হাসনাত শাহীন: গ্রামবাংলায় পিঠা খাওয়ার আনন্দ শহুরে মানুষের কাছে সোনালি অতীত। সেই অতীতকে ফিরিয়ে আনতেই প্রতিবছরের মত এবারও রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চলছে ‘জাতীয় পিঠা উৎসব ১৪২৭’। যে আয়োজনকে ঘিরে শিল্পকলা প্রাঙ্গণ এখন পিঠাপুলির ঘ্রাণে মুখরিত। যার মধ্য দিয়ে নাগরিক জীবনে নেমে এসেছে গ্রামীণ আবহ।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও জাতীয় পিঠা উৎসব পরিষদ যৌথ আয়োজনে মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু হয়েছে দশ দিনব্যাপী এ পিঠা উৎসব। দেশের বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং লোকায়ত শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলার লক্ষে বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারে চতুর্দশবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই পিঠা উৎসব।
এ উপলক্ষে সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির কফি হাউজের সামনে উন্মুক্ত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় উদ্বোধনী আয়োজন। এ আয়োজনে অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে রঙিন বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে এবারের এ পিঠা উৎসবের উদ্বোধন করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। এসময় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন মঞ্চসারথি আতাউর রহমান, নৃত্যগুরু আমানুল হক। পিঠা উৎসব উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আয়োজনে বক্তব্য দেন পরিষদের সভাপতি ম.হামিদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন শিল্পকলা একাডেমির সচিব নওসাদ হোসেন এবং স্বাগত বক্তব্য দেন পিঠা উৎসব উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার শাহ্ আলম।
উৎসবের উদ্বোধন করে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণসহ নানা কারণে এখন আর গ্রামে-গঞ্জে সেভাবে পিঠা উৎসব হয় না। সেই উৎসবটি এখন শহরের চারদেয়ালের মধ্যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটা ভালো দিক। অন্তত এই উৎসবের কারণে আমরা আমাদের গ্রামের সেই পিঠাপুলির ঘ্রাণ নিতে পারছি, স্বাদ নিতে পারছি।
তিনি আরও বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে সারাবিশ্বের মতো আমাদের দেশেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন আমরা প্রায় করোনাকে জয় করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে জন্য আমাদের দেশ বিশ্বের সর্বনিম্ন করোনা আক্রান্ত দেশে, সর্বনিম্ন মৃত্যুহারের দেশ। আজ যেখানে বিশ্বের ১৩১ টিরও বেশি দেশ করোনার টিকা পাইনি, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কারণেই আমরা করোনার টিকা গ্রহণ করতে পারছি। আমি টিকা নিয়েছি, এর কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া পাইনি। আপনারও টিকা নিন, দেশকে করোনা মুক্ত করুন।
আতাউর রহমান বলেন, কথায় বলে ‘জীবন চর্চা নয়, জীবন চর্যা’। আমাদের এই জীবন চর্যার একটা বিরাট উৎসব হলো পিঠা উৎসব। এটা আমাদের জাতির একটা পরিচয়ও বটে। পৃথিবীর অনেক দেশে পিঠা-পায়েশ আছে। উৎসবও হয়। কিন্তু কোথাও আমাদের দেশের মতো এত বাহারি পিঠা-পুলি কিংবা পায়েশ নেই। এই মহামারীর দিনেও এই পিঠা উৎসব হচ্ছে এটা আমার কাছে খুব আনন্দের।
নৃত্যগুরু আমানুল হক বলেন, পিঠা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির একটা অংশ। আমাদের এই ঐতিহ্যকে যদি তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে না পারি তাহলে আমরা পিছিয়ে যাবো। সুতরাং এধরণের আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমাদের আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যকে তুলে ধরাটা খুব জরুরী।
লিয়াকত আলী লাকী বলেন, একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে এই পিঠা উৎসব করতে পারছি এ জন্য আমরা আনন্দিত। করোনা সংক্রমণ প্রতিকারের যে নির্দেশনা আছে, আমরা সকলে সেই নির্দেশনা মেনে এই পিঠা উৎসবে আসবো। এবং আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অনন্য উপাদান পিঠার স্বাদ গ্রহণ করবো। সকলের সহযোগিতা পেলে আমাদের এবারের এ ১০ দিনের পিঠা উৎসবও সফলভাবে সম্পন্ন হবে।
এবারের উৎসবে উৎসবে প্রায় ৫০টি স্টলে প্রায় দুইশত পদের পিঠা নিয়ে হাজির হয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলার পিঠাশিল্পীরা। যার মধ্যে ছিল ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, ঝাল পিঠা, মালপোয়া, মেড়া পিঠা, মালাই পিঠা, মুঠি পিঠা, আন্দশা, কুলশি, কাটা পিঠা, কলা পিঠা, খেজুরের পিঠা, ক্ষীর কুলি, গোকুল পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল পিঠা, সুন্দরী পাকান, সরভাজা, পুলি পিঠা, পাতা পিঠা, পাটিসাপটা, পাকান পিঠা, নারকেলের সেদ্ধ পুলি, নারকেল জিলাপি, তেজপাতা পিঠা, তেলের পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, চাঁদ পাকান পিঠা, ছিট পিঠা, পানতোয়া, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, ঝুরি পিঠা, ছাঁচ পিঠা, ছিটকা পিঠা, চিতই পিঠা, দুধ চিতই, বিবিখানা, চুটকি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, ঝিনুক পিঠা, সূর্যমুখী পিঠা, ফুল পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা, সেমাই পিঠা, নকশি পিঠা, নারকেল পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি, দুধরাজ, ফুলঝুরি পিঠাসহ আরও বাহারি সব নামের পিঠা। আগামী ৩ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৩ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত নানান রকমের বৈচিত্রময় স্বাদের এসব পিঠা ভোজন রসিকদের রসনায় জোগাবে ব্যতিক্রমী আনন্দ।
এদিকে, দশ দিনব্যাপী এ পিঠা উৎসবে নানা রকমের বাহারি পিঠার সঙ্গে উৎসব আঙিনায় প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে অনুষ্ঠিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তারই অংশ হিসেবে উদ্বোধনী আয়োজন শেষে উৎসব মঞ্চে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন সংগঠনের শিল্পীরা এ সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবারের এ পিঠা উৎসবে সহযোগিতা করছে স্কয়ার ফুড এন্ড বেভারেজ কোম্পানি লিমিটেড।
প্রসঙ্গত, বাঙালি জাতি হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বাঙালি জাতি। সেই চিন্তা-চেতনা থেকে আমাদের বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে নিজেদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং লোকায়ত শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলার লক্ষেই ২০০৮ সাল থেকে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
সান নিউজ/এইচএস/এসএস