোনা ভাইরাসে সৃষ্ট বৈশ্বিক মাহামারির কারণে মাতৃভাষা রক্ষায় বাঙালির আত্মদানের মাস ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে এবারের বইমেলা হচ্ছে বাঙালির মুক্তিচেতানার জাগ্রত মাস- মার্চ মাসে। আর মাত্র একদিন পরেই অর্থ্যাৎ ১৮ মার্চ শুরু হয়ে এবারের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১’ চলবে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত। এর মধ্যে এবারের বইমেলা ১৯শে মার্চ থেকে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বিকেল ৩ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ছুটির দিন বেলা ১১ টা থেকে রাত ৯ টা।
বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) বিকেল ৩টায় গণভবন থেকে বইমেলার ইতিহাসে এবারই প্রথমবারের মতো ভার্চুয়ালি বইমেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন সংস্কৃতি সচিব মো. বদরুল আরেফীন। স্বাগত বক্তব্য দেবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।
বাঙালির মন ও মননের প্রতীক বাংলা একাডেমি আয়োজিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রকালে অনুষ্ঠেয় এবারের বইমেলা উৎসর্গ করা হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। এবারের বইমেলার মূল থিম ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’।
দেশের হাজারও মেলার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ববহ এই প্রাণের মেলায় প্রাণের ছোঁয়া লাগাতে চলছে- স্টল, প্যাভিলিয়ন, মঞ্চ তৈরির শেষ মুহুর্তের কাজের তুমুল ব্যস্ততা। গত ৮ মার্চ মেলার স্টলের স্থান বরাদ্দের লটারি অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বৃহস্পতিবার স্ব স্ব স্থান বুঝে পান প্রকাশকরা। সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে প্রস্তুতি।
মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) চৈত্রের হালকা বাতাসের সঙ্গে ঝলমলে রোদের উত্তাপ মেশানো দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখা গেল, সেখানে এখন ভীষণ ব্যস্ততা। বরাবরের মতো এবারও এ প্রাঙ্গণে শুধুমাত্র সৃজনশীল প্রকাশকদের প্যাভিলিয়ন ও স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যার সঙ্গে আছে সাহিত্যের কাগজ ‘লিটল ম্যাগাজিন’ এর স্টল। সেখানের স্টলে-স্টলে কিংবা প্যাভিলিয়নে-প্যাভিলিয়নে একদিকে-কেউ অবকাঠামো নির্মাণের শেষ অংশের কাজে ব্যস্ত, তো অন্যদিকে-কেউ রং করছেন, কেউ বই রাখার জায়গাগুলো ঠিক করছেন, কেউ স্টল কিংবা প্যাভিলিয়নের চারপাশ পরিচ্ছন্নতায় ব্যস্ত। আর মাত্র একদিন পর যাতে যোগ হবে নতুন বইয়ের মৌতাত করার গন্ধ। সেই লক্ষ্যেই জোর কদমে চলছে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার প্যাভিলিয়ন আর বিভিন্ন ইউনিটের স্টল নির্মানের তুমুল ব্যস্ততা। এ ব্যস্ততায় প্রমাণ করে প্রাণেরমেলা ‘বইমেলা’ এখন শুরুর অপেক্ষায়।
মেলার বিভিন্ন স্টল-প্যাভিলিয়ন নির্মাণের কাজ ঘুরে দেখতে দেখতে মেলার মূলপ্রাঙ্গণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখা হলো দেশের অন্যতমসেরা প্রচ্ছদশিল্পী চারু পিন্টুর সঙ্গে। তার সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি সান নিউজকে বলেন, এবারের মেলার নকশা থেকে শুরু করে, স্টল বিন্যাস, প্যাভিলিয়ন বিন্যাসসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো। যেকোন বারের মেলার চেয়ে এবারের মেলার পরিসরও অনেক বেশি। যেহেতু, করোনাকালীন এই সময়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা জরুরি সেই হিসেবে এই পরিসরটা খুব প্রয়োজনীয়। এক সারি স্টল থেকে অন্য সারির স্টলের মাঝের রাখা খোলা জায়গার দূরত্বও বেশ ভালো, যার ফলে মেলায় অন্যবারের চেয়ে এবার মেলায় আগতরা বেশ সচ্ছন্দে ঘুরে-ফিরে কাঙ্খিত বই দেখতে ও কিনতে পারবে।
এবারের মেলায় প্রায় ৫০টি প্রকাশনা সংস্থার ৭ শতাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ করা শিল্পী চারু পিন্টুর সাথে কথা বলা শেষ করেই দু’কদম হাঁটতেই দেখা হলো প্রকাশনা সংস্থা আগামী’র সত্বাধিকারী ওসমান গণির সঙ্গে। তিনি সান নিউজ’কে বললেন, এবারের মেলা বেশ গোছালো। পরিসরের দিক থেকেও অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু মেলার বড় বড় প্রকাশনাগুলোর প্যাভিলিয়নগুলো একই এলাকায় হওয়াতে মেলা খুব ভালো হবে বলে আমার মনে হয় না। কেননা, আমরা এখনও এত বড় জায়গার জন্য প্রস্তুত হয়নি। তবে, যায় হোক না কেন; আজকের মধ্যেই আমার প্রকাশনা সংস্থার প্যাভিলিয়ন নির্মানের কাজ শেষ হবে। আগামীকাল বেশকিছু নতুন বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্যবারের বই নিয়ে স্টল সাজিয়ে ফেলবো।
প্যাভিলিয়ন আর স্টল নির্মানের এমন ব্যস্ততার মাঝে কথা হলো অন্বেষা প্রকাশনের সত্বাধিকারী শাহাদাত হোসেনের সাথে। তিনি সান নিউজ’কে বললেন, প্রস্তুতির এ সময়টা বড় মধুর। কিন্তু আর কয়েকদিন আগে স্থানটা বুঝে না পাওয়ার আক্ষেপ ছিলো। আরও বেশ কিছুদিন আগে মেলার স্থান বুঝে পেলে আরও নান্দনিক করে সাজানো যেতো প্যাভিলিয়নটি।
এরই মাঝে দেখা হয় চারুলিপি প্রকাশনের সত্বাধিকারী হুমায়ূন কবীরের সঙ্গে। তিনি বললেন, এবারের মেলা ভালো হবে। বেশ খোলামেলাভাবে বিন্যাস করা হয়েছে। ফলে পাঠকেরা স্বাচ্ছন্দ্যে মেলায় ঘুরে ফিরে বই কিনতে পারবেন।
শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতির কাজ চলছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেও। যেখানে বরাবরের মতো এবারও আছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের স্টল।
২০১৪ সালের ধারাবাহিকতায় এবারও ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত বাংলা একাডেমি ও তার সম্মুখের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত স্থান ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রাণের মেলা। প্রায় ১৫ লাখ বর্গফুট জায়গায় জুড়ে অনুষ্ঠিতব্য এবারের এ মেলায় একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৭টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫৪টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৮০টি ইউনিট; মোট ৫৪০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৩৪টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে গতবছরের মতো এবারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল মেলা প্রাঙ্গণে থাকছে লিটল ম্যাগাজিন চত্বর। সেখানে ১৩৫টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দের পাশাপাশি ৫টি উন্মুক্ত স্টলসহ ১৪০টি স্টল দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বাংলা একাডেমিসহ ৩২টি প্রকাশনা সংস্থাকে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, একক ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বই প্রকাশ করেছেন তাদের বই ও বিক্রি/প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। বইমেলায় বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫% কমিশনে বই বিক্রি করবে।
সান নিউজ/এইচএস/আরআই