হাসনাত শাহীন: একদিন পর (১৮ মার্চ) থেকে শুরু হচ্ছে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১’। তারই প্রাক্কালে মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) সকাল সাড়ে ১১টায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে- সম্প্রতি দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার উদ্বেগ প্রকাশ করে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেছেন- ‘মেলা চলাকালে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ অবনতি হলে আমরা কঠিন সিদ্ধান্তে যাবো। কারণ আগে তো জীবন।’
মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২১’ নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরতে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, ‘দেশে সম্প্রতি করোনায় আক্রান্তের হার বেড়ে গেছে। আগে দৈনিক ১০০ থেকে ২০০ জন করোনা আক্রান্ত হতো, এখন সেটা দুই হাজারের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে অমর একুশে বই মেলা শুরু হচ্ছে। এই অবস্থায় করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। মেলা চলাকালে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ অবনতি হলে আমরা কঠিন সিদ্ধান্ত যাবো। কারণ আগে তো জীবন।’
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী আরোও বলেন, ‘আগামী এবার ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো সীমিত আকারে আয়োজন হচ্ছে। রমনার বটমূলের অনুষ্ঠানে সীমিত পরিসরে হবে। ফলে, সেইদিন বইমেলায় জনসমাগম বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এইদিনটিতে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে আমাদের বিশেষ পরিকল্পনাও হাতে নিতে হবে। এটা নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা সকলে সচেতন হলেই একটা সুন্দর বইমেলা করা সম্ভব।’
বইমেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় এ সংবাদ সম্মেলন। এতে আরোও বক্তব্য দেন এবং বইমেলা বিষয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী, অমর একুশে বইমেলা ২০২১-এর সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ, একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক অপরেশ কুমার ব্যানার্জী, বিকাশ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার তৌহিদুর রহমান, ক্রসওয়াক কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মারুফ, বইমেলার নকশাকারক স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারের বইমেলায় বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে। মাস্ক ছাড়া কোনভাবেই বইমেলায় প্রবেশ করা যাবে না। প্রতিটি প্রবেশ পথে এ বিষয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। মাস্ক থাকলে তবেই একজন মেলায় ১ম স্তরে ঢোকার অনুমতি পাবেন। এরপর তার শরীরের তাপমাত্রা মাপা হবে এবং তা ঠিক থাকলে স্যানিটাইজ করা হবে। সবশেষে নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করে মূল মেলায় ঢুকতে পারবেন লেখক-পাঠক-দর্শনার্থীরা। এছাড়া মেলার ভেতর ঢুকে পড়ার পর কেউ যেন মাস্ক না খুলে ফেলে, সে বিষয়টিও নজরদারিতে রাখবে প্রশাসন ও একাডেমি কর্তৃপক্ষ।
বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে। এবার অন্যান্য যেকোন বারের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা নিয়ে অর্থ্যাৎ প্রায় ১৫ লাখ বর্গফুট জায়গায় নিয়ে এ মেলা অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৭টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫৪টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৮০টি ইউনিট; মোট ৫৪০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৩৪টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মেলায় ৩৩টি প্যাভিলিয়ন থাকবে।
লিটল ম্যাগাজিন চত্বর স্থানান্তরিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল মেলা প্রাঙ্গণে। সেখানে ১৩৫টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দের পাশাপাশি ৫টি উন্মুক্ত স্টলসহ ১৪০টি স্টল দেওয়া হয়েছে। একক ক্ষুদ্র প্রকাশনা সংস্থা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে যারা বই প্রকাশ করেছেন তাদের বই ও বিক্রি/প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্টলে। বইমেলায় বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। বাংলা একাডেমির ৩টি প্যাভিলিয়ন, শিশু-কিশোর উপযোগী বইয়ের জন্য ১টি এবং সাহিত্য মাসিক উত্তরাধিকার-এর ১টি স্টল থাকবে। এবারও শিশুচত্বর মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে থাকবে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রথমদিকে ‘শিশুপ্রহর’ থাকবে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মেলায় প্রবেশের জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব প্রান্তে এবার নতুন একটি প্রবেশ পথ করা হয়েছে। রমনা প্রান্তে একটি প্রবেশ পথ ও পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবমিলে সোহরাওয়ার্দীতে ৩টি প্রবেশ পথ ও ৩টি বাহির পথ থাকবে। প্রত্যেক প্রবেশ পথে সুরক্ষিত ছাউনি থাকবে, যাতে বৃষ্টি ও ঝড়ের মধ্যে মানুষ আশ্রয় নিতে পারেন। এছাড়া মাস্ক ছাড়া মেলায় প্রবেশ করা যাবে না। শরীরের তাপমাত্রা মেপে স্যানিটাইজ হয়ে তবেই ঢুকতে হবে মেলায়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবার নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে।
এবারের মেলায় ঝড়ের আশঙ্কা থাকায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। বৃষ্টি ও ঝড়ের আশঙ্কা বিবেচনায় রেখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চারটি জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এবার বৃষ্টির পানি মেলা প্রাঙ্গণ থেকে দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকবে। লেখক বলছি মঞ্চ ও গ্রন্থ উন্মোচনের স্থান বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। নামাজের ঘর, টয়লেট ব্যবস্থা সম্প্রসারিত ও উন্নত করা হয়েছে। নারীদের জন্য সম্প্রসারিত নামাজ ঘর থাকবে। পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কাছে একটি ব্রেস্টফিডিং কর্নার থাকবে। প্রতি বছরের মতো এবারও হুইল-চেয়ার সেবা থাকবে। তবে গতবারের চেয়ে বেশি সংখ্যায় স্বেচ্ছাসেবী এ-কাজে নিয়োজিত থাকবেন। আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে থাকবে দুটি ফুডকোর্ট।
এবার বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে বইমেলা ১৮ই মার্চ শুরু হয়ে চলবে ১৪ই এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা ২০২১ উৎসর্গিত হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। এবারের বইমেলার মূল থিম ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’। ১৮ই মার্চ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি বইমেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করবেন সংস্কৃতি সচিব মো. বদরুল আরেফীন। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।
এবার অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ বঙ্গবন্ধু রচিত ও বাংলা একাডেমি প্রকাশিত 'আমার দেখা নয়াচীন'-এর ইংরেজি অনুবাদের আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা। শেখ হাসিনা এই গ্রন্থ উন্মোচন করবেন। এছাড়া এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই প্রদান করা হবে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২০।
মাসব্যাপী এবারের বইমেলা ১৯ মার্চ থেকে ১৪ই এপ্রিল পর্যন্ত ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা। প্রতিদিন বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়কেন্দ্রিক আলোচনার পাশাপাশি বরেণ্য বাঙালি মনীষার জন্মশতবর্ষ উদযাপন এবং গত এক বছরে প্রয়াত বিশিষ্টজনদের জীবন ও কৃতি নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া মাসব্যাপী প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এই অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রতিদিনই রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ এবং আবৃত্তি।
এছাড়াও প্রতিবারের মতো এবারের অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০২০ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’ এবং ২০২০ বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা বই প্রকাশের জন্য ৩টি প্রতিষ্ঠানকে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে। এছাড়া ২০২০ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগত মান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য ১টি প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ এবং এ-বছরের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হবে।
সান নিউজ/এইচএস/এসএস