হাসনাত শাহীন : আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন আহমেদ এর “শান্তি” শিরোনামে ঢাকায় একটি একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার গ্যালারিতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও ভারতের গ্যাঞ্জেস্ আর্ট গ্যালারির যৌথ আয়োজনে শুরু হয় এই প্রদর্শনী।
ঐদিন শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী আয়োজনে এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবং উদ্বোধনী পর্বের পর প্রধানমন্ত্রী প্রদর্শনীস্থল জাতীয় চিত্রশালার ২নং গ্যালারি পরিদর্শনে আসেন এবং গ্যালারির সম্মুখস্থলে স্থাপিত ক্যানভাসে শেখ হাসিনা ও শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ যৌথভাবে একটি চিত্র অঙ্কন করেন। এবং মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সেই চিত্রকর্মটিতে প্রধানমন্ত্রী নিজে সাক্ষর করেন।
শেখ হাসিনা ও শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের যৌথভাবে আঁকা সেই চিত্রকর্মটি সরানো নিয়ে এখন বেশ চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমি বলছে- চিত্রকর্মটি সরিয়েছে চারুকলা বিভাগের সাবেক পরিচালক আশরাফুল আলম পপলু। ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান এই চিত্রকর্মটি ফেরত চেয়ে ইতিমধ্যে দুই দফা চিঠি দিয়েও ছবিটি ফেরত পাইনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
এ বিষয়ে সাননিউজের সঙ্গে কথা বলেন চিত্রকর্মটি ফেরত নিয়ে আসা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং ফ্রান্স প্রবাসী শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী সেলের সহকারী সংগঠক শিল্পী এ.বি.এম তৈমুর হান্নান।
তরুণশিল্পী তৈমুর হান্নান সাননিউজকে বলেন, বর্তমানে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক আশরাফুল আলম পপলু। তিনি এর আগে চারুকলা বিভাগের পরিচালক(সাবেক) ছিলেন। তার চারুকলা বিভাগের পরিচালক হিসেবে দুই বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরপরই খবর হয় যে, তিনি ছবিটা বাসায় নিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি শিল্পকলা একাডেমির কোন মাধ্যমকেই বলেন নি যে তিনি (পপলু) ছবিটা নিয়ে গেছেন।
প্রথম বিষয় হলো- আমার সৌভাগ্য যে, ব্যক্তিগতভাবে শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় ও যোগাযোগ আছে। স্যার দেশে থাকলে আমি প্রায়ই স্যারের বাসায় যাই। স্যার একদিন হঠাৎ করে আমাকে জিজ্ঞেসা করেন- আমার ‘শান্তি’ প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমি যে ছবিটা এঁকেছিলাম; সেই ছবিটা কোথায় আছে? ছবিটা আমার বাসায় দিয়ে যেও, ছবিটাতে আরো একটু কাজ করতে হবে। কারণ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছবিটা আঁকা শেষে উনাকে(শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ) বলে দিয়েছিলেন যে, তুমি ছবিটাতে আরেকটু কাজ করে দিও। এরকম একটা বিষয়। এ কথাগুলো স্যারই আমাকে বলে ছিলেন।
যাই হোক, পরে আমি শিল্পকলা একাডেমিতে এসে ছবিটার খোঁজ করি; চারুকলা বিভাগের সহকর্মীদের কাছে। তখন কেউই ছবিটার খোঁজ দিতে পারছিলেন না। একটা পর্যায়ে বিভাগের কারো কারোও মাধ্যমে শোনা যায় ছবিটা পরিচালক সাহেব নিয়ে যেতে পারেন। কেননা, এটা ওনার রুমে ছিল।
এরকম অবস্থায়, উনার (সে সময়েল চারুকলা বিভাগের পরিচালক) সঙ্গে যোগাযোগ করার প্রয়োজন দেখা দেয়। আমি বয়সে উনার(আশরাফুল আলম পপলু) ছোট, তাই আমাদের সিনিয়র ও শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর রেজাউল হাশেম রাশেদ ভাই উনাকে (পপলু) ফোন করেন। রাশেদ ভাই ফোন করলে উনি (পপলু) বলেন- ছবিটা তার কাছে আছে। তখন ছবিটা শিল্পকলা একাডেমিকে দেওয়ার জন্য তার সঙ্গে অনেকভাবেই কথা হয়। শেষ পর্যন্ত রাশেদ ভাইকে উনি জানান যে, ছবিটা তিনি দিবেন না।
