নিজস্ব প্রতিবেদক:
২০১৮ সালের জুলাই মাসে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি থেকে বিপুল পরিমাণ কয়লা উধাও বা চুরি হয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। তখন বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। খনি প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই কয়লা চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করে ১৯ জন খনি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্থানীয় পার্বতীপুর থানায় মামলা করা হয়। আবার একই সঙ্গে খনি কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এই কয়লার ঘাটতিকে চুরি নয়, বরং সিস্টেম লস হিসেবে দেখানোর যুক্তি আনতে দেখা যায়। এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি দুদক মামলার অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, খোয়া যাওয়া কয়লা খনি কর্মকর্তারাই আত্মসাৎ করেছেন। এসব কয়লা খনির গেট দিয়ে ট্রাক করে বেরিয়ে গেছে। অভিযোগপত্রে কয়লা আত্মসাতের জন্য খনির সাত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দায়ী করা হয়। আবার কর্তপক্ষ কয়লা উত্তোলনে যে সিস্টেম লসের কথা বলছে, তাও দেখানো হয়েছে অত্যধিক হারে। সব মিলিয়ে আত্মসাৎ করা কয়লার পরিমাণ ৫ দশমিক ৪৮ লাখ মেট্রিক টন, যার মূল্য ৮৭৬ কোটি টাকা (প্রতি টন কয়লার বর্তমান বাজার মূল্য ১৬ হাজার টাকা ধরে)। এমন হিসেবই দিচ্ছে কনজুমার্স অ্যসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাব।
মঙ্গলবার (৩ মার্চ) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কনজুমার্স অ্যসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- ক্যাব অভিযোগ করে বলে, ‘বড় পুকুরিয়ায় ৫ দশমিক ৪৮ লাখ মেট্রিক টন কয়লা আত্মসাৎ হয়েছে। সেখানে যা হয়েছে তা আসলে ছোট কোনো চুরি নয়। এটা পুকুর চুরি।’ সংগঠনটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশন এই সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে।
তদন্ত কমিটি জানায়, খনিতে এক দশমিক ৪৪ লাখ মেট্রিক টন কয়লা চুরির অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু মামলা চলাকালীন অভিযুক্তদের দায়মুক্তি দিতে জ্বালানি বিভাগ চুরি যাওয়া কয়লাকে ‘সিস্টেম লস’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। এমন এক পরিস্থিতিতে এই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হলো।
সম্মেলনে তদন্ত কমিটির প্রধান সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘যে কাজটি করা উচিত ছিল জ্বালানি বিভাগের, সেটি নাগরিকদের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। এই কমিশনের তদন্তের সময় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবহিত ছিল। আমরা আমাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে হস্তান্তর করবো। তারপর সরকার কী সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটা সরকারের ব্যাপার। আমাদের কাজটুকু আমরা করে দিয়েছি। এখন সরকারের উচিত এই দুর্বৃত্তদের ছাড় না দেওয়া।’
তিনি বলেন, ‘গোজামিল দিয়ে মানুষকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করছে। জাতীয় সম্পদ যারা চুরি করে, আর যারা এর বিচার করেন না, সেটাও বড় অন্যায়।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও তদন্ত কমিটির সদস্য বদরুল ইমাম বলেন, ‘পেট্রোবাংলার প্রস্তাব মতে, কয়লা সরবরাহের সিস্টেম লস ১ দশমিক ৫ শতাংশ ধরে নিলেও আত্মসাতের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ লাখ ৪৮ হাজার মেট্রিক টন।’
সাংবাদিক সম্মেলনে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ও তদন্ত কমিটির সদস্য শামসুল আলম বলেন, ‘এর আগেও ৩০০ টন কয়লা চুরির একটি ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনাটিও একইভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ার সময় চলা প্রশাসনিক তৎপরতার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘কেবলমাত্র সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারী নয়, পরিচালনা বোর্ড, পেট্রোবাংলা, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ ব্যর্থ হয়েছে। দুদকের অভিযোগ পত্রে বিসিএমসিএল'র সাত জন এমডিসহ ২৩ জন অভিযুক্ত। ক্যাবের কমিশন মনে করে, ২৩ জনের সঙ্গে পেট্রোবাংলা, জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা অভিযোগভুক্ত হবেন। তারা এর দায় এড়াতে পারেন না।’
সংবাদ সম্মেলনে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, তদন্ত করে দেখা যায় মামলার বাদী বিসিএমসিএল নিজেই কলা চুরির অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্তদের পক্ষে ন্যায় এবং মামলাটি প্রহসনে পরিণত করে। যা হওয়ার নয় ও সামঞ্জস্যহীন। যা কমিশনের বিবেচনায় অসঙ্গতিপূর্ণ।
এছাড়াও বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক এমএম আকাশ ও প্রফেসর সুশান্ত কুমার দাস।