হাসনাত শাহীন: দেশের বিভিন্ন ঋতুতে পিঠা খাওয়ার রেওয়াজ থাকলেও হেমন্ত ও শীত আসলেই গ্রাম-বাংলায় শুরু হয় পিঠা খাওয়ার ধুম। হেমন্তের অগ্রহায়ণ মাসে নতুন ধানের নতুন চালের তৈরি বাহারি পিঠার সেই মৌ-মৌ গন্ধে ছেয়ে যায় গ্রামীণ আবহ। হিমেল পরশের সঙ্গে পিঠা-পুলির মোহনীয় স্বাদ অনন্য করে তোলে শীতের সকালকে। শুধু খাবার হিসেবেই নয়, বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির লোকজ ঐতিহ্য এবং নারীসমাজের শিল্প নৈপুণ্যের স্মারক রূপেও বিবেচিত পিঠা-পুলির সঙ্গে নাগরিকসভ্যার এই যুগে নাগরিক প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে গত ১৩ বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও রাজধানী ঢাকাতে শুরু হয়েছে জাতীয় পিঠা উৎসব।
রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমি ও জাতীয় পিঠা উৎসব উদযাপন পরিষদের যৌথ আয়োজনে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে ১০ দিনের এই উৎসব। রোববার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ছিল চলমান এই উৎসবের ষষ্ঠদিন। এদিন বিকেল থেকে উৎসব প্রাঙ্গণ মুখরিত ছিল পিঠাপ্রেমীদের ভিড়ে। বিকেলের সেই মুখরতা সন্ধ্যায় উৎসবমুখর পরিবেশের রূপ নেয়। পিঠা কেনা, খাওয়া ও স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে মোবাইলের ক্যামেরায় বন্দি করে রাখতে ব্যস্ত ছিল উৎসবে আগত দর্শনার্থীরা। মাঠজুড়ে সাজানো স্টলে স্টলে পিঠা বিকিকিনি ও খাওয়ার পাশাপাশি কফি হাউজের মুক্তমঞ্চে চলছে নাচ, গান, নাটক, আবৃত্তিসহ নানা ধরণের সাংস্কৃতিক আয়োজন। এ আয়োজনের নাচের মুদ্রায় আর গানের সুরে কিংবা কবিতার ছন্দে শিল্পের সুষমা ছড়িয়েছিল উৎসব প্রাঙ্গণজুড়ে।
এমন দিনের পিঠা উৎসবে কথা হয় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে আগত আমিনা অবন্তীর সাথে। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, পিঠা-পায়েস, পুলি কিংবা নাড়ুর কথা উঠলেই হেমন্ত ও শীত ঋতুই আমাদের চোখে ও মনে ভেসে ওঠে। এবার করোনার কারণে হেমন্ত ও শীতের উৎসব শুরু হয়েছে বসন্তে। রাজধানীতে এমন একটি উৎসব নিঃসন্দেহে অনেক বেশি দরকার। যান্ত্রিক ও ব্যস্ত এই মহানগরীতে আমরা যখন নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে হাঁফিয়ে উঠেছি,তখন এই ধরণের একটি উৎসব কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দেয়। রাজধানীর এই নগরীতে গ্রামীণ পিঠা-পুলির স্বাদ নিতে পারছি। এটাই বা কম কিসে। উৎসব প্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থাকাতে আয়োজনটি অনেক প্রাণবন্ত লাগছে।
জাতীয় পিঠা উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার শাহ আলম জানান, প্রায় ৫০টি স্টল দিয়ে বিন্যাস্ত করা হয়েছে এবারের উৎসব প্রাঙ্গণ। আর এই স্টলগুলোতে শোভা পাচ্ছে দেশের ৪০টির মতো জেলার প্রায় ২০০ রকমের পিঠা। স্বাদ, নকশা, রং ও বৈচিত্র্যময়তায় একটি পিঠা থেকে আরেকটি পিঠা একেবারেই ভিন্নধারার। তিনি আরও বলেন, পিঠার এই উৎসবটা যেন শুধু কেনা ও খাওয়ার উৎসব না হয়, সে জন্য উৎসব প্রাঙ্গণের মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
উৎসবে এলেই দেখা মিলবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ২ শতাধিক রকমের পিঠা-পুলি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পিঠার হলো- ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, ঝাল পিঠা, মালপোয়া, মেড়া পিঠা, মালাই পিঠা, মুঠি পিঠা, আন্দশা, কুলশি, কাটা পিঠা, কলা পিঠা, খেজুরের পিঠা, ক্ষীর কুলি, গোকুল পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল পিঠা, সুন্দরী পাকান, সরভাজা, পুলি পিঠা, পাতা পিঠা, পাটিসাপটা, পাকান পিঠা, নারকেলের সেদ্ধ পুলি, নারকেল জিলাপি, তেজপাতা পিঠা, তেলের পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, চাঁদ পাকান পিঠা, ছিট পিঠা, পানতোয়া, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, ঝুরি পিঠা, ছাঁচ পিঠা, ছিটকা পিঠা, চিতই পিঠা, দুধ চিতই, বিবিখানা, চুটকি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, ঝিনুক পিঠা, সূর্যমুখী পিঠা, ফুল পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, সেমাই পিঠা, নকশি পিঠা, নারকেল পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি, দুধরাজ, ফুলঝুরি পিঠা ইত্যাদি।
আগামী ৪ মার্চ শেষ হবে দশদিনের এই পিঠা উৎসব। ঐদিন অনুষ্ঠিত হবে সমাপনী আয়োজন। এ আয়োজনে এবারের পিঠা উৎসবে অংশ নেওয়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পিঠাশিল্পীদের মধ্যে থেকে পাঁচজন সেরা পিঠাশিল্পীকে পুরস্কৃত করবে আয়োজকরা।
সান নিউজ//এইচএস/এসএস