তারপরেই শিল্পকলা একাডেমি থেকে অফিসিয়াল ভাবে তাকে (পপলু) ছবিটা ফেরৎ দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়। সেটা সম্ভবত ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। আর, চারুকলা বিভাগের পরিচালক হিসেবে তার (পপলু) মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি। তো-ফেব্রুয়ারির দিকে যখন তাকে চিঠি দেওয়া হয়; আমি যতটুকু জানি- সেই চিঠির তাৎক্ষণিক কোন উত্তর আসেনি। তার পরবর্তী সময়ে একই সালের (২০২০ সাল) ২৪ জুন আরেকটা চিঠি দেওয়া হয়।
এখানে- আরেকটা বিষয় বলে রাখা দরকার যে, শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ স্যারের ‘শান্তি’ প্রদর্শনীতে যেসব আর্ট ওয়ার্কগুলো নিয়ে ভারতের গ্যাঞ্জেস্ আর্ট গ্যালারি প্রদর্শনী করে; প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন ভারতের তখনকার রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী। সেই প্রদর্শনীর আর্ট ওয়ার্কগুলো আমি নিজে বাংলাদেশ থেকে একটা কাভার্ডভ্যানে করে ভারতে নিয়ে যাই। আমার সঙ্গে ছিলেন মুহাম্মদ আরিফুজ্জামান নূরনবী। তখন শিল্পী শাহাবুদ্দিন স্যারের ছবিগুলো নিয়ে ভারতের কলকাতা, জাহাঙ্গীর গ্যালারি ও রাষ্ট্রপতি ভবন-এই তিন জায়গায় পৃথক পৃথক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
সেসময়ে শাহাবুদ্দিন স্যার ‘শান্তি’ শিরোনামের এই প্রদর্শনীটির ৪র্থ ও শেষ প্রদর্শনী বাংলাদেশে করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যেহেতু ভারতের গ্যাঞ্জেস্ আর্ট গ্যালারি স্যারের প্রদর্শনীগুলোর আয়োজন করেছে, সেহেতু তারা বাংলাদেশে প্রদর্শনী আয়োজনের জন্য যোগাযোগ করে। এবং প্রদর্শনীটি শিল্পী শাহাবুদ্দিন স্যারের নিজের ছবির প্রদর্শনী। পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি বাংলাদেশে স্যারের ‘শান্তি’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই উদ্বোধন করতে সম্মত হয়েছেন। এবং পিএম দপ্তর থেকে প্রথমে চিঠি আসে (আমি যতটুকু শুনেছি...)। ওখান থেকে নির্দেশ আসে যে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং ভারতের গ্যাঞ্জেস্ আর্ট গ্যালারির যৌথ আয়োজনে শিল্পকলায় প্রদর্শনীটি করার জন্য। এভাবেই কিন্তু প্রদর্শনীটি হয়। পরে, প্রদর্শনীর উদ্বোধনের তারিখও ঠিক হয়; যা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ।
শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার ২ নং গ্যালারির সামনের স্পেসে উদ্বোধনী দিনে ছবিটি আঁকা হয়েছিল। ঐ ছবিটাতে আরেকটু কাজ করার কথা ছিল শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ স্যারের। সেসময় স্যার আমাকে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, ছবিটার কাজ শেষ করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে দান করবেন।
একজন শিল্পী যখন একটা ছবি আঁকেন বা যৌথভাবে যখন ছবি আঁকে তখন সেটা একটা সাধারণ আর্ট ওয়ার্কের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। আবার যখন ছবিটা আঁকছেন-একজন রাষ্ট্রনায়ক ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, তখন সেই ছবিটার আমাদের কাছে অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যা কোনভাবেই অর্থমূল্যে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। যাই হোক, পরবর্তীতে স্যার যখন শোনেন যে, ছবিটা উনি (পপলু) নিয়ে গেছেন এবং দিচ্ছেন না; তখন স্যার মনোক্ষুণ্ন হন। এবং স্পষ্টভাবে বলেন যে, ছবিটা ফেরত আনার জন্য শিল্পকলা একাডেমিকেই দায়িত্ব দিচ্ছি। সেই সঙ্গে এটাও জানান-ছবিটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে থাকবে।
এর জন্য কি শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কি পপলুর কোন কথা হয়েছে বা তিনি (শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ) কি আশরাফুল আলম পপলুর সঙ্গে কথা বলেছিলেন? এরকম কি কিছু জানা আছে আপনার?
সাননিউজের এমন প্রশ্নের জবাবে তরুণ শিল্পী তৈমুর হান্নান বলেন, না। তবে, পপলু ভাইয়ের সঙ্গে স্যার কথা বলতে বলেছিলেন-একসময়। যখন আমাকে শিল্পকলা একাডেমি থেকে অফিসিয়ালি দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন আমি পপলু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলাম ছবিটা ফেরত দেওয়া ব্যাপারে। আমার ধারণা ছিল যে, উনি(পপলু) আমার আগে থেকেই পরিচিত। আমি গেলে হয়তো ছবিটা উনি আমার কাছে ছবিটা ফেরত দিবেন। যেহেতু এটা লিখিত দায়িত্ব।
আমি চিঠি (দ্বিতীয় চিঠি) নিয়ে স্ব-শরীরে যেদিন উনার (পপলু) বাসায় যাই, তখন করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ। চিঠিটা উনার বাসার দারোয়ান রিসিভ করেন এবং পপলু ভাই তখন বাসার দোতলা থেকে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন। কুশল বিনিময়ের পরে তিনি আমাকে বলেন- এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমার পরে কথা হবে। এটা নিয়ে এখন আর কিছু করো না। তুমি চিঠিটা দিয়ে যাও। আমি চিঠিটার রিসিভ কপি নিয়ে চলে আসি।
তার কয়েকদিন পরে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার গেটের সামনে উনার সঙ্গে কথা হয়। তখন তিনি আমাকে বলেন- আসলে এটা (ছবি) নিয়ে আমি কি করবো না করবো; তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। আমি এখনোও কিছু চিন্তা করিনি। এ ব্যপারে আমি মন্ত্রাণালয়ে কথা বলবো।
তখন আমি পপলু ভাইকে বললাম- আপনার সিদ্ধান্তের তো কোন কিছু নাই। যদি আপনি মনে করেন শাহাবুদ্দিন স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন, তা হলে আমি স্যারের সঙ্গে আপনার কথা বলিয়ে দিচ্ছি। আপনি কথা বলেন শাহাবুদ্দিন স্যারের সঙ্গে। তখন তিনি তার বক্তব্য স্পষ্ট করেন নি বা কিছু বলেন নি। তবে, এটা বোঝা যাচ্ছিলো যে, উনি ছবিটা শিল্পকলাকে ফেরত দেওয়ার ব্যপারে কোন প্রকার উৎসাহী নন। এবং কথার এক পর্যায়ে তিনি (পপলু) আমাকে বলেন যে, তুমি এ ব্যপারে আর আমার সঙ্গে কথা বলো না, ফোনও দিও না। এটা আমি বুঝবো। পরে এসব কথাগুলো আমি অফিসকে জানাই।
এরপরে, আর কোন চিঠি দেওয়া হয়েছে কিনা বা প্রশাসনিকভাবে বিষয়টি সুরাহা করার জন্য শিল্পকলা একাডেমি কি ব্যবস্থা নিয়েছে বা নিচ্ছে? নিলে, তা কি অবস্থায় আছে?
সাননিউজের এমন প্রশ্নের জবাবে তৈমুর হান্নান বলেন- এটা শিল্পকলা একাডেমির প্রশাসনিকভাবে সিদ্ধান্ত নিবে আবার চিঠি দিবেন কিনা। কারণ, শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ স্যারের সঙ্গে ক’দিন আগে কথা হয়েছে। স্যার তো একটু অবাকই হলেন-বিষয়টি এভাবে দাঁড়িয়েছে জেনে।
তৈমুর হান্নান আরও বলেন, আমি ভেবে অবাক হচ্ছি যে, প্রদর্শনীটি তো উনার ব্যক্তিগত প্রোগ্রাম না। সুতরাং শিল্পকর্মটি তিনি কোনভাবেই নিতে পারেন না। শিল্পকলা একাডেমি স্পর্শকাতর (সেন্সেটিভ) জায়গা। আর একজন কর্মকর্তা তো একটা দায়িত্বে থাকে একটা প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য-তাই না। যাই হোক-এখানকার চিত্রশালায় অনেক মূল্যবান শিল্পকর্ম থাকে। এখান থেকে কেউ একটা মূল্যবান শিল্পকর্ম বের করে নিয়ে যাবে সেটাতো হতে পারে না। এখানকার নিয়ম কিন্তু সবার জন্য এক। কেননা, শিল্পকলা একাডেমি থেকে যদি একটা আর্ট ওয়ার্ক বাইরে যাই বা একটা সাদা ক্যানভাসও কেউ নিয়ে যেতে চাই তাহলে গেটে একটা পাস কপি দেখাতে হয়। এটাই নিয়ম। আমি অবাক হচ্ছি-মহামূল্যবান একটা ছবি নিয়ে গেল কেউ জানলো না।
সান নিউজ/আরআই