সুলতানা আজীম:
নুতন এক অনুভূতি জন্ম নিয়েছে শরীরে, বুঝতে পারি। ভালো লাগেনা কোথায়ও। অফিসে না, বাড়িতে না, বাইরেও না। খেতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে না কোন কাজ করতে। পেরিয়ে গেছে ছয় সপ্তাহ। পিরিয়ড হচ্ছে না। ইউরিণ টেষ্ট করি নিজেই বাড়িতে। পজেটিভ? উল্লসিত হয়ে উঠবো, পারি না। অপেক্ষা করি আরো এক সপ্তাহ। এর মাঝেই এপয়েন্টমেন্ট করি আমার পারসোনাল গাইনোকোলজিষ্টের সঙ্গে। অভিনন্দন জানান ডাক্তার, চেকআপের পরে। নিয়ম অনুযায়ী যা যা দেবার, বুঝিয়ে দেন সব প্যাকেট। পরের এপয়েন্টমেন্ট নির্দিষ্ট করে ফিরে আসি।
অপূর্ব অভিনব এই আনন্দের খবর কী দেবো না তাকে? কী বলবে সে? কিছু সময় নিই বুঝতে। নাহ, দেবো না। একজন মানুষ আসছে পৃথিবীতে, সে আমার সন্তান। সবটুকু অনুভ‚তি দিয়ে ওয়েলকাম করছি তাকে। যা কিছু করা দরকার, পারলে তার চেয়েও অনেক অনেক অনেক বেশী করবো। আমার শরীরের ভেতর জন্ম নিচ্ছে আমার সন্তান। এরচেয়ে বেশী আনন্দ আর কী হতে পারে এই সময়ে? কিন্তু এমন হচ্ছে কেনো? সে তো আসছে দুইজনের জন্যে, দুইজনের হয়ে। কেনো আমি বলতে পারছি না, আমাদের সন্তান। শুধু আমার পরিচয়ে বড়ো হলে, সে কী সুখী হবে পুরোপুরি? তাকে তো জানতেই হবে,কে তার বাবা। জানলেই কী হবে? বাবার সাথে নিবিড় সর্ম্পকের প্রয়োজন কী থাকবে না তাঁর। আমি কী বঞ্চিত করবো তাকে বাবার অধিকার থেকে? ভাবতে পারছি না। কী করবো?
জানাই যদি, কী প্রতিক্রিয়া হবে তার? সে কী প্রস্তুত বাবা হবার জন্যে? যদি অস্বীকার করে সে? উহ্ ... কী কঠিন সময়। অপূর্ব এই আনন্দ কেনো এতো কঠিন মনে হচ্ছে আমার? কী করবো আমি?
পেরিয়েছে আরো কটি সপ্তাহ। জটিল এই সংকট রপান্তরিত হচ্ছে ভয়াবহ জটিলতায়। বেড়ে উঠছে সোনামনি বাবুটি ভেতরে আমার। শিশু, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ও। এতো এতো এতো প্রিয় যে, তাকে কেনো ফেলছি আমি, এমন অপ্রিয় সংকটে? আসতে পারছি না কোন সিন্ধান্তে। শতভাগ মনোযোগী হয়ে উঠি আমার বাবুর প্রতি। আমার শরীরের প্রতি। ভুলে যেতে চাই আর সবকিছু। চাইলেই কী হয়? সমাধান না করলে নিজে থেকে তো শেষ হবে না সমস্যা।
ফোন এলো তার একদিন, আবার। সম্ভব হলো না এবার এড়িয়ে যাওয়া। অভিযোগে বিক্ষত করলো আমাকে। বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত সে, বললাম তাকে। বললাম কোন দায় অথবা দায়িত্ব নিতে হবে না তোমাকে। ও আমার সন্তান। বলতে চাই নি, তবুও বললাম।
কোন জবাব এলো না তার কাছ থেকে কিছুক্ষণ। কিছু বললাম না আমিও আর। ডিসকানেক্ট করলাম ফোন লাইন। ফোন এলো আবার পরদিন। বললো সে এবার, সত্যি বলছো তুমি? একটি বাবু আসছে আমার?
তোমারও নয়, আমারও নয়, বাবুটি আমাদের। তা তুমি চাইলেও না চাইলেও, বললাম তাকে।
মানে? এরচেয়ে বেশী সুখ আর কী আছে আমার? একটি জীবন অপেক্ষা করেছি, একটি অথবা দুটি বাবুর জন্যে। আর সে বাবু তৈরী হচ্ছে তোমার শরীরে। কতোটা আনন্দের আর গর্বের ব্যাপার, তা কী বোঝানো যাবে বলো?
অনেকক্ষণ কথা হলো সেদিন, অনেক দিন পর। কথা হলো বাবুকে নিয়েই। স্বপ্ন আর আনন্দ মিলে ভীষণ সুখী হয়ে উঠলাম আমরা। তবুও তুললাম সেই কথা। ওর মেজাজ আর আচরণের কথা। বাবা হবার জন্যে বাবার চরিত্রও তো গড়তে হবে।
বুঝতে পারছি, অনুভবও করছি, এরকম আচরণ করে কারোই হতে পারবো না আমি। না তোমার না বাবুর। শাস্তিতো কম হয় নি কিছু। তোমাদের দুজনকে ছাড়া চলবে না আমার। তিন টি মাস সময় দাও। দেখো, ঠিক ঠিক বদলে যাবো আমি। বললো সে।
অনুভব করলাম তার উপলদ্ধি। মনে হচ্ছে, সে বুঝতে পারছে তার ভুল। নিশ্চয়ই বদলাবে এবার। তোর কী মনে হয় বলতো? থামলো বর্ণালী।
আবার বাথরুমে গেলো সে। কী বলবো ওকে আমি? সত্য বলবো? মিথ্যে বলবো? ওকে কিছু বলার আগে মনে মনে বললাম, মানুষ বদলায় না। তার জীবনের প্রয়োজনে, পরিস্থিতি বাধ্য করলে বদলাতে চেষ্টা করে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে, তার চরিত্রেই ফিরে যায় সে। কারণ, নিজের অভ্যাসে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে মানুষ। জন্মগত ভাবে পাওয়া এবং পরিবার সমাজ রাষ্ট্রের গড়ে তোলা চরিত্রই তার নিয়ন্ত্রক আসলে। ব্যতিক্রম আছে অবশ্যই। তবে ব্যাতিক্রম কিছু ঘটনা দিয়ে তো আর ইনজেনারেল অবস্থাকে বিচার করা যায় না।
বুঝতে পারছি না কী বলবো আমি বর্ণালীকে। এ্যাবসলিউট কথা কী বলা যায়? না, বলা উচিত?
(সমাপ্ত